হাতির বাচ্চাটার কথা মন থেকে সরিয়ে দিতে পারছি না: জয়া আহসান

জয়া আহসানকোলাজ
রেললাইনের পাশে আপনমনে খাবার খাচ্ছিল দুটি হাতি। পেছন থেকে হঠাৎ বেজে ওঠে ট্রেনের হুইসেল। এতে ছোট হাতিটি রেললাইনের ওপর উঠে আসে। ভয়ে সোজা রেললাইন ধরে হাঁটতে থাকে প্রাণীটি। কিছুদূর যেতেই ট্রেনের ধাক্কায় হাতিটির মৃত্যু হয়। গত বুধবার দুপুরে রাজধানীর উত্তরার কোর্টবাড়ি লেভেল ক্রসিং এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনা স্মরণে আবারও ক্ষোভ প্রকাশ করে আজ মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন দুই বাংলার জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসান। তাঁর লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো—

এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল; কিন্তু উত্তরায় বেঘোরে মারা পড়া হাতির বাচ্চাটার কথা মন থেকে কোনোভাবেই সরিয়ে দিতে পারছি না। সেই কিশোরী বেলা থেকে হাতি আমার মনোরম কল্পনার প্রাণী। শুধু আমার কেন? হাতির বাচ্চাকে যে ভালোবেসে বড় হয়নি?

কোনো প্রাণীকে দেখে আমরা ভয় পাই, কোনো প্রাণীর সৌন্দর্যে বিস্মিত হয়ে থাকি। কিন্তু হাতি? হাতি তো সব সময়ই আমাদের প্রাণী। হাতির বাচ্চা তো আরও। রূপকথায়, মেঘের আকারে, অ্যানিমেশনে বন্ধু হিসেবে হাতিকে মনের রঙিন কল্পনায় মধ্যে জায়গা দিতে দিকে আমরা বড় হয়েছি।

এমন একটি আদুরে হাতির বাচ্চা কী মর্মান্তিকভাবেই না মারা পড়ল ১৭ মে। উত্তরায় রেললাইনের পাশে মা হাতির সঙ্গে বাচ্চাটিও কলাগাছ খাচ্ছিল। এমন সময় ট্রেন এসে পড়ে। ট্রেনের চালক কাওছার হোসেন বলেছেন, ১০০ মিটার দূরে থাকতে হাতিটি তাদের নজরে আসে। তখন তাঁরা হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন থামানোর চেষ্টা করেন। ট্রেন থামতে ২০০ থেকে ৩০০ মিটার জায়গা লাগে। ফলে দুর্ঘটনাটি এড়ানো যায়নি। হুইসেলের শব্দে হাতির শাবকটি ভয় পেয়ে দৌড় দিতে শুরু করে। কিন্তু যন্ত্রসভ্যতার আইনকানুন বেচারা জানবে কোত্থেকে? সে দৌড়াতে শুরু করে রেললাইনেরই ওপর দিয়ে। ট্রেন ওর ওপরে এসে পড়ে। ওকে হিঁচড়ে নিয়ে যায় বহুদূর পর্যন্ত। শহরে অচেনা এই আগন্তুক লাশ হয়ে যায়। ট্রেনচালক কাওছার হোসেন প্রশ্ন করেছেন, ‘বন্য প্রাণী কেন রেললাইনে থাকবে? হাতির তো লোকালয়ে আসারই কথা নয়।’ এটা আমাদেরও প্রশ্ন।

যার ঘুরে বেড়ানোর কথা অরণ্যের সবুজে, ওর আপন পৃথিবীতে, সে কেন ওর অচেনা লোকালয়ে আসবে? আইইউসিএস বলছে, এশিয়ান হাতি তাদের লালতালিকায় থাকা মহাবিপদাপন্ন প্রাণী। যত্ন না নিলে ম্যামথের মতো একদিন হারিয়ে যাবে তারা। হাতি টিকে থাকবে শুধু গল্পগাথার অস্পষ্ট স্মৃতির ভেতরে। তেমন পৃথিবীই কি আমরা চাই?
হাতি লোকালয়ে আসছে তার পেছনে আছে বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২–এর ২ উপধারা। সেখানে বলা হয়েছে, সনদ নিয়ে হাতি লালনপালন করা যাবে। তবে সনদ নেওয়ার আগে নিশ্চিত হতে হবে পালনকারীর হাতি পালন করার মতো পর্যাপ্ত জ্ঞানগম্যি এবং হাতির বেঁচে থাকার মতো পুরো সুযোগ–সুবিধা দেওয়ার সক্ষমতা আছে। তাই নাকি? সনদ দেওয়ার পরে কী হবে?

মারা যাওয়ার পর হাতিটি রেললাইন থেকে সরিয়ে পাশের খোলা জায়গায় রাখা হয়। বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর উত্তরার কোর্টবাড়ি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

এই যে হাতি হাতবদল হয়ে যাচ্ছে, শারীরিক যন্ত্রণা দিয়ে ওদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, চাঁদা তোলার কাজে শহরের প্রতিকূল রাজপথে চরিয়ে বেড়ানো হচ্ছে, সেটা কে দেখবে? এসব দৃশ্য তো আমরা চলতে–ফিরতে হরহামেশা দেখতে পাচ্ছি। দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের কি মোটেই চোখে পড়ছে না? তাঁরা কি ঠিকমতো সনদ দিচ্ছেন? সনদ দেওয়ার পর কি আদৌ খোঁজ করে দেখছেন, নিয়ম পালিত হচ্ছে কি না? হচ্ছে যে না, পথে পথে আমাদের নিজ চোখে দেখা অভিজ্ঞতাই তার প্রমাণ। আমাদের গাফিলতিই অবশেষে এই হাতির মৃত্যুর কারণ হলো। দুর্ঘটনা একটা ছুতো মাত্র।

বন্য প্রাণীদের নিয়ে পৃথিবীজুড়ে ভাবনা বদলে যাচ্ছে। আমরা কি একগুঁয়ের মতো পৃথিবীর বাইরে থাকতে চাই? মহাবিপদাপন্ন একটি প্রাণীকে কোনোভাবেই আমরা তাদের নিজস্ব পরিবেশের বাইরে এনে আটকে রাখতে পারি না। তাই এই আইনটি এখন বাতিল করার সময় এসেছে। এ ব্যাপারে আওয়াজ তোলার জন্য আমি দেশের প্রাণিবিদদের, প্রাণী অধিকারকর্মী আর সব সংবেদনশীল মানুষকে অনুরোধ করছি।
আরও একটি কথা বলা দরকার।

জয়া আহসান
কোলাজ

মাঝেমধ্যেই আমরা হাতি আর মানুষের সংঘর্ষের কথা শুনছি। এর জের পড়ছে দুই দিকেই। মানুষও ক্ষতির শিকার হচ্ছে, মারা পড়ছে হাতিও। অথচ এর মূল দায় তো আমাদেরই। আমরা বন উজাড় করছি। হাতির বুনো চলাচলের পথ বন্ধ করে আবাস করছি। হাতির বেঁচে থাকার কোনো জায়গাই অবশিষ্ট রাখছি না। পৃথিবীর বিচিত্র প্রাণসত্তার রঙিন সৌন্দর্য টিকে থাকবে কিনা, সেটা নির্ভর করছে আমাদের দয়ার ওপর। আমাদের দয়ামায়া কি সব কর্পূরের মতো উবে গেল?

আরও পড়ুন