লেট দেয়ার বি লাইট: জহির রায়হানের অসমাপ্ত সিনেমাটি আলোর মুখ দেখবে?

ধর্ম, বর্ণ, জাতি ও সংস্কৃতির নামে বিশ্বজুড়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার মানুষের আর্তনাদ তুলে ধরে ১৯৭০ সালে ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ নির্মাণে হাত দেন কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, শুটিংয়ের মাঝখানে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় সিনেমার দৃশ্যধারণ আটকে থাকে। স্বাধীনতার পর মিরপুরে ভাইকে খুঁজতে গিয়ে তিনি শহীদ হওয়ার পর অসমাপ্ত সিনেমাটি আলোর মুখ দেখবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাড়ে তিন দশকেও অসমাপ্ত সিনেমার কোনো খবর ছিল না। দেড় দশক আগে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ৩৫ মিমিতে শুট করা কিছু ফুটেজ উদ্ধার করলে নতুন করে সম্ভাবনা উঁকি দিতে থাকে। জহির রায়হানের পরিবারের সদস্যরাও সিনেমাটি দর্শকদের দেখার উপযোগী করার চেষ্টা করেছে, তবে তা সম্ভব হয়নি।

জহির রায়হানের ৮৮তম জন্মদিনে তাঁর স্ত্রী সুচন্দা প্রথম আলোকে জানালেন, জহির রায়হান ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ সিনেমার চিত্রনাট্য লেখেননি, তাৎক্ষণিক চিন্তা থেকে সিনেমাটি নির্মাণ শুরু করেছিলেন। ফলে চিত্রনাট্য ছাড়া অসমাপ্ত সিনেমা সমাপ্ত করা খুব দুরূহ। তবুও তাঁরা সমাপ্ত করার চেষ্টা করে গেছেন, পারেননি।

জহির রায়হান

সরকারিভাবে চেষ্টা করলে সিনেমাটি আলোর মুখ দেখতে পারে বলে আশা করছেন সুচন্দা। তাঁর ভাষ্য, ‘কাজটি করতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অর্থ। চিন্তা করা খুব সহজ কিন্তু বাস্তবায়ন করতে অর্থ লাগে। চিত্রনাট্য না থাকলেও চেষ্টা করা যেতে পারে। জ্যেষ্ঠ পরিচালকদের নিয়ে বসে আলোচনার মাধ্যমে কাজটা করা যেতে পারে।’ এ অভিনেত্রীর অভিযোগ, শুধু ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ নয়, ‘জীবন থেকে নেয়া’সহ জহির রায়হানের অমলিন সৃষ্টিগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি।

এ সিনেমার বিষয়বস্তু নিয়ে চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ সিনেমায় ধর্মের নামে, বর্ণের নামে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো তুলে আনার কথা ছিল। সিনেমাটি বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ, রুশ ও উর্দু ভাষায় করার কথা ছিল।’

জহির রায়হানের অসমাপ্ত ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ ছবিতে

১৯৭০ সালে আগস্টের দিকে সিনেমার দৃশ্যধারণ শুরুর আগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সিনেমার মহরতে জহির রায়হান বলেছিলেন, ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ সিনেমাটি তাঁর সারা জীবনের স্বপ্নের ছবি। সেখানে নায়ক–নায়িকা হিসেবে ওমর চিস্তি ও অলিভিয়া গোমেজকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সেপ্টেম্বরে আরেক সংবাদ সম্মেলনে অলিভিয়ার বদলে ববিতাকে নিয়ে সিনেমাটি করার ঘোষণা দেন। শুটিং শুরু হওয়ার পর আনুমানিক ৪০ ভাগ কাজ শেষ হওয়ার পরই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। স্বাধীনতার পর জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার পর ছবিটিরও কোনো খোঁজ ছিল না।
সিনেমার ৩৫ মিমি ফুটেজ উদ্ধারের পর দেখা যায়, সেখানে ‘ওকে’ শটের পাশাপাশি ‘এনজি’ শটও ছিল; পরে ফিল্ম আর্কাইভের তত্ত্বাবধানে জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’–এর চিত্রসম্পাদক আবু মুসা দেবুকে দিয়ে ‘ওকে’ শটগুলো আলাদা করানো হয়। ‘এনজি’ শট বাদে পুরো ফুটেজের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৫৫ মিনিটের মতো। পরের তা ফিল্ম আর্কাইভে প্রদর্শনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও আর সম্ভব হয়নি।

ফিল্ম আর্কাইভের বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ফুটেজ দেখিনি। এটা দেখার মতো অবস্থায় আছে কি না, সেটা আমি জানি না। একবার এটা (সমাপ্ত করা) নিয়ে কথা হয়েছিল। মনে হয় না এটা সমাপ্ত করা সম্ভব হবে। কারণ, কথা হয়েছিল একটা লাইন আপ করে করব। কিন্তু আমি জানিও না কী অবস্থায় আছে।’

জহির রায়হান

ফিল্ম ইন্টারন্যাশনালের ব্যানারে এ সিনেমায় ওমর চিস্তি ও ববিতা ছাড়াও বনানী চৌধুরী, বকুল চৌধুরী, আমজাদ হোসেন, বিনয় বিশ্বাস, মাইকেল পিউরিফিকেশন, বদরুদ্দিনসহ আরও অনেকে অভিনয় করেছেন। পরিচালনার পাশাপাশি কাহিনি, চিত্রনাট্যেও ছিলেন জহির রায়হান। সংগীত পরিচালনা করেছেন খান আতাউর রহমান। সহযোগী পরিচালক ছিলেন ইলতুতমিশ, সহযোগী প্রযোজনায় হায়দার আলী।