হ্যালো, কাছের মানুষজন...

সিগনেচার স্টাইলে বাংলা সিনেমা নিয়ে ভিডিও বানিয়ে পরিচিতি পেয়েছেন কনটেন্ট ক্রিয়েটর রাশেদুজ্জামান রাকিব; যিনি দর্শকমহলে ‘আরএনএআর’ নামে সমধিক পরিচিত।

রাশেদুজ্জামান রাকিব।ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

‘ছোটবেলা থেকে সিনেমা পছন্দ করতাম। তবে সিনেমা দেখার সুযোগ ছিল কম। তখন বিটিভি ও একুশে টিভিতে সিনেমা দেখতাম। সিনেমা নিয়ে আমার জ্ঞান বলতে অতটুকুই ছিল; ওই সিনেমাগুলোকেই দুনিয়ার সেরা সিনেমা মনে করতাম,’ প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন রাশেদুজ্জামান রাকিব।

প্রায় আট বছরের পথচলায় কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন রাকিব। দেশের চলচ্চিত্রবিষয়ক শীর্ষ কনটেন্ট ক্রিয়েটর তিনি। আলাদা ঢঙে বাংলা সিনেমা নিয়ে ভিডিও বানিয়ে সাড়া ফেলেছেন।

গত সোমবার প্রথম আলো কার্যালয়ে হাজির হয়েছিলেন রাকিব। শোনালেন দর্শক থেকে কনটেন্ট ক্রিয়েটর হয়ে ওঠার গল্প।

উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামে রাকিবের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। শৈশবের সিনেমা দেখার একমাত্র মাধ্যম ছিল টেলিভিশন। পর্দার বাইরের জীবনটা তাঁর চেনা ছিল না। ২০০৭ সালে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁকে একটি কম্পিউটার কিনে দেন বাবা। কম্পিউটার পাওয়ার পর সিনেমা দেখার দুনিয়াটা বড় হতে থাকে।

কৈশোরের স্মৃতি হাতড়ে রাকিব বলেন, ‘তখন পাঁচ টাকায় নাটকের সিডি ভাড়া পাওয়া যেত। হুমায়ূন আহমেদের নাটকের সিডি আনতাম। সিডি সাত দিন রাখা যেত। সাত দিন ধরে একই নাটক দেখতাম। ফলে নাটক প্রায় মুখস্থ হয়ে যেত।’

একসময় দেখা গেল, কুড়িগ্রামের ওই দোকানের নাটকের সব সিডি দেখে শেষ করে ফেলেছেন রাকিব। পরে কম্পিউটারে সিনেমা দেখা শুরু করেন তিনি। রাকিবের ভাষ্য, ‘তখন খুঁজে খুঁজে “জানে তু ইয়া জানে না”, “রব নে বানা দি জোড়ি”, “গজনি” দেখেছিলাম। যেটাই দেখতাম, সেটাই সেরা মনে হতো।’

রাশেদুজ্জামান রাকিব। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

সিনেমার খোঁজে

হাতের নাগালে তখন ইন্টারনেট এসেছে, খুঁজে খুঁজে আইএমডিবির সেরা আড়াই শ সিনেমার তালিকা জোগাড় করেন রাকিব। তালিকার একটি সিনেমাও দেখা ছিল না। তালিকার কোনো ছবিই কুড়িগ্রামে মেলেনি। কী করবেন? সিনেমার খোঁজে পাশের শহর রংপুরে গেলেন।

রংপুরে রাকিবের বোনের বাড়ি। এই বোনের বাড়ি যাওয়ার কথা বলে রংপুরে সিনেমা খুঁজতে যেতেন রাকিব। তাঁর ভাষ্য, ‘তখন কুড়িগ্রাম থেকে রংপুরের ভাড়া ছিল ৪০ টাকা। বাসা থেকে ১০০ টাকা নিতাম। প্রথমবার রংপুর ঘুরেও কোনো সিনেমা পেলাম না। এক দোকানি বললেন, “সিনেমার নাম দেন, আমি ঢাকা থেকে সিডি ‘রাইট’ করে এনে দিতে পারব।” ওনাকে প্রথমে ১৫টি সিনেমার নাম দিয়েছিলাম। প্রতিটি ডিভিডির জন্য ৫০ টাকা চাইলেন। দুটি ডিভিডিতে ১০টি সিনেমা দিয়েছিলেন।’

সেই বছর কুড়িগ্রাম থেকে রংপুরে আসা-যাওয়ার ওপরই ছিলেন রাকিব। টাকা জমিয়ে ওই দোকান থেকে ডিভিডি নিয়ে আসতেন। হিসাব কষে জানালেন, এক বছরে ৮৯টির মতো ডিভিডি কিনেছিলেন তিনি, বছরজুড়ে শ পাঁচেক সিনেমা দেখেছেন। রাকিবের ভাষ্য, ‘তখন বিশ্ব সিনেমা নিয়ে একধরনের ধারণা পেতে শুরু করেছিলাম।’

একসময় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হলেন। ঢাকায় আসার পর রাকিবের সিনে-দুনিয়া আরও বিস্তৃত হতে থাকে।

ইউটিউবে খুঁজে খুঁজে বাংলা সিনেমা দেখতে থাকেন। হলে গিয়েও কিছু বাংলা সিনেমা দেখেছেন। তখন থেকেই সিনেমার বাইরে ভাবতে পারতেন না তিনি। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরই বুঝেছিলাম, পেশাগত জীবনে ফিজিকস নিয়ে আমি কিছু করব না। সিনেমা নিয়েই কিছু একটা করব,’ বলেন রাকিব।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরই বুঝেছিলাম, পেশাগত জীবনে ফিজিকস নিয়ে আমি কিছু করব না। সিনেমা নিয়েই কিছু একটা করব।
রাশেদুজ্জামান রাকিব, কনটেন্ট ক্রিয়েটর
রাশেদুজ্জামান রাকিব। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
সুইডিশ কনটেন্ট ক্রিয়েটর পিউডিপাইয়ের ইউটিইব চ্যানেল দেখে নিজেও চ্যানেল খোলার কথা ভাবেন রাকিব। ২০১৬ সালে ‘আরএনএআর’ নামে চ্যানেলটি খোলেন তিনি।

আরএনএআরের যাত্রা

সুইডিশ কনটেন্ট ক্রিয়েটর পিউডিপাইয়ের ইউটিইব চ্যানেল দেখে নিজেও চ্যানেল খোলার কথা ভাবেন রাকিব। ২০১৬ সালে ‘আরএনএআর’ নামে চ্যানেলটি খোলেন তিনি।

চ্যানেলের নাম ‘আরএনএআর’ কেন? রাকিব জানালেন, ‘ভেবেছিলাম, একটা ইউনিক নাম দেওয়া উচিত। সেটা মানুষ মনে রাখতে না পারলেও যেন বুঝতে পারে, নামটা নরমাল নয়। আমি ভিডিওতে বলি, কাছের মানুষজন। ছোটবেলা থেকেই কাছের মানুষজনই আমার পৃথিবী। এগুলো পরিবারের সদস্যদের আদ্যাক্ষর। আর-এ নিজের ও মায়ের নাম, এন-এ ভাই (ও পরে স্ত্রীরও) নাম, এ-তে বাবা ও বোনের নাম।’

আরও পড়ুন

অল্প সময়ের মধ্যেই পরিচিতি পেলেন, সাবস্ক্রাইবারও বাড়তে থাকল। তবে এক বছরের ব্যবধানে চ্যানেলটি বেহাত হয়ে গেলে ভীষণ ভেঙে পড়েন রাকিব। এই দুঃসময়েও সিনেমাই রাকিবকে উপশম দিয়েছিল।

পরে ২০১৭ সালে একই নামে আরেকটি চ্যানেল খোলেন, এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তাঁর চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ১৮ লাখের বেশি। মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হয় তাঁর ভিডিও।

সিগনেচার স্টাইল

বৈচিত্র্যময় বাচনভঙ্গি, সাবলীল উপস্থাপনার সঙ্গে সিনেমার রেফারেন্স রাকিবকে আলাদা করেছে। ‘হ্যালো তুমিনল বাসী’, ‘হ্যালো, কাছের মানুষজন’ থেকে ‘ভিডিও ভালো লাগলে সামাজিক কাজে লেগে পড়ুন’—এমন সংলাপের জন্য আলাদাভাবে মনে করেছেন দর্শকের কেউ কেউ।

এমন সংলাপের চিন্তা কীভাবে পেলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে রাকিব বলেন, ‘আপনি যদি আলাদা হতে চান, তাহলে আপনার আলাদা স্টাইল লাগবে। সেটা আপনাকেই খুঁজে বের করতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই এসব খুঁজে নিয়েছি।’

সামনে কী

কনটেন্ট বানানোর পাশাপাশি সিনেমা-সিরিজের সঙ্গেও আছেন রাকিব। আলোচিত সিরিজ ‘কারাগার’-এর রাইটিং টিমে ছিলেন তিনি, আরেক সিরিজ ‘কালপুরুষ’-এর স্ক্রিপ্ট সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করেছেন।

তিনি আজীবন কনটেন্ট বানাতে চান। এর সঙ্গে সিনেমা, সিরিজে যুক্ত হতে চান। এ বছর তাঁর আরেকটি কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

আরও পড়ুন

‘প্রতিবছরে না হলেও দুই বছরে একটি সিনেমা কিংবা সিরিজে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা আছে,’ বলেন রাকিব।