৭ কারণে আলোচনায় ঈদের সিনেমা
হলে টিকিট–সংকট। ছুটির দিনে বন্ধুবান্ধব নিয়ে পরিকল্পনা করেও টিকিট মিলছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সিনেমা নিয়ে বিস্তর আলোচনা। কার কোনটি ভালো লেগেছে, কেন লেগেছে; সেসব নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কিন্তু কেন ঈদের সিনেমা নিয়ে এই আলোচনা? সিনেমাগুলোতে এমন কী আছে, যা দর্শকদের আকৃষ্ট করছে। জেনে নেওয়া যাক সম্ভাব্য সাত কারণ।
বিষয়বৈচিত্র্য
ব্যাড প্যারেন্টিং নিয়ে বাংলা সিনেমা হচ্ছে! শুনতে অবাক লাগলেও এবার এটিই হয়েছে। ঈদে মুক্তি পাওয়া এম রাহিমের ‘জংলি’র মূল সুর গুড প্যারেন্টিং, ব্যাড প্যারেন্টিং। এবারের ঈদে মুক্তি পাওয়া দুটি সিনেমায় (‘জংলি’ ও ‘দাগি’) এসেছে ‘গুড টাচ, ব্যাড টাচ’ প্রসঙ্গ। খেলোভাবে নয়, বরং নির্মাতারা যথাযথভাবেই শিশুদের গুড টাচ, ব্যাড টাচ নিয়ে বার্তা দিয়েছেন। কেবল প্রেম, অ্যাকশন আর প্রতিশোধ নয়, ঈদের সিনেমাগুলো বিষয়বৈচিত্র্যের কারণে বেশি মানুষের গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। গত ৯ এপ্রিল ঢাকার একটি প্রেক্ষাগৃহে যখন ‘জংলি’ চলছিল, তখন গুড টাচ, ব্যাড টাচ প্রসঙ্গ আসতেই এই প্রতিবেদকের পাশে বসা এক অভিভাবক বলছিলেন, এই বিষয়টা তুলে আনা ভালো হয়েছে। স্ত্রী আর সন্তানকে নিয়েই সিনেমা দেখতে এসেছিলেন এই অভিভাবক।
ঈদে পরিবার নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে এসেছেন প্রচুর মানুষ, প্রতিবারই আসেন। তবে এবার আলাদা করে নজর কেড়েছে সিনিয়র সিটিজেনদের উপস্থিতি। গত ৭, ৮ ও ৯ এপ্রিল ঢাকার দুই মাল্টিপ্লেক্সে অনেক দাদা-দাদি, নানা-নানিদের দেখা গেছে। অসুস্থতা বা বার্ধক্যজনিত কারণে হয়তো ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না, তারপরও নাতি বা নাতনির কাঁধে ভর দিয়ে হাজির হয়েছেন হলে। বিষয়বৈচিত্র্য তাঁদের হলে টানতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে বলাই বাহুল্য।
ঈদের সিনেমার বাড়তি আকর্ষণ ছিল মার্ডার মিস্ট্রি। ঢাকাই সিনেমায় এ ধরনের সিনেমা খুব বেশি দেখা যায়নি। অ্যাকশন নেই কিন্তু রহস্য, রোমাঞ্চ, হাস্যরস আর অভিনয় মিলিয়ে ‘চক্কর’ নিয়ে তাই দর্শকের আগ্রহ ছিল। হুডানিট জনরার সিনেমাও ঈদে বাড়তি সংযোজন।
অন্য শাকিব
ঈদের সিনেমা নিয়ে দর্শক আগ্রহের অন্যতম কারণ নিঃসন্দেহে শাকিব খান। ‘প্রিয়তমা’ দিয়ে বলা যায় নতুন যাত্রা শুরু করেছেন তিনি। বারবার বদলেছেন নিজের লুক, ফিটনেস নিয়ে কাজ করেছেন, অভিনয় দক্ষতা শাণিত করেছেন। ফল, তাঁর তারকাখ্যাতি আরও বেড়েছে। গত তিন বছরে তাঁর সিনেমা, সিনেমার গান, টিজার, লুক নিয়ে অন্তর্জালে বিস্তর চর্চা হয়েছে।
এই আলোচনায় পাঁড় শাকিব-ভক্ত নন, এমন অনেকেও অংশ নিয়েছেন। নিজের শক্তিশালী ভক্তকুলের বাইরেও অন্যদের এই প্রশংসা পুরোটাই অর্জন করে নিয়েছেন শাকিব। এবার ঈদেও তিনি ‘বরবাদ’ দিয়ে বাজিমাত করেছেন। টিজার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, হলে তা পূরণ হয়েছে।
পার্শ্বচরিত্রের তারকারা
গত বছর ‘তুফান’-এ ছোট ছোট পার্শ্বচরিত্রে দেশের ঝানু সব চরিত্রাভিনেতাদের দেখা গেছে। এবার ঈদের বরবাদ, জংলি, দাগি, চক্কর-এও সেটা আছে। পার্শ্বচরিত্রগুলোতে মামুনুর রশীদ, শহীদুজ্জামান সেলিম, ফজলুর রহমান বাবু, ইন্তেখাব দিনার, নরেশ ভুঁইয়া, নাদের চৌধুরী, আইমন শিমলা, সুমন আনোয়ার, রাশেদ অপুদের উপস্থিতি সিনেমার অভিনয়-মান আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেকের চরিত্রের উপস্থিতি ছিল কম, কারও চরিত্র আরও ভালোভাবে লেখার অবকাশ ছিল; কিন্তু ঝানু এই শিল্পীরা পর্দায় নিজেদের অভিনয় ক্যারিশমা দিয়ে এসব খামতি পুষিয়ে দিয়েছেন।
পার্শ্বচরিত্রে এসব শিল্পীকে নিয়ে দর্শকদের আলাদা প্রত্যাশাও তৈরি হয়েছে। যেমন শহীদুজ্জামান সেলিম, সুমন আনোয়ার, রাশেদ অপুরা পর্দায় এলেই এবার কিছু হবে—এই আশায় নড়েচড়ে বসেছেন অনেক দর্শক।
জমজমাট গান
ঈদের সিনেমার মতো ঈদের সিনেমার গান নিয়েও কয়েক বছর ধরেই প্রবল আলোচনা। এবারের ঈদের সিনেমায়ও আইটেম, রোমান্টিক, স্যাড, র্যাপ, লোকসংগীত নানা ধাঁচের গান আছে। ‘চাঁদ মামা’, ‘দ্বিধা’, ‘মায়াবী’, ‘কন্যা’, ‘একটুখানি মন’, ‘নিয়ে যাবে কি’ ‘বন্ধুগো শোনো’, ‘কাউয়া কমলা’ ইত্যাদি গানগুলো কমবেশি আলোচনায় আছে। হাবিব ওয়াহিদ, তাহসান, প্রীতম হাসান, কনা, ইমরান, কোনাল থেকে মাশা ইসলামদের গানগুলো মানুষের মুখে মুখে ফিরছে।
টিকটক, ফেসবুক রিলস, শর্টসের কল্যাণে এসব গান সিনেমা মুক্তির আগেই হিট। উপমহাদেশের সিনেমায় গান বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ, এবারের ঈদে ঢাকাই সিনেমার ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে। নব্বইয়ের আলোচিত সুরকার প্রিন্স মাহমুদের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল ঈদের সিনেমায়। সবমিলে বেশ জমজমাট ছিল সিনেমার গান।
টিজার, ট্রেলারে মুনশিয়ানা
বাইরের দেশে সিনেমার টিজার, ট্রেলার, পোস্টার বা গান সবই মুক্তি দেওয়া হয় পরিকল্পিতভাবে। ঢাকার সিনেমায়ও এবার সেটা হয়েছে। একমাত্র ‘অন্তরাত্মা’ ছাড়া ঈদের সব সিনেমাই পরিকল্পিতভাবে ধাপে ধাপে গান, টিজার, ট্রেলার মুক্তি দিয়েছে। সিনেমা মুক্তির আগেই অন্তর্জালে এসব নিয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ চলেছে, সিনেমার গল্প কী হতে পারে, সেটা নিয়ে নানা ধরনের থিওরি তৈরি হয়েছে। মোটের ওপর মুক্তির এক মাস আগে থেকেই চর্চায় ছিল ঈদের সিনেমাগুলো, যা দর্শকদের আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
বুদ্ধিদীপ্ত নির্মাণ
‘গল্প ভালো; কিন্তু বানাতে পারে নাই’, আগে বাংলা সিনেমা দেখতে গেলে হরহামেশাই এমন কথা শুনতে হতো। কয়েক বছর ধরে অবস্থা বদলেছে। এবারের ঈদের সিনেমা দেখতে গিয়ে মনে হয়েছে, ঢাকাই সিনেমার নির্মাতারা আসলে বুঝতে পেরেছেন তাঁরা কী বানাতে চান। যেমন ‘বরবাদ’-এর কথাই বলা যাক।
নির্মাতা মেহেদী হাসান চেয়েছেন রুদ্ধশ্বাস এক অ্যাকশন সিনেমা দিয়ে দর্শকদের চমকে দেবেন, যেখানে অতি অবশ্যই প্রধান ভূমিকায় থাকবেন শাকিব; সেটা তিনি ভালোভাবেই পেরেছেন। ‘দাগি’ আবার ড্রামা ঘরানার। থ্রিলার, অ্যাকশনের বাইরে স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের সিনেমার দর্শক কিছুটা কম। কিন্তু জটিল এই ড্রামা দুর্দান্তভাবে পর্দায় তুলে এনেছেন শিহাব শাহীন। ‘জংলি’ বা ‘চক্কর’-এর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। নির্মাতাদের এই উত্তরণ অবশ্যই বড় সুখবর। অনেক দিন ধরেই বাণিজ্যিক সিনেমার নির্মাতার অভাবে ভুগছে ঢাকাই সিনেমা।
স্বস্তির খোঁজে
গত বছর ঈদুল আজহায় মুক্তি পাওয়া ‘তুফান’ তখনো হলে চলছে। এর মধ্যেই শুরু হয় জুলাই অভ্যুত্থান, তারপর রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অনেক দিন সিনেমা মুক্তি পায়নি। এরপর পেলেও সেভাবে দর্শক টানতে পারেনি। ঈদকে ঘিরে অনেক দর্শক আবার প্রেক্ষাগৃহে ফিরেছেন। রাজধানীর দুই মাল্টিপ্লেক্সে পাঁচ দর্শকের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের মধ্যে চারজনই জানান, গত বছর ঈদের পর এবারই তাঁরা হলে এসেছেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অনিশ্চয়তা পেছনে ফেলে ঈদ উৎসবে একটু স্বস্তির খোঁজে পরিবার নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে এসেছেন তাঁরা।