৮ ছবি মুক্তির মাসে হল বন্ধের হিড়িক

লোকসানে টিকতে না পেরে একের পর এক সিনেমা হল থেকে আসছে বন্ধের ঘোষণাছবি: কোলাজ

ঈদুল আজহায় প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ছয়টি সিনেমা। এরপর গত তিন মাসে মুক্তি পেয়েছে নয়টি সিনেমা। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তির তালিকায় আছে আরও তিনটি ছবি। সব মিলিয়ে ঈদের পর এক ডজন ছবি মুক্তি পেলেও ঢালিউডের ‘ভাগ্যের চাকা’ ঘুরছে না। ঈদ–পরবর্তী কোনো সিনেমাই দর্শক টানতে পারেনি। সপ্তাহ তো দূরের কথা, এক দিনেই নেমে গেছে কয়েকটি সিনেমা। ব্যবসায়িক বিবেচনায় সব কটিই ফ্লপ। এ অবস্থায় লোকসানে টিকতে না পেরে একের পর এক সিনেমা হল থেকে আসছে বন্ধের ঘোষণা। এভাবে চলতে থাকলে ঢাকাই ছবির ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিচ্ছে শঙ্কা।

যশোরের ঐতিহ্যবাহী মণিহার
ছবি: প্রথম আলো

‘ঈদের পর নতুন ছবি মুক্তি পেয়েছে নাকি ভাই?’ প্রশ্নটা করলেন কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবের মধুমতি সিনেমা হলের মালিক সামিন সায়েক রহমান। শনিবার দুপুরে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, ঈদুল আজহার পর থেকে হলে পুরোনো ছবি চলছে। নতুন কোনো ছবির নাম তাঁর জানা নেই। নতুন ছবি মুক্তির বিষয়টি তাঁকে অবাকই করেছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, ঈদুল আজহার পর গত আগস্ট মাসে মুক্তি পায় দুই সিনেমা উড়াল ও জলরঙ। চলতি মাসে এখন পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে ৫টি সিনেমা। ডট, আমার শেষ কথা, নন্দিনী, বাড়ির নাম শাহানা ও ফেরেশতে। শেষ সপ্তাহে মুক্তির তালিকায় আছে তিনটি ছবি—মাকসুদ হোসাইনের সাবা, মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা ও এস এম শফিউল আযমের উদীয়মান সূর্য। মুক্তি পাওয়া কোনো ছবিই দর্শক টানতে পারেনি। মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ছবি নিয়েও সিনেমা হলমালিকদের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন

বন্ধ হচ্ছে হল
সম্প্রতি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে দেশের তিন হল—যশোরের মণিহার, বগুড়ার মধুবন ও কেরানীগঞ্জের লায়ন সিনেমাস। ক্রমাগত লোকসানে হলগুলো বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালিকপক্ষ। সামনের মাসগুলোতে আরও কয়েকটি হল বন্ধের ঘোষণা আসতে পারে।
বাংলাদেশের বৃহত্তম সিনেমা হল মণিহার ভেঙে ফেলে সেখানে মার্কেট করার পরিকল্পনা করছে মালিকপক্ষ। মণিহার সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালিকপক্ষ অনেক দিন ধরে হলটি ভাঙার পরিকল্পনা করছিল। আমরা বলে বলে এত দিন এনেছি। কিন্তু এখন চোখে অন্ধকার ছাড়া কিছুই নেই। এ মাস পর্যন্ত চিন্তাভাবনা করছে মালিকপক্ষ, এরপর এটি ভেঙে ফেলা হবে।’ চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য মালিকপক্ষ সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন বলে জানিয়েছেন ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘সাফটা চুক্তির আওতায় সিনেমা আমদানি না করতে পারলে হল টিকবে না। দুই ঈদ দিয়ে তো আর বছর চলে না। স্টাফের বেতন থেকে বিদ্যুৎ বিল—কোথা থেকে এনে দেব আমরা?’

গত মার্চে ময়মনসিংহের ‘পূরবী’ সিনেমা হল ভেঙে ফেলা হয়েছে
সংগৃহীত

বগুড়ার মধুবন সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ জানায়, দর্শক চাহিদা অনুযায়ী সিনেমার অভাব এবং সরকারের এই শিল্পের প্রতি অনীহার কারণে সামান্য দর্শক নিয়ে হল চালানো সম্ভব না। বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারীদের বেতন টানা সম্ভব হচ্ছে না। পর্যাপ্ত দর্শকের অভাবসহ নানা বাস্তব কারণে কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে তারা। হলটির মালিক রোকনুজ্জামান ইউনুস বলেন, ‘এ সিদ্ধান্ত নেওয়া আমাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টের। কারণ, সিনেমা হল কেবল একটি ব্যবসা নয়, এটি আমাদের আবেগের জায়গা। কিন্তু এভাবে তো ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যায় না। সিনেপ্লেক্স শুরুর পর খরচ অনেক বেড়েছে। তাই বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
রাজধানী ঢাকার অদূরে চারটি স্ক্রিন নিয়ে লায়ন সিনেমাসের যাত্রা শুরু হয় ২০২২ সালে। সিনেপ্লেক্সটির মালিক মির্জা আবদুল খালেকও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে হতাশ। বললেন, ‘আর পারছি না। কবে সিনেমা হলটি বন্ধ করব, সে অপেক্ষায় আছি। বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর তো কোনো উপায় দেখছি না। ভবিষ্যৎ দেখছি না। শিগগিরই সংবাদ সম্মেলন করে আমরা ঘোষণা দেব।’

আরও পড়ুন

ঢাকাই ছবির ভবিষ্যৎ
নব্বই দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত দেশে সিনেমা হল ছিল ১ হাজার ৩০০–এর বেশি। কমতে কমতে সেই সংখ্যা এখন ৭০ থেকে ৭৫। এর মধ্যে সব হল সারা বছর চালু থাকে না। ঈদ এলে চালু হয়। সরকারিভাবে সহযোগিতা না পেলে এই অঙ্গনের সামনে এগিয়ে যাওয়া খুব কষ্টকর বলে মনে করছেন চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাদের দাবি, এমন সংকটের উত্তরণের একমাত্র উপায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মিয়া আলাউদ্দিন বলেন, ‘অনুদান দিয়ে চলচ্চিত্র বাঁচানোর চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু হল না থাকলে ছবি চালাবেন কোথায়? আমাদের দিকে তো কারও দৃষ্টি নেই। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিটিংয়ের পর মিটিং করে গেলাম গত কয়েক বছর, কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই। সাফটায় ছবি আমদানি থেকে যৌথ প্রযোজনার নিয়ম সহজ করার যৌক্তিক প্রস্তাব দেওয়া হলো, কিন্তু এসবের কোন অগ্রগতি নেই। আসলে এই ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কারও দরদ নেই। এটা থাকলেই কি আর না থাকলেই কি।’
সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রগুলোর মান নিয়েও প্রশ্ন রাখেন মিয়া আলাউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘রূপবান মুক্তির পর দেশে হলের সংখ্যা বেড়েছিল। সর্বশেষ বেদের মেয়ে জোসনার পরও নতুন অনেক হল তৈরি হয়। কিন্তু এখন? ঈদের পরের হিসাবই বলি, যে ছবিগুলো চলছে, সেগুলো ৩০ মিনিট বসে দেখা সম্ভব নয়। যেসব দর্শক আসছেন, আমাদের গালি দিয়ে বের হচ্ছেন। আমাদের এখানে কী করার আছে? এভাবে কি একটা ইন্ডাস্ট্রি চলতে পারে?’

স্টার সিনেপ্লেক্সের বসুন্ধরা শপিং মল শাখা
ছবি: প্রথম আলো

দেশের সবচেয়ে বড় মাল্টিপ্লেক্স চেইন স্টার সিনেপ্লেক্স। ঈদের পর হলটিতে চলতি সপ্তাহ পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে পাঁচটি বাংলা ছবি। কোনো ছবিই দর্শক টানতে পারেনি। স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ‘ঈদের পর কোনো ছবিই চলেনি। চলেনি বলতে একদম চলেনি। সপ্তাহ তো দূরে, একটা শোতেও বলার মতো দর্শক হয়নি। ব্রাঞ্চ ভাড়া থেকে ইউটিলিটি, বেতন—সব মিলিয়ে আমাদের অনেক খরচ। শুধু ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা দিয়ে কোনোভাবেই টেকা সম্ভব নয়। মাসের পর মাস লস দিয়ে তো আর ব্যবসা করা যাবে না।’
প্রযোজক, হলমালিক—সবাই এখন প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন, এমন সংকট কাটিয়ে নতুন করে সিনেমার ‘সোনালি দিন’ ফিরিয়ে আনা সম্ভব কি না। তাঁদের মতে, সিনেমা ঘিরে জাতীয় পরিকল্পনা ছাড়া এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। সিদ্ধান্তমূলক উদ্যোগই বলে দেবে দেশের সিনেমা হলগুলো টিকবে, নাকি ইতিহাস হয়ে যাবে।