বাংলা সিনেমার গল্প বদলেছে, নাকি মোড়ক
২০২১ সালে নির্মিত হলেও শাকিব খান অভিনীত ‘অন্তরাত্মা’ মুক্তি পেতে পেতে ২০২৫ হয়ে যায়। সিনেমাটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা গল্প নিয়ে বেশ প্রশংসা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে সিনেমাটি মোটেও সাড়া ফেলতে পারেনি। অথচ একই অভিনেতার আরেক ছবি ‘বরবাদ’ দর্শকদের মধ্যে আলোড়ন তুলেছে। বলা হচ্ছে, এই কয় বছরে ছবির গল্পের ধরন বদলে গেছে, তাই মার খেয়েছে সেকেলে ‘অন্তরাত্মা’। আসলেই কি সিনেমার গল্প বদলে গেছে, নাকি কেবল প্রকাশের ভঙ্গি পাল্টেছে? প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে চলচ্চিত্রের অভিজ্ঞ নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার ও গবেষকদের কাছে।
গল্প না আয়োজনে গুরুত্ব
প্রবীণ চলচ্চিত্রকার ও কাহিনিকার ছটকু আহমেদ মনে করেন, সময়ের সঙ্গে পাল্টেছে সিনেমার গল্প বলার ধরন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সময়ে পারিবারিক গল্পে ছবি হতো। দর্শক ধৈর্য নিয়ে দেখতেন। এখন গল্প নয়, বেশি টাকা খরচ করে বড় আয়োজনই প্রধান। আগে বলতাম, গল্প ভালো হলে সিনেমা চলবে। এখন অ্যারেঞ্জমেন্ট ভালো হলে চলবে।’ বরবাদ-এর সফলতা বড় আয়োজনের কারণেই। কিন্তু গল্পটা দর্শকদের কাছে কতটা জায়গা করে নিয়েছে, সেটা নিয়ে সন্দেহ রাখেন তিনি। এ নির্মাতা বলেন, ‘সিনেমা হলে বসে কেউ এখন চার লাইনে গল্প ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। গল্পের গভীরতা নেই—চমক আছে, গ্ল্যামার আছে।’
তবে ছটকু আহমেদের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় নির্মাতা শিহাব শাহীন। তিনি বলেন, ‘এটা সব ক্ষেত্রে সত্য না। আমাদের দেশে বড় আয়োজনে নির্মিত অনেক সিনেমাই আছে, যেগুলো ব্যর্থ হয়েছে। এ দেশের সিনেমার বাজার কিন্তু অত বড় না, যে কেউ ঝুঁকি নেবেন।’ শিহাব শাহীনের ভাষ্যে, ‘গল্পের জোরেই ব্লকবাস্টার হয়েছে আমার দাগি। খুব বড় আয়োজনে কাজটা করিনি। সাড়ে তিন কোটি টাকা বাজেটে সিনেমাটা বানিয়েছি। বিপরীতে প্রায় ১৬ কোটি টাকা এসেছে।’ এ নির্মাতার দাবি, কেউ যদি কেবল বড় আয়োজনের দিকে নজর দেন, তাহলে হয়তো কয়েকটা সিনেমায় দর্শক টানবে। তারপর আবেদন হারিয়ে যাবে।
গল্পের গঠন বদলে গেছে
নতুন প্রজন্মের নির্মাতা সঞ্জয় সমদ্দার গল্পের রূপান্তরকে গভীর মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে দেখেন। তিনি বলেন, ‘গল্পের এসেন্স, বলার ধরন ও সিনেম্যাটিক ভাষা বদলে যাচ্ছে। নির্মাতা ও দর্শক—দুজনেই বিশ্ব কনটেন্টে এক্সপোজড হচ্ছে। ফলে এখন মানবিক ইড, ইগোসহ প্রিমিটিভ ফোর্সগুলো উঠে আসছে গল্পে।’ তাঁর মতে, আবেগ চিরন্তন। যে কারণে শেক্সপিয়ার আজও প্রাসঙ্গিক। গল্প যদি চিরকালীন সংকট নিয়ে হাজির হয়, তবে তা সময় বা ভৌগোলিক সীমা ছাড়িয়ে যাবে।’
বাংলা সিনেমার গল্পের গঠন যে বদলেছে, এর সঙ্গে পুরোপুরি একমত শিহাব শাহীন। তিনি বলেন, ‘সিনেমার গল্প একটা নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর সূত্র ধরে আগায়। এটা সব দেশের সিনেমায় একই। আমাদের গল্পের গঠন বদলাচ্ছে। নতুন কাঠামো তৈরি হচ্ছে। সময় বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে নতুনভাবে গল্প বলতে চাইছেন অনেক পরিচালক।’
খলনায়ক এখন নায়ক!
দেশের বহু বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার আবদুল্লাহ জহির বাবু মনে করেন, গল্প বলার ধরন বদলেছে। যেসব চরিত্রে আগে খলনায়ক থাকত, এখন তাঁরাই মূল চরিত্র। যেমন ড্রাগ অ্যাডিক্ট, মানসিক জটিলতায় ভোগা চরিত্র। এটাই সময়ের পরিবর্তন। তিনি আরও বলেন, ‘পারিবারিক গল্প ও প্রেম এখনো সিনেমায় রয়েছে, তবে তাদের উপস্থাপনা ভিন্ন। আগে চিন্তাও করতাম না ড্রাগ আসক্ত ছেলের গল্পে সিনেমা হবে। এখন সেটা মূলধারার বিষয় হয়ে গেছে।’ তবে তাঁর মতে, বরবাদ হিট হয়েছে প্রধানত শাকিব খানের তারকাখ্যাতির জন্য। তিনি না থাকলে সিনেমাটি হয়তো চলত না।
অনুকরণ নাকি অনুপ্রেরণা?
দক্ষিণি বা বলিউডি সিনেমার ছায়ানুবর্তিতা নিয়েও প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে। তুফান, বরবাদ, জংলি সিনেমাগুলো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়েছে নেতিবাচক চর্চা। এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ জহির বলেন, ‘এখন আর “সাউথ ইন্ডিয়ান প্রভাব” বলে কিছু নেই। গল্পের ডিজাইন বা ডিটেইলিং হয়তো তাদের মতো, তবে সেটাকে অনুকরণ বলা যাবে না। আমরা টার্কিশ, কোরিয়ান, ইরানিয়ান গল্প বলার ভঙ্গিতেও প্রভাবিত হচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রযোজকেরাও এখন নতুন গল্প চান। গৎবাঁধা গল্পে আগ্রহ নেই বলেই আমরা অন্যভাবে ভাবছি।’
বেশির ভাগ সমালোচক মনে করেন এখনো ভারতীয় সিনেমার প্রভাব থেকে বের হতে পারেনি ঢাকাই চলচ্চিত্র। তরুণ চিত্রনাট্যকার নাজিম-উদ-দৌলার কথায় তেমনটাই স্পষ্ট। তাঁর সোজাকথা, ‘আগে পারিবারিক বা রোমান্টিক ঘরানার যা কিছু সিনেমা হতো, তাতে ভারতীয় সিনেমার ছাপ ছিল। এক দশক আগেও দক্ষিণি ছবি নকল করে সিনেমা বানাতে দেখেছি। আমরা যাঁরা এ প্রজন্মের লেখক-নির্মাতা আছি, তাঁরা চাচ্ছি মৌলিক ধারা জাগিয়ে তুলতে। তবে পুরোপুরি যে পারছি, এটা আমি বলব না। বলিউড বা সাউথের সিনেমার কিছু উপাদান চলে আসে; কিন্তু গল্পটা মৌলিক রাখার চেষ্টা করি।’
অনেক প্রযোজক তাঁকে দক্ষিণি সিনেমার অনুকরণে গল্প লিখতে বলেন। এ প্রসঙ্গে নাজিম বলেন, ‘কিছু নির্মাতা আছেন, যাঁরা রেফারেন্স হিসেবে সাউথের সিনেমার কথা বলেন; ওমুক সিনেমার মতো একটি সিনেমা করতে চাই। এই যেমন কবির সিং বা অ্যানিমেল। আমি আমার জায়গা থেকে বলি, “আমাদের দেশে তো ভায়োলেন্স কম হয় না। প্রচুর গল্প আছে।” আমাকে কবির সিং কেন করতে হবে? আমি আমার জায়গা থেকে চেষ্টা করি, তাঁদের দেওয়া রেফারেন্স ভুলে গিয়ে আমার নিজস্ব গল্পটাকে সামনে আনার চেষ্টা করি।’
দর্শকদের রুচি পাল্টালেও নির্মাতাদের রুচি পাল্টায়নি। তাঁরা ভাবেন, এখনো ওই দক্ষিণি সিনেমা কপি করলে মানুষ দেখবে। তবে এ সময়ের অনেকে সেই ধারণা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছেন, তাই ইতিবাচক ভবিষ্যৎ দেখছেন এই চিত্রনাট্যকার।
প্রেক্ষাপট বদলেছে
চলচ্চিত্র–গবেষক অনুপম হায়াৎ মনে করেন, গল্পে পরিবর্তন এসেছে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের কারণে। তিনি বলেন, ‘বিষয়ভিত্তিক গল্প এখন চোখে পড়ে। যেমন অজ্ঞাতনামা—একজন প্রবাসীর মৃত্যুর পরের জটিল বাস্তবতা। এখন জলবায়ু পরিবর্তন, বেকারত্ব, মাইগ্রেশন—এসবও সিনেমায় আসছে।’ তবে তিনি বাণিজ্যিক সিনেমায় অনেক সময় কেবল মোড়ক পাল্টানো গল্প দেখেন। তাঁর কথায়, ‘আগে বন্দুক হাতে ডাকাতি দেখাত, এখন সেটা সুড়ঙ্গ-এ ব্যাংক ডাকাতির আঙ্গিকে এসেছে নতুনত্ব। গল্প তো একই, ভালো-খারাপের লড়াই।’ এই গবেষক আরও বলেন, ‘সহিংসতা থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু অতিরিক্ত হলে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। রক্তপাতকে যদি গ্লোরিফাই করা হয়, সেটি উদ্বেগজনক।’
তাহলে কী বদলেছে?
বাংলা সিনেমার গল্পের অস্থির গঠন কি আদৌ পাল্টেছে? উত্তর, আংশিক। গল্পের বিষয়বস্তুতে এসেছে ভিন্নতা, উপস্থাপন ও নির্মাণশৈলীতে এসেছে বৈচিত্র্য। পুরোনো প্রেম-পরিবারের গল্প এখনো আছে, কিন্তু তা আর একরৈখিক নয়। এখন গল্পে আসছে মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা, সামাজিক প্রেক্ষাপটের জটিলতা ও আন্তর্জাতিক স্টাইলিং। দর্শক এখন ‘শুধু গল্প’ নয়—গল্পের সঙ্গে সংলাপ, সিনেমাটোগ্রাফি, আবহসংগীত ও পারফরম্যান্সের মেলবন্ধনও খোঁজেন।
সিনেমার গল্পের পরিবর্তন আসলে সময়েরই অনুবাদ। এই সময় যেমন সদা পরিবর্তনশীল ও বিচিত্র, সিনেমাও তেমনি হচ্ছে বহুমাত্রিক। তবে এই পরিবর্তনের মধ্যেও প্রশ্ন রয়ে যায়, গল্পের মূলে কি মানবিক সংকট, আবেগ ও গভীরতা এখনো রয়েছে? নাকি এখন সিনেমা কেবল চোখধাঁধানো দৃশ্যের সমাহার?
সময়ই হয়তো সেই উত্তর দেবে।