কেউ আশাবাদী ছিলেন, কেউ ছিলেন সংশয়ে। করোনা–পরবর্তী এই সময়ে ছবি মুক্তি দিলে কী হবে, দর্শক আদৌ প্রেক্ষাগৃহে আসবেন কি না, এমন নানা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যেই ছিটমহল দিয়ে নতুন বছরের খাতা খোলে ঢালিউড। ছবিটি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়লেও ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পাওয়া ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ ২’ প্রেক্ষাগৃহে কিছুটা দর্শক ফেরায়। এরপর ঈদুল ফিতরের আগপর্যন্ত আরও আধা ডজন ছবি মুক্তি পেলেও কোনোটাই দর্শক টানতে পারেনি। তবে ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া ‘গলুই’, ‘শান’ ও ‘বিদ্রোহী’ দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দেয় ঢালিউড। তারপর তিন মাস আবার দর্শক–খরায় ভোগে দেশের বিভিন্ন ছবিঘর।
বছরের মাঝামাঝি এসে বদলে যায় চিত্র। ঈদুল আজহায় ছন্দে ফেরে ঢালিউড। ‘সাইকো’, ‘পরাণ’ ও ‘দিন: দ্য ডে’ একসঙ্গে মুক্তি পেলেও দ্বিতীয় সপ্তাহে ‘পরাণ’ সিনেমাপ্রেমীদের মধ্যে সাড়া ফেলে। ঠিক তিন সপ্তাহ পর মুক্তি পাওয়া ‘হাওয়া’ যেন নতুন হাওয়া বইয়ে দেয় ঢালিউডে।
ছবি দুটি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে প্রেক্ষাগৃহে ঝড় তোলে। প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের ভিড় বাড়তে থাকে। একটা পর্যায়ে দর্শককে টিকিটের জন্য হাহাকার করতেও দেখা গেছে। নিয়মিত দর্শকের পাশাপাশি ছবি দুটি দেখতে নতুন দর্শকও ভিড় করেন। যাঁদের কেউ এক দশক, কেউবা দুই দশক পর পরিবার নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে ছবি দেখতে এসছিলেন। এমনকি দেশের বাইরে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া থেকেও ভালো আয় করে ছবি দুটি। মুক্তির প্রায় ছয় মাস পার হতে চলল, এখনো দেশের বেশ কয়েকটি হলে চলছে পরাণ। সম্প্রতি ভারতে মুক্তি পেয়েছে হাওয়া। তাই তো অনেকের মতে, এটি ছিল চলচ্চিত্রের জন্য ইতিবাচক বছর।
২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের প্রেক্ষাগৃহে ৪৮টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। ৩০ ডিসেম্বর ‘মেঘ রোদ্দুর খেলা’ ও ‘বীরাঙ্গনা ৭১’ নামে দুটি ছবি মুক্তির কথা রয়েছে। সে হিসাবে এ বছর মুক্তি পাওয়া ছবির সংখ্যা হবে ৫০। প্রযোজক পরিবেশক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, এ বছর মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে ‘ছিটমহল’, ‘তোর মাঝেই আমার প্রেম’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ ২’, ‘মাফিয়া ১’, ‘মুখোশ’, ‘শিমু: মেইড ইন বাংলাদেশ’, ‘গুণিন’, ‘লকডাউন লাভ স্টোরি’, ‘জাল ছেঁড়ার সময়’, ‘গলুই’, ‘শান’, ‘বিদ্রোহী’, ‘বড্ড ভালোবাসি’, ‘পাপ পুণ্য’, ‘আগামীকাল’, ‘বিক্ষোভ’, ‘তালাশ’, ‘অমানুষ’, ‘পরাণ’, ‘দিন: দ্য ডে’, ‘সাইকো’, ‘কার্নিশ’, ‘যা হারিয়ে যায়’, ‘হাওয়া’, ‘আশীর্বাদ’, ‘ভাইয়ারে’, ‘লাইভ’, ‘বীরত্ব’, ‘অপারেশন সুন্দরবন’, ‘বিউটি সার্কাস’, ‘ঈশা খাঁ’, ‘হৃদিতা’, ‘যাও পাখি বলো তারে’, ‘রাগী’, ‘জীবন পাখি’, ‘বসন্ত বিকেল’, ‘রোহিঙ্গা, ‘দামাল’, ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’, ‘দেশান্তর’, ‘ভাঙন’, ‘মেইড ইন চিটাগং’, ‘ও মাই লাভ’, ‘হডসনের বন্দুক’, ‘জয় বাংলা’, ‘৭১ এর একখণ্ড ইতিহাস’, ‘পায়ের ছাপ’ ও ‘কাগজ’।
‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’র আয় নিকট অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এ বছর মুক্তি পাওয়া একাধিক ছবি দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশ থেকে রেকর্ড আয় করেছে। এ ছাড়া এ বছর মুক্তি পাওয়া ‘গলুই’, ‘শান’, ‘পাপ পুণ্য’, ‘গুণিন’, ‘দামাল’, ‘দেশান্তর’, ‘পায়ের ছাপ’, ‘বিউটি সার্কাস’, ‘অপারেশন সুন্দরবন’, ‘বীরত্ব’, ‘মুখোশ’সহ ডজনখানেক ছবি দর্শকের প্রশংসা পেয়েছে। স্পনসর, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, টিভি স্বত্ব, ডিজিটাল স্বত্ব বিক্রি এবং দেশের বাইরে মুক্তি দিয়ে এসব ছবির বিনিয়োগ উঠে এসেছে। কেউ কেউ লাভ করেছেন বলেও জানালেন সংশ্লিষ্ট ছবির প্রযোজক ও পরিচালকেরা। পাশাপাশি কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া, পায়ের ছাপসহ কয়েকটি ছবি দেশের বাইরে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসব থেকে পুরস্কারও জিতেছে।
সব মিলিয়ে বছরটিকে সিনেমার জন্য সম্ভাবনাময় মনে করছেন নির্মাতা কাজী হায়াৎ। তিনি বলেন, ‘আমার জানামতে, গত বছর (২০২১ সাল) ১৯টি ছবি মুক্তি পায়। এবার হচ্ছে ৫০টি। এর মধ্য দুটি ছবি তো দারুণ ব্যবসা করেছে। সাত-আটটি ছবি প্রেক্ষাগৃহে চালানোর পর নানা মাধ্যমে স্বত্ব বিক্রি করে কিছুটা লাভও করেছে। অনেক দিন পর এ অবস্থাকে সিনেমার জন্য সম্ভাবনাই বলতে চাই।’
চলতি বছরটি ঢালিউডের জন্য আশীর্বাদ বলে মনে করেন পরাণ ছবির পরিচালক রায়হান রাফি। তাঁর ভাষ্য, ‘অনেক বছর পর বলতে পারি, বছরটি দেশের চলচ্চিত্রের জন্য শুভ। এখন নতুন করে বড় বড় প্রতিষ্ঠান সিনেমা বানানোর আগ্রহ দেখাচ্ছে, সিনেপ্লেক্সও শাখা বাড়াচ্ছে। বছরে যদি আমরা ৮-১০টি সিনেমা দিতে পারি, তাহলে আমাদের সিনেমার সোনালি দিন ফিরতে সময় লাগবে না।’
হাওয়ার পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন মনে করেন, ‘চলতি বছর বাংলা সিনেমা দেশের গণমানুষের কাছে পৌঁছে গেছে, দেশের বাইরেও বাংলাভাষী মানুষ দল বেঁধে আমাদের সিনেমা দেখেছেন, এটি খুব ভালো দিক। আনন্দেরও।’ তিনি বললেন, ‘খেলাধুলা, রাজনীতিসহ নানা বিষয় গণমানুষের আলোচনায় থাকে। কিন্তু সিনেমা বহু বছর গণমানুষের আলোচনা ছিল না, যেটি চলতি বছর হয়েছে। এ আলোচনা বাংলা সিনেমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর গণমানুষ যেটি নিয়ে আলোচনা করে, সেটি শিল্প হিসেবে দাঁড়াতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
হাওয়া ছবিতে চান মিয়া মাঝির চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন চঞ্চল চৌধুরী। তিনি বছরটিকে বাংলা সিনেমার ঘুরে দাঁড়ানোর বছর মনে করলেও ছবির সংখ্যার চেয়ে মানের দিকে জোর দেওয়া জরুরি মনে করছেন। চঞ্চল বলেন, ‘বর্তমান সময়ে এসে ধারাবাহিকভাবে ভালো সিনেমা নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। এক যুগ আগে মনপুরা যেমন হিট হয়েছিল, মাঝে সে রকম হিট সিনেমা আমরা দিতে পারিনি। এখন থেকে যেন হাওয়া, পরাণ-এর মতো দর্শক আলোচিত ৮-১০টি ছবি দর্শককে উপহার দিতে পারি, তা মাথায় রাখতে হবে। তাহলে সিনেমার ঘুরে দাঁড়ানোর বছর সার্থক হবে।’