লোডশেডিং: খরচ বাড়ছে, নির্মাণ কমছে
নির্মাণ খরচ বাড়ার শঙ্কায় কাজের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছেন প্রযোজকেরা।
বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণে নাটকের শিডিউলও গড়বড়, বাড়ছে বাজেট।
নাটকপ্রতি ১০ থেকে ১৫ ভাগ ব্যয় বেড়েছে।
উত্তরায় বেশির ভাগ শুটিং হাউসে জেনারেটর নেই।
‘উত্তরার শুটিং হাউসগুলোতে দিনে পাঁচবারে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার মতো বিদ্যুৎ থাকে না, পরিচালকেরা শুটিং করবেন কীভাবে?’—দেশে চলমান বিদ্যুৎ-বিভ্রাট নিয়ে বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন ‘অপরাজিতা’ শুটিং হাউসের কর্ণধার আবদুল আলিম।
বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের সঙ্গে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে চলচ্চিত্র, টিভি নাটক ও বিজ্ঞাপন নির্মাণে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের। নির্মাণ খরচ বাড়ার শঙ্কায় হিসাব কষে কাজের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছেন প্রযোজকেরা, নির্মাণ করলেও লোকসানের শঙ্কা করছেন কেউ কেউ।
এফডিসি ও রাজধানী উত্তরার আপনঘর, স্বপ্নিলসহ বেশ কয়েকটি শুটিং হাউসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগের তুলনায় হাতেগোনা কয়েকটি নাটক-চলচ্চিত্রের শুটিং চলছে। আবদুল আলিম বললেন, বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের মধ্যে দশ ভাগের এক ভাগ কাজও এখন হচ্ছে না। চলতি আগস্ট মাসে সাত দিনের মধ্যে মোটে দুই দিন কাজ হয়েছে, অন্য সময় হলে সাত দিনের ছয় দিন থেকে সাত দিনই কাজ হতো।
গত মঙ্গলবার উত্তরার মন্দিরা শুটিং হাউসে বাপ দ্য বস নামে একটি নাটকের শুটিং করতে গিয়ে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে ভোগান্তির কথা জনালেন মাবরুর রশিদ বান্নাহ।
বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের মধ্যে দশ ভাগের এক ভাগ কাজও এখন হচ্ছে না। চলতি আগস্ট মাসে সাত দিনের মধ্যে মোটে দুই দিন কাজ হয়েছে, অন্য সময় হলে সাত দিনের ছয় দিন থেকে সাত দিনই কাজ হতো।
প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘একই দিনে চারবার লোডশেডিং হয়েছে। আমার প্রোডাকশন খরচ ১০-১৫ হাজার টাকা বেড়ে গিয়েছে। জেনারেটর ভাড়া করতে হয়েছে। তেলের দাম তখন কম থাকলেও ছয় ঘণ্টা চললে জেনারেটর চার্জ দিতে হয়েছে। আমার অনেক কষ্টের টাকা, প্রডিউসারেরর কষ্টের টাকা প্রতিদিন জেনারেটরের পেছনে দিতে হচ্ছে। অনেক সময় জেনারেটর চালু হতে সময় লাগে, ওভারঅল সিস্টেম লস আছে এক থেকে দেড় ঘণ্টা। এই সময়ে কোনো শুটিংই হয় না। চাপটা পড়ে রাতের বেলা। আমাদের আবার নিয়ম আছে, ১১টার পর শুটিং করা যাবে না। সব দিক দিয়ে বিষয়টি খুবই অস্বস্তিকর ও আনবিয়ারেবল।’
‘সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত শুটিংয়ের নিয়ম বেঁধে দেওয়া আছে। শুটিংয়ের সময় তিন কিংবা দুই ঘণ্টা বাদ গেলে শুটিং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অনেক সময় এক দিনের কাজ দুই দিনে করতে হচ্ছে। ফলে নাটকের বাজেট বেড়ে যাচ্ছে।’
বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কবলে নাটকের শিডিউলও গড়বড় হচ্ছে বলে জানালেন পরিচালকদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি সালাহউদ্দিন লাভলু। তিনি বলেন, ‘সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত শুটিংয়ের নিয়ম বেঁধে দেওয়া আছে। শুটিংয়ের সময় তিন কিংবা দুই ঘণ্টা বাদ গেলে শুটিং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অনেক সময় এক দিনের কাজ দুই দিনে করতে হচ্ছে। ফলে নাটকের বাজেট বেড়ে যাচ্ছে।’
বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণ নির্ধারিত শিডিউলের বাইরে কাজ করতে গিয়ে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে প্রযোজকদের, নির্মাণ ব্যয় বেড়ে গেলেও নাটকের দাম সে অনুযায়ী বাড়েনি বলে আক্ষেপ করলেন প্রযোজক মনোয়ার পাঠান। টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মনোয়ার বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে শিডিউল ধরে কেউই কাজ করতে পারছে না। সব কাজে কলাকুশলীদের বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে ক্যামেরাভাড়া, লাইট, গাড়িভাড়া ঘণ্টা ভিত্তিতে দিতে হয়।’ একটি নাটক নির্মাণে তিন থেকে সাত লাখ টাকার মতো লাগে, বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কবলে নাটকপ্রতি ১০ থেকে ১৫ ভাগ ব্যয় বেড়েছে। বিদ্যুৎ-বিভ্রাট কাটিয়ে ওঠার আগেই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ বলছেন হাউসমালিক ও প্রযোজকেরা। গাড়িভাড়া বেড়ে যাওয়ায় নাটক-চলচ্চিত্রের নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। চলচ্চিত্রের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন ঘুরে দেখা গেছে, চলচ্চিত্রের বাইরে গুটিকয়েক টেলিভিশন অনুষ্ঠানের শুটিং চলছে।
এফডিসির ফ্লোর অ্যান্ড সেট ইনচার্জ ও জনসংযোগ কর্মকর্মা হিমাদ্রী বড়ুয়া জানান, এফডিসির শুটিং ফ্লোরের বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে জেনারেটর কিংবা অন্য কোনো সুবিধা নেই। ফলে যাঁরা শুটিং করতে আসেন, তাঁরা নিজস্ব জেনারেটর নিয়ে আসেন।
এক টিভি চ্যানেলের কর্মকর্তা জানালেন, জেনারেটরে তেল পুড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুটিং করতে গিয়ে অনুষ্ঠানের বাজেট বেড়ে যাচ্ছে। গত এক দশকে চলচ্চিত্রের খাত ক্রমেই সংকুচিত হয়ে এলেও নাটকের খাত প্রসারিত হয়েছে, বিশেষ করে দুই ঈদে এক হাজারেরও বেশি নাটক নির্মিত হয়। এর বাজেট থাকে কয়েক কোটি টাকা। স্বাভাবিক সময়ে মাসে শতাধিক নাটক নির্মিত হয়, মাঝে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে নাটক ও চলচ্চিত্রশিল্প ঝিমিয়ে পড়েছিল। মহামারি কাটিয়ে যখন চাঙা হতে শুরু করেছিল তখনই বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের ধাক্কায় পরিচালক-প্রযোজকদের মাথায় হাত। বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কবলে কয়েক গুণ কাজ কমে এসেছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে শুটিং চালিয়ে যাওয়া আদৌ সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কার কথা জানালেন নির্মাতা সালাহউদ্দিন লাভলু। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘শুটিং নিয়ে ঝামেলার মধ্যে পড়েছি। উত্তরায় বেশির ভাগ শুটিং হাউসে জেনারেটর নেই, জেনারেটর থাকলেও তেলের দাম বেড়েছে। সবকিছু মিলিয়ে শুটিংয়ের ব্যয় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, আদৌ আমরা শুটিং করতে পারব কি না, সেই আশঙ্কার মধ্যে আছি। আমাদের প্রডাকশনের যে ক্ষতি হচ্ছে, সেটা কাটিয়ে ওঠা মুশকিল। এখন কী করণীয়, তা জানতে বসতে হবে।’ উত্তরার শুটিং হাউসগুলো নাটকের শুটিংয়ের জন্য দিনপ্রতি ১০ হাজার ও চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের জন্য ১৮ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়।
আপনঘর শুটিং হাউসের কর্ণধার খলিলুর রহমান বললেন, ‘লোডশেডিংয়ের কারণে কাজ কমে গেছে, ছোটখাটো কাজ করছে যারা, তারা তিন ঘণ্টা কাজ বন্ধ থাকায় কুলাতে পারছে না। ফলে অনেকে কাজ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। কাজের সংখ্যাও বেশ কম। আগে মাসে ২৫ দিনের মতো আমাদের হাউসে কাজ হলেও এখন ২০ দিনের কম কাজ হচ্ছে। শুটিং হাউসের মালিকদের ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে।’
একটি শুটিং হাউসের কর্মীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিলসহ যাবতীয় খরচ সামলাতে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়। এভাবে চলতে থাকলে খরচের টাকাই উঠবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কার কথা জানালেন তিনি। বেশির ভাগ নাটকের শুটিং হয় উত্তরায়, এখানকার শুটিং হাউসগুলোতে ইনডোর শুটিংয়ের জন্য পুরোপুরিই বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করতে হয় প্রযোজক, নির্মাতাদের। শুটিং ইউনিটে সব সময়ের জন্য শুটিংয়ে ব্যবহৃত বিশেষ লাইট জ্বালিয়ে রাখতে হয়। ফলে ইনডোরের কাজে বিদ্যুৎ না থাকলে শুটিংয়ের সুযোগ নেই। শুটিং হাউস ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ শুটিং হাউসেই বিদ্যুতের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে জেনারেটর ব্যবস্থা নেই। বিষয়টি নিয়ে শুটিং হাউস মালিক সমিতির সভাপতি, স্বপ্নিল শুটিং হাউসের কর্ণধার আবদুল আলিম জানালেন, ২০১৯ সালের আগে সব শুটিং হাউসেই জেনারেটর ছিল। মাঝে বিদ্যুতের অবস্থা ভালো হওয়ায় জেনারেটরগুলো কাজে লাগেনি। অব্যবহৃত থেকে থেকে সেগুলো অকেজো হয়ে গেছে, কেউ বিক্রিও করে দিয়েছে। হঠাৎ করে পাঁচ লাখ টাকায় জেনারেটর কিনতে হিমশিম অবস্থার কথা জানিয়েছেন শুটিং হাউসের মালিকেরা। অনেকে বলছেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে জেনারেটর চালিয়ে পোষাতে পারবেন না। সেই সঙ্গে জেনারেটরের শব্দে শুটিং করাও দুরূহ বলে জানালেন তিনি। নাটক-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, আগে লোডশেডিং হতো না, হলেও ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই বিদ্যুৎ চলে আসত। সেই সময়টা নাশতা কিংবা স্ক্রিপ্ট পড়ায় চলে যেত। ফলে আগে ইনডোর শুটিংয়ে জেনারেটরের ব্যবহার ছিল না বললেই চলে। উত্তরায় শুটিং কমলেও কেউ কেউ বিদ্যুৎ-বিভ্রাট এড়াতে পুবাইল, মানিকগঞ্জে আউটডোরে শুটিং করছে।