উত্তরবঙ্গ থেকে সবজি কিনে কারওয়ান বাজারে বিক্রি করেছি: বাদল খন্দকার

'বিশ্বনেত্রী’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘পৃথিবী তোমার আমার’, ‘মধুর মিলন’, ‘সাগরিকা’, ‘প্রেম করেছি বেশ করেছি’, ‘আবার একটি যুদ্ধ’, ‘বিদ্রোহী পদ্মা’, ‘মিস ডায়না’সহ অনেক ব্যবসাসফল ছবির পরিচালক বাদল খন্দকার। বেশ কিছু ছবি প্রযোজনা ও প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র প্রদর্শন ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ২০০৬ সালে ইলিয়াস কাঞ্চন-চম্পা ও রিয়াজ-পপি অভিনীত ‘বিদ্রোহী পদ্মা’ মুক্তির পর আর কোনো ছবি নির্মাণ করেননি। চলচ্চিত্রকে বিদায় জানিয়েছেন। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট কোনো আড্ডায় এখন আর দেখা যায় না তাঁকে। দীর্ঘ সময় অনুপস্থিত চলচ্চিত্র অঙ্গনে। এ পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছেন আনোয়ার পারভেজ

কেমন আছেন, কী করছেন একসময়ের ব্যবসাসফল ছবির চলচ্চিত্র পরিচালক বাদল খন্দকার? সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে দেখা হয়, সমসাময়িক কালের চলচ্চিত্র, দীর্ঘ সময় চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরে থাকা, চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, শাবনূরের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন, রাজনীতিতে জড়ানোসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।  শিগগিরই চলচ্চিত্র নির্মাণে ফেরার প্রস্তুতির কথাও জানান। চলচ্চিত্রের নানা বিষয় উঠে এসেছে আলাপচারিতায়।

প্রথম আলো :

‘বিদ্রোহী পদ্মা’র পর দীর্ঘ সময় পরিচালনায় নেই কেন?

বাদল খন্দকার: জনপ্রিয় নাট্যকার আসকার ইবনে শাইখের গল্প অবলম্বনে ২০০৬ সালে নির্মিত ‘বিদ্রোহী পদ্মা’ ছবিতে পদ্মা নদীর পানির হিস্যা নিয়ে রাজনীতি ছাড়াও সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সামাজিক বার্তা ছিল। এরপর চলচ্চিত্রে অশ্লীল ছবির আগ্রাসন ভয়ংকর হলে নিজেকে ছবি পরিচালনা থেকে গুটিয়ে নিলাম। জীবন–জীবিকার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করেছি। উত্তরবঙ্গ থেকে সবজি কিনে কারওয়ান বাজারে নিয়ে বিক্রি করেছি। পরে কুড়িগ্রামে অটোরাইস মিল দিয়েছি। ৫০০ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

প্রথম আলো :

আপনার পরিচালনায় অনেক বাণিজ্যিক সফল সিনেমার নায়িকা শাবনূর। জানতে চাই, তাঁকে কীভাবে খুঁজে পেয়েছিলেন?

বাদল খন্দকার: নায়িকা গড়ার কারিগর এহতেশাম ‘চাঁদনী রাতে’ নির্মাণের সময় শাবনূরকে তিনি আমার সঙ্গে পরিচয় করে দিলেন। ছবিটি ফ্লপ হলো। এরপর শাবনূরকে ‘দুনিয়ার বাদশা’ নির্মাণ করলাম। রাতারাতি শাবনূর তারকা খ্যাতি পেলেন। পরে সালমান শাহ-শাবনূরকে নিয়ে ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ নির্মাণ করলাম। সালমান-শাবনূর জুটি নিয়ে ‘মধুর মিলন’, ‘পৃথিবী তোমার আমার’, ‘সাগরিকা’সহ আরও ছয়টি ছবি নির্মাণের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু সালমান শাহর মৃত্যুর পর শাবনূরের সঙ্গে অন্য নায়ককে নিতে হয়েছে।

প্রথম আলো :

চলচ্চিত্র পরিচালনায় আসার শুরুর দিনগুলো মনে পড়ে?

বাদল খন্দকার: আমার জন্ম ১৯৫৮ সালের ২৭ জুন উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের রাজারহাটে। শৈশব কেটেছে লালমনিরহাটে। রংপুর কারমাইকেল কলেজে পড়ালেখার সময় বাহে নামের একটি নাট্য সংগঠন করতাম। এরপর পড়ালেখার উচ্চ স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হই। প্রতিবাদী স্বভাব থেকেই ছাত্রলীগে (জাসদ) যোগ দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষের কথা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণকারীদের কাছে পৌঁছে দিতে পারব। কিন্ত রাজনীতিতে বেশি দিন নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারিনি। নাটকের প্রতি ঝোঁক থেকেই একদিন খ্যাতিমান চিত্রপরিচালক মমতাজ আলীর সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি তখন ‘ঈমান’ ছবির শুটিংয়ের প্রস্ততি নিচ্ছিলেন। ‘ঈমান’-এর ইউনিটে সহকারী পরিচালক হিসেবে থাকার প্রস্তাব দিলেন। বাড়তি রোজগারের আশায় রাজি হলাম।

পরিচালক বাদল খন্দকার
প্রথম আলো

প্রথম আলো :

সহকারী পরিচালক হিসেবে প্রথম ছবিতে কত টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন?

বাদল খন্দকার: ‘ঈমান’ ছবি মুক্তির পর তৃতীয় সহকারী হিসেবে ৪০০ টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলাম। এরপর ‘কুদরত’, ‘নালিশ’, ‘নসীব’, ‘উসিলা’তেও তাঁর সহকারী পরিচালক ছিলাম।  মিঠুন চক্রবর্তী এবং রোজিনাকে নিয়ে ভারতের শক্তি সামন্ত যৌথ প্রযোজনায় ‘অবিচার’ নির্মাণের সময় সহকারী পরিচালক হিসেবে সুযোগ দিলেন। এরপর চাষী নজরুল ইসলাম, আজিজুর রহমান, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মতো খ্যাতিমান পরিচালকদের সহকারী হিসেবে বেশ কিছু ছবিতে কাজ করলাম। ববিতা প্রযোজিত পাকিস্তান ও নেপালের সঙ্গে যৌথ চলচ্চিত্র ‘লেডি স্মাগলার’ এ পাকিস্তানের পরিচালক শামিম আরার সহকারীও ছিলাম। বোম্বেতে শক্তি সামন্ত ও সঞ্জয় লীলা বানসালির সঙ্গেও ‘অনুরাধা’ ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ করি। একসময় সিনেমা পরিচালনার কথা ভাবলাম। কিন্ত লগ্নি করবেন কে? পরিচালনার চিন্তা ঝেড়ে ফেলে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হলাম। শাবনাজ-নাঈমের ‘চাঁদনী’ মুক্তির পর রাতারাতি চলচ্চিত্রে নতুন এক ধারা তৈরি হলো। প্রেমের গল্প নিয়ে ছবি নির্মাণের হিড়িক পড়ে গেল।  সালমান শাহ, মৌসুমী, শাবনূর, ওমর সানী, আমিন খান ছাড়াও একঝাঁক সম্ভাবনাময় নতুন মুখ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হলো। তখন সিলেটে নুরজাহান নামের এক তরুণী ফতোয়াবাজির শিকার হলেন। সমসাময়িক বাস্তব সেই কাহিনি নিয়ে ‘দুনিয়ার বাদশাহ’ ছবিটি প্রথম নির্মাণ করলাম। শাবনূর-আমিন খান অভিনীত সেই ছবি ভালো ব্যবসা করল। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে নির্মাণ করলাম শাবানা-জসিম অভিনীত ‘বিশ্বনেত্রী’। এরপর সালমান শাহ-শাবনূরকে নিয়ে নির্মিত ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ সুপার ডুপার হিট হলো। সালমান শাহর সঙ্গে আরও ছয়টি সিনেমা নির্মাণের জন্য চুক্তি হয়েছিল। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে সব পরিকল্পনা লন্ডভন্ড হলো। সালমানকে  ছয়টি ছবির জন্য সাইনিং মানি দিয়েছিলাম। তাঁর মৃত্যুতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়লাম। ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে শাবনূর-ওমর সানীকে নিয়ে ‘মধুর মিলন’, রিয়াজ–শাবনূরকে নিয়ে ‘পৃথিবী তোমার আমার’, হেলাল খান-ঋতুপর্ণাকে নিয়ে ‘সাগরিকা’,  রিয়াজ-পপিকে নিয়ে ‘প্রেম করেছি বেশ করেছি’, মৌসুমী-ফেরদৌসকে নিয়ে ‘মিস ডায়না’, মান্না-মৌসুমীকে নিয়ে ‘আবার একটি যুদ্ধ’ এবং সর্বশেষ ২০০৬ সালে রিয়াজ-পপিকে নিয়ে ‘বিদ্রোহী পদ্মা’ নির্মাণ করলাম। সব কটি ছবি ছিল ব্যবসাসফল।

আরও পড়ুন

প্রথম আলো :

‘স্বপ্নের পৃথিবী, ‘মধুর মিলন’ ও ‘পৃথিবী তোমার আমার’ মুক্তির পর শাবনূরকে আর আপনার ছবিতে দেখা যায়নি। কেন?

বাদল খন্দকার: ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ মুক্তির পর সালমান শাহ-শাবনূরকে নিয়ে আরও ছয়টি ছবি নির্মাণের কথা ছিল। সালমান শাহর মৃত্যুর পর সব পরিকল্পনা লন্ডভন্ড হয়। পরে শাবনূর-ওমর সানীকে নিয়ে ‘মধুর মিলন’, শাবনুর-রিয়াজকে নিয়ে ‘পৃথিবী তোমার আমার’ নির্মাণ করলাম। ব্যক্তিগত বিশেষ কারণে শাবনূরের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হলে তাঁকে নিয়ে আর ছবি নির্মাণ করা হয়নি। এর মধ্যে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার কালো থাবা শুরু হলো। নিজেকে গুটিয়ে নিলাম।

প্রথম আলো :

শাবনুর-রিয়াজ ‘পৃথিবী তোমার আমার’ ছবি মুক্তির পর ‘নিশ্বাস ধীরে ধীরে বাড়ছে’ গানটিতে তো অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছিল সে সময়ে। ‘মধুর মিলন’ ছবিতে ‘প্রেমের খেলা হোক শুরু’, ‘একটু আরও কাছে আস না’ বৃষ্টির গানেও শাবনূরকে অশ্লীলভাবে উপস্থাপনের অভিযোগ উঠেছিল।

বাদল খন্দকার: ওই সময়টাতে অশ্লীল ও রুচিহীন চলচ্চিত্র নির্মাণের হিড়িক পড়ে। কোনো কোনো ছবিতে কাটপিসও জোড়া লাগানো হয়। রুচিশীল চলচ্চিত্র নির্মাণ চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছিল। ছবির লগ্নি তুলতে এবং চলচ্চিত্রে বাণিজ্যিক ধারা ঠিক রাখতে শাবনূর-রিয়াজকে নিয়ে ‘পৃথিবী তোমার আমার’ ছবির গানটিতে আবেগঘন কিছু দৃশ্য রাখা হয়েছিল।পরে ‘মধুর মিলন’ ছবিতে ওমর সানীর সঙ্গে একটি গান ছিল শাবনূরের।  ক্ল্যাসিক্যাল খোলামেলার এই গান সেন্সর বোর্ডও আটকায়নি। তবে ছবি মুক্তির পর কেউ কেউ গান দুটির বিরুদ্ধে অশ্লীলতার তকমা জুড়িয়ে দেন। কারণ, তাঁরা বাদল খন্দকার বা শাবনূরের কাছে এটা আশা করেননি। শাবনূরকে দর্শকের কাছে ওই রকম খোলামেলাভাবে উপস্থাপন না করলে বা বাণিজ্যিক আর্ট রিয়াজ-শাবসূর জুটি হারিয়ে যেত।

পরিচালক বাদল খন্দকার
প্রথম আলো

প্রথম আলো :

শাবনূর তো চলচ্চিত্রে ফিরছেন। তাঁকে নিয়ে সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা আছে?

বাদল খন্দকার: ঢাকার চলচ্চিত্রে বর্তমানে নায়িকার সংকট প্রকট। এখন যাঁরা আছেন, তাঁদের দিয়ে সিনেমা হলে দর্শক টানা সম্ভব নয়। একসময় কবরী, শাবানা, ববিতা, শবনম, শাবনূর, মৌসুমী, পূর্ণিমাকে দেখেই দর্শক হলে গেছেন। এখন সিনেমা হলে দর্শক টানার মতো নায়িকা কই? বেশির ভাগ নায়িকা বিবাহিত। নায়িকা বলার মতো ফিগারও নেই। পূঁজা চেরির মতো দু–একজন থাকলেও তাঁদের অভিনয়ে অপরিপক্ব মনে হয়। চলচ্চিত্রশিল্প বাঁচাতে নতুন নায়ক-নায়িকার সন্ধান করতে হবে। শাবনূরকে নিয়ে তো টিনএজ প্রেমের গল্পের সিনেমা বানানো সম্ভব নয়, বৈচিত্র্যময় চরিত্রে তাঁকে নিতে হবে। শাবনূরকে উপস্থাপনের মতো ভালো গল্প পেলে ভবিষ্যতে তাঁকে নিয়ে অবশ্যই সিনেমা বানানোর কথা চিন্তা করব।

প্রথম আলো:

কতগুলো চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন?

বাদল খন্দকার: এককভাবে ১৬টি এবং যৌথভাবে ২৫-২৬টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছি।

প্রথম আলো :

এখন যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে, তার সঙ্গে নব্বইয়ের দশকের চলচ্চিত্রের পার্থক্য খুঁজে পান?

বাদল খন্দকার: দেশীয় চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল নবাব পরিবার থেকে। শুরুর দিকে চলচ্চিত্রের দর্শকও ছিলেন শিক্ষিত ও সুশীল শ্রেণি। যত্নের অভাবে সেই দর্শক ধরে রাখা যায়নি। এখন সুশীল শ্রেণির দর্শকেরা খুব একটা সিনেমা হলে আসেন না। দর্শকের রুচির পরিবর্তনের কারণেই গল্পেও পরিবর্তন এসেছে। তবে ভালো গল্প নেই, অভিজ্ঞ ও মেধাবী নির্মাতার অভাব, জনপ্রিয় জুটি নেই, ভালো নায়ক-নায়িকার সংকট, ভালো গীতিকার ও সংগীত পরিচালকও চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ছবি প্রদর্শনে নেই পর্যাপ্ত প্রেক্ষাগৃহ। দেশীয় চলচ্চিত্র এখন একনায়কনির্ভর হয়ে পড়েছে । এক শাকিব খান দীর্ঘ সময় ধরে গোটা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে ধরে রেখেছেন। মেধাবী পরিচালক, শিল্পমনা ভালো প্রযোজকের অভাবে চলচ্চিত্রে সংকট বিরাজ করছে। আজিম-সুজাতা, রহমান-শবনম, রাজ্জাক-কবরী, আলমগীর-শাবানা, ফারুক-ববিতা, সোহেল রানা-ববিতা, ওয়াসিম-রোজিনা, ইলিয়াস কাঞ্চন-চম্পা, ওয়াসিম-অঞ্জু, মান্না-চম্পা, শাবনাজ-নাঈম, সালমান শাহ-মৌসুমী, শাবনূর-রিয়াজ, ওমর সানী-মৌসুমীর মতো সফল জুটি তৈরি হচ্ছে না। চলচ্চিত্রে সংকট কাটাতে নতুন জুটি প্রয়োজন। এ জন্য নতুন মুখ খুঁজতে হবে। সরকারি উদোগে প্রতিটি জেলায় সিনেপ্লেক্স নির্মাণ করতে হবে। চলচ্চিত্রে সুদিন ফেরাতে একনায়কনির্ভরতা কমাতে হবে। ভালো ছবির জন্য সময়োপযোগী গল্প লাগবে।

‘স্বপ্নের পৃথিবী’ ছবিতে সালমান শাহ ও শাবনুর। ছবি: সংগৃহীত

প্রথম আলো :

সাম্প্রতিক সময়ে ‘হাওয়া’, ‘পরাণ’, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘প্রিয়তমা’, ‘রাজকুমার’–এর মতো সিনেমা তো দর্শকনন্দিত হয়েছে। দেখেছিলেন?

বাদল খন্দকার: হ্যাঁ দেখেছি। গত ঈদুল ফিতরেও সিনেপ্লেক্সে বসে শাকিব খানের ‘রাজকুমার’ দেখেছি। শাকিব খান অসাধারণ অভিনেতা। কিন্ত আমি মনে করি, ছবিটি দর্শকদের প্রত্যাশিত বিনোদন দিতে পারেনি। একমাত্র ‘প্রিয়তমা’ দুর্দান্ত দর্শকনন্দিত হয়েছে। ভালো গল্প, শ্রুতিমধুর গান এবং শাকিব খান ও রাধিকা পালের অনবদ্য অভিনয় দর্শকদের মনে ধরেছে। ‘প্রিয়তমা’র মতো দু–একটি ছাড়া এখন যেসব ছবি নির্মিত হচ্ছে, বেশির ভাগই সিনেমা হলে চলার মতো চলচ্চিত্র নয়, ওটিটির জন্য নির্মিত কনটেন্ট। ‘হাওয়া’, ‘আয়নাবাজি’র মতো কনটেন্ট দিয়ে ওটিটিতে আয় বাড়ানো সম্ভব, কিন্ত দেশীয় চলচ্চিত্রের সুদিন ফেরানো সম্ভব নয়। এসব কনটেন্টকে ছায়াছবি বলা ভুল হবে।

প্রথম আলো:

ভালো গল্প হলেই কি দর্শক সিনেমা হলে ফিরবেন?

বাদল খন্দকার: নন্দিত পরিচালক প্রয়াত দিলীপ বিশ্বাসের সহকারী ছিলাম। ‘অনুরোধ’ সিনেমায় গল্পের প্রয়োজনে একটি দৃশ্যে নায়করাজ রাজ্জাকের গালে থাপ্পড় মেরেছিলেন চিত্রনায়ক উজ্জল। ছবি মুক্তির পর সিনেমা হলে থাপ্পড় মারার এ দৃশ্য দেখে দর্শকেরা পর্দায় ঢিল ছুড়েছেন, পরিচালককে গালি দিয়েছেন। এটাই দর্শকের আবেগ। সময়ের সঙ্গে দর্শকের রুচির পরিবর্তন হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তি পাওয়া ‘পরাণ’ ছবিতে নায়িকাকে নেতিবাচক দর্শকেরা উপভোগ করেছেন। আসলে এ প্রজন্মের দর্শকের কাছে প্রেমের ব্যাখ্যা বদলে গেছে। আঙুল কেটে একজনের জন্য চিঠি লেখা, বছরের পর বছর অপেক্ষা করার যুগ আর নেই। হাতে মুঠোফোন, প্রযুক্তি। ভিনদেশি সংস্কৃতিতে ঝুঁকছে এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। দর্শকের আবেগের ভাষা বুঝে ছবি নির্মাণ করতে পারলেই তা সুপারহিট। সত্তরের দশকে সাহিত্যনির্ভর ও মৌলিক গল্পনির্ভর ছবি পছন্দ করতেন দর্শকেরা, আশির দশকে ফোক ফ্যান্টাসি, আবার নব্বইয়ের দশকে টিএনএজ প্রেমকাহিনিনির্ভর ছবির অন্যরকম বাজার ছিল। ২০২৪ সালে এসে নব্বইয়ের দশকের গল্প নিয়ে ছবি নির্মাণ করলে দর্শক হলে আসবেন না। দর্শককে হলে আনতে হলে সময়োপযোগী ভালো গল্প নিয়ে ছবি নির্মাণ করতে হবে। ভালো অভিনয়শিল্পী, শ্রুতিমধুর গান, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও ছবিতে থাকতে হবে। ভালো ছবি নির্মাণে বড় বাজেট প্রয়োজন। লগ্নি তুলতে জেলা-উপজেলা, শহর-বন্দরে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা বাড়াতে হবে। শুধু সিনেপ্লেক্স নয়, সব শ্রেণির দর্শকের জন্য সিনেমা হল নির্মাণ করতে হবে। ‘জীবন থেকে নেওয়া’, ‘অবুঝ মন’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ গল্পনির্ভর পরিপূর্ণ  ছায়াছবি। ফলে এসব ছবি এখনো দর্শকের হৃদয়ে গেঁথে আছে।

প্রথম আলো :

‘হাওয়া’ তো দর্শকনন্দিত হয়েছে।

বাদল খন্দকার: কাল্পনিক কিংবা লোককাহিনি নিয়ে নির্মিত ছবিও একসময় সুপারহিট হয়েছে। কারণ, তখন দেশে ১ হাজার ৪০০ সিনেমা হল ছিল। তরুণ বয়সী ছাড়াও শহরের শ্রমজীবী, কুলি–মজুর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জের কৃষক, শ্রমিক, বধূরাও সিনেমা হলে বসে ছবি দেখতেন। পাকিস্তানের উর্দু ছবির সঙ্গে যখন দেশীয় চলচ্চিত্র বাণিজ্যিকভাবে টিকে থাকতে পারছিল না, তখন ইবনে মিজানের মতো পরিচালকেরা ফোক ফ্যান্টাসি সিনেমা তৈরি করে ভিনদেশি সংস্কৃতিকে হটিয়ে দিয়েছিলেন। ইবনে মিজানের ফোক ফ্যান্টাসি ছবি প্রচুর ব্যবসা করেছে। ‘রূপবান’, ‘রাখাল বন্ধু’, ‘লাইলী মজনু’, ‘রসের বাঈদানী’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র মতো ফোক ফ্যান্টাসি ছবি দেখতে প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের ঢল নেমেছে। এখন মাল্টিপ্লেক্সে ফোক ফ্যান্টাসির ছবি দেখতে নিম্ন আয়ের দর্শক আসবেন না। ভালো সিনেমায় ভালো গল্প থাকবে, নিজস্ব সংস্কৃতি থাকবে, বিনোদন থাকবে, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে বসে ছবি দেখার মতো দর্শক থাকতে হবে।

প্রথম আলো:

চলচ্চিত্র নির্মাণে ফিরছেন?

বাদল খন্দকার: দীর্ঘ সময় চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরে ছিলাম। ব্যবসা ও পরিবার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কুড়িগ্রামে অটোরাইস মিল দিয়েছি। মাঝখানে রাজনীতিতেও সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিলাম।  জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের উপদেষ্টাও ছিলাম। পর্যটন করপোরেশনের পরিচালকও ছিলাম। তবে চলচ্চিত্রের স্মৃতি পিছু ছাড়েনি। ঘুমের ঘোরেও ‘অ্যাকশন’, ‘কাট’ বলেছি। চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা থেকেই পরিচালনায় ফিরছি শিগগির। চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা থেকেই সৃজনশীল ও অভিজ্ঞ পরিচালক থেকে শুরু করে সবার এগিয়ে আসা দরকার। মডেল তিন্নিকে নিয়ে মাঝখানে ‘বৃষ্টির চোখে জল’ নামের ছবি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। রাজ্জাক, উজ্জল ও আলমগীরকে নিয়ে ছবিটি নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু পরে সেই উদ্যোগ আর এগোয়নি। ‘স্বপ্নের পৃথিবী’র নায়িকা শাবনূরও দীর্ঘ বিরতির পর অভিনয়ে ফিরেছেন। তাঁর  ফেরাটা চলচ্চিত্রে নতুন করে আশা জাগাচ্ছে। শিগগিরই  নতুন মুখ নিয়ে প্রেমকাহিনিনির্ভর একটি ছবি নির্মাণের ইচ্ছা আছে। এ মুহূর্তে তিন-চার কোটি টাকা খরচ করে ছবি নির্মাণ করে লগ্নি ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। বড় বাজেটের ছবি চালানোর জন্য পর্যাপ্ত হল নেই। আপাতত একটি নির্মল প্রেমের গল্প নিয়ে কম বাজেটে ছবি নির্মাণ করব। সেখানে শক্তিশালী গল্পের পাশাপাশি শ্রুতিমধুর গান থাকবে, সব শ্রেণির দর্শকদের জন্য পরিপূর্ণ বিনোদন থাকবে। এরপর বড় বাজেটে ছবি নির্মাণের কথা ভাবব।  

প্রথম আলো :

আপনি কি আশা করছেন চলচ্চিত্রে সুদিন ফিরবে? কীভাবে?

বাদল খন্দকার: মেধাবী গল্পকার, মেধাবী পরিচালক, সংস্কৃতমনা প্রযোজক, মেধাবী ক্যামেরাম্যান, মেধাবী মেকআপম্যান থেকে শুরু করে মেধাবী ও দক্ষ মেকিং টিম লাগবে। দর্শকনন্দিত হয় এমন ছবি নির্মাণের জন্য ভালো নায়ক-নায়িকা লাগবে। দেশে ১ হাজার ৪০০ সিনেমা হল ছিল। সিনেমা হলের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ভালো গল্পের ছায়াছবি বছরে এক–দুটি নির্মিত হলে সিনেমা হল টিকে থাকবে কীভাবে? নানা স্বাদের গল্পের ছবি তৈরি করতে হবে। ‘চাঁদনী’র মাধ্যমে বাংলা সিনেমায় টিনএজ কাহিনিনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণের হিড়িক পড়েছিল। সিনেমায় বাস্তব গল্পকেও তুলে ধরা সম্ভব। তবে সেই গল্পে সমাজের চারপাশের পরিচিত মানুষের গল্প থাকতে হবে। আবারও বলছি, সিনেমা হলে দর্শক ফেরাতে হলে জেলা–উপজেলায় সিনেপ্লেক্স ও আধুনিক হল নির্মাণ করতে হবে। মাল্টিপ্লেক্স বেশি করে গড়ে তুলতে হবে। সরকারি উদ্যোগে ৬৪ জেলায় একটি করে মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণ করতে হবে। ৩০০ টাকা টিকিট কেটে সিনেমা হলে কেউ যাবেন না। বেশি ছবি নির্মাণের পাশাপাশি হলের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বেশি হল নির্মিত হলে, ভালো গল্পের সিনেমা তৈরি হলে দর্শক হলে ফিরবেন।  ভালো নির্মাতাদের এ শিল্পে ফেরাতে হবে। মাল্টিপ্লেক্সে চলার উপযোগী সিনেমা বানাতে হবে।