একটা সুন্দর সকালের অপেক্ষায় রয়েছি : চিত্রনায়ক আলমগীর

চিত্রনায়ক আলমগীর
প্রথম আলো
আজ বরেণ্য অভিনেতা আলমগীরের জন্মদিন। ঘটনাচক্রে এদিন ছিল জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস। জন্মদিনের দুপুরে বর্তমান চলচ্চিত্রের নানাদিক নিয়ে কথা বলে বিনোদন।

প্রশ্ন :

আজ (৩ এপ্রিল) জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস। একই দিনে আপনার জন্মদিনও। প্রতিবছরের মতো এবারও নিশ্চয়ই এই বিশেষ দিনটা উদ্‌যাপন করছেন।

ঠিক তা নয়। আমি ওই রকমভাবে জন্মদিন উদ্‌যাপন করি না। তবে এই দিনে ‘চলচ্চিত্র দিবস’টি অনেক বড় করেই পালন করতাম। ইদানীং চলচ্চিত্রে ভাটা পড়েছে বলেই ঘটা করে দিবসটি উদ্‌যাপিত হয় না। এবার আবার রোজা পড়ে যাওয়ায় কোনো আয়োজন করা হয়নি।

প্রশ্ন :

‘আমার জন্মভূমি’ চলচ্চিত্র দিয়ে আপনার চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়েছিল, তখন চলচ্চিত্র নির্মাণ আর এখন নির্মাণের অবস্থা বা অবস্থানটা আপনি কেমন দেখেন।

আসলে নির্মাণ নিয়ে আমার কথা বলা সাজে না। আমি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছি ছয়–সাতটি। তখন কোনো খোঁজখবর নিতাম না, অফিসে বসতাম না, কুমকুম (আলমগীর কুমকুম) ভাই ডাইরেকশন দিতেন, আর প্রয়োজক হিসেবে আমার নাম চলে যেত। আমি মূলত একজন অভিনেতা, আমি অভিনয় করি।

চলচ্চিত্রে অভিনয় করাটা খুব কঠিন। বহুদিন কাজ করার পর এটা বুঝেছি, এর শেষ পাওয়া যায় না। এর বিশালতা বা গভীরতা এত বিশাল যে এক জনমে না, শত জনমেও এর শেষ খুঁজে পাওয়া সম্ভব না।

প্রশ্ন :

কিন্তু ওই সময় যেভাবে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হতো, এখন কি সেই একই ধারায় ছবি নির্মিত হচ্ছে।

এই সময় তো আমি কাজ করছি না। বিরতি নিয়েছি। তাই এখনকার কথা বলতে পারব না। আমি আমাদের সেই স্বর্ণালি সময়ের কথা বলতে পারব।  

প্রশ্ন :

সেই সোনালি সময়ের কিছু স্মৃতিচারণা যদি করতেন?

আমাদের সময়, আমরা একটি ছবির গল্প নিয়ে প্রযোজক, পরিচালক, স্ক্রিপ্ট রাইটারসহ সবাই বসতাম। গল্প শুনতাম। আড্ডা মারতাম। গল্পটা আত্মস্থ করার চেষ্টা করতাম। ভালো কস্টিউম নিয়ে ভাবতাম। এ রকম সবকিছু বুঝে নিয়ে তারপর নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করতাম। চলচ্চিত্রে অভিনয় করাটা খুব কঠিন। বহুদিন কাজ করার পর এটা বুঝেছি, এর শেষ পাওয়া যায় না। এর বিশালতা বা গভীরতা এত বিশাল যে এক জনমে না, শত জনমেও এর শেষ খুঁজে পাওয়া সম্ভব না।

চিত্রনায়ক আলমগীর
ছবি: সংগৃহীত
প্রথম কারণ আমি মনে করি, অশ্লীলতা। ৯০ শতাংশ দায়ী অশ্লীলতা। দর্শক হল থেকে বাড়ি চলে গেছে। মধ্যবিত্তরা আগে পুরো পরিবার নিয়ে ছবি দেখতে। তাঁরা কি ওই সব গালিগালাজ, অশ্লীল নাচ–গান, ওই সব দৃশ্য দেখতে যাবে? ওই দর্শক হলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। প্রেক্ষাগৃহগুলো আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেছে।

প্রশ্ন :

আমরা তো মনে করি, আপনি আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রের একজন কিংবদন্তি চিরসবুজ নায়ক।

আমি ইন্ডাস্ট্রিতে স্টার, মহানায়ক বা সুপারস্টার, কিংবদন্তি হতে আসিনি। আমি অভিনেতা হতে এসেছিলাম। আর ওই যে বললেন, চিরসবুজ। এটা আমি জেনেটিক্যালি পেয়েছি। মানে তরুণ থাকাটা। আমি হাঁটা ছাড়া কোনো শরীরচর্চা করিনি। জীবনে সাঁতারও কাটিনি। জেনেশুনে কোনো কিছু করিনি।  

প্রশ্ন :

’৬০–এর দশক থেকে ’৯০–এর দশকে আমাদের যে চলচ্চিত্রগুলো নির্মিত হতো সেগুলো পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এগিয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে আমরা এখন ক্রমে পিছিয়ে পড়ছি। আজকে চলচ্চিত্র বলা যায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। কারণটা কি বলে আপনার মনে হয়।

প্রথম কারণ আমি মনে করি, অশ্লীলতা। ৯০ শতাংশ দায়ী অশ্লীলতা। দর্শক হল থেকে বাড়ি চলে গেছে। মধ্যবিত্তরা আগে পুরো পরিবার নিয়ে ছবি দেখতে যেত। তাঁরা কি ওই সব গালিগালাজ, অশ্লীল নাচ–গান, ওই সব দৃশ্য দেখতে যাবে? ওই দর্শক হলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। প্রেক্ষাগৃহগুলো আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেছে। এটার জন্য আমাদের প্রযোজকেরা শুধু দায়ী, তা নন, হলমালিকেরাও দায়ী। কারণ, তখন তারা ওই সব ছবি ২০-২৫ হাজার টাকা বেশি রেন্টাল দিয়ে কাটপিস খুঁজত।

প্রশ্ন :

সেটা তো নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে একুশ শতকের মাঝামাঝি একটা সময় পর্যন্ত। তারপর তো আবার তো প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে। ভালো ছবি নির্মিত হয়েছে।

হ্যাঁ, কিছু চলচিত্র হয়েছে, ব্যবসাসফলও হয়েছে। কিন্তু একটি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি কিছু সিনেমা দিয়ে হয় না। আগে বছরে ১২০–১২৫টি ছবি মুক্তি পেত। সেখান থেকে ৬০–৭০টা ছবি হিট করত। সেই দিনটা কোথায়? এখন ছবি মুক্তি হয়ে গেল ঈদকেন্দ্রিক। ঈদ ছাড়া অনেক আর্টিস্ট ছবি রিলিজ করে না। কারণ, ঈদ ছাড়া তাঁদের ছবি চলে না। আমরা তো ঈদ কবে, অনেক সময় জানতাম না। আমাদের শুরুতে আমরা ঈদ পেতাম না। আমাদের ছবি ঈদে মুক্তি দেওয়া যেত না। অন্য যেকোনো সময় মুক্তি পেত এবং চলত। অশ্লীল ছবি যারা বানাত, তারা অনেক বেশি সংঘবদ্ধ, শক্তিশালী। আমরা ছিলাম মুষ্টিমেয় কিছু আর্টিস্ট। খুবই দুর্বল কাপুরুষের মতো আমরা সরে গেছি। দোষ আমাদেরও আছে।

চিত্রনায়ক আলমগীর
ছবি : সংগৃহীত

প্রশ্ন :

যদি বলি আপনি সরে যাননি। আপনার সমসাময়িক অনেকেই সরে গেছেন।  

হ্যাঁ, এফডিসিতে আসি। এফডিসি আমার। যেখান থেকে আমাকে কেউ সরাতে পারবে না। কিন্তু আমি এফডিসিতে অভিনয় করতে আসি না।

ফিল্ম ইজ আ লর্ড গেম ইউ হ্যাভ টু প্লেড লাইক আ লর্ড । ইউ হ্যাভ টু মেইক আ লাইক লর্ড। আমরা এখন জোড়াতালি দিয়ে ২০-৩০ লাখ টাকা দিয়ে ছবি বানাই। দুঃখিত, ওটা চলচ্চিত্র হতে পারে না।

প্রশ্ন :

চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলেন আজকে বাংলা চলচ্চিত্র যে ধস নেমেছে, তার কারণ এখন ভালো পরিচালক, অভিনেতা–অভিনেত্রী, অভিনয়শিল্পী সব ক্ষেত্রেই মেধার সংকট। আপনি কী মনে করেন?

অবশ্যই মেধার সংকট আছে। একজন ভালো স্ক্রিপ্ট রাইটার দিন। আমি ধরে নিলাম পাত্র-পাত্রী মানে নায়ক–নায়িকা বেশ কয়েকজন আছেন। তাঁদের দিয়ে হবে। কিন্তু পাত্র–পাত্রীকে কী দিয়ে সাজাবে? গয়নাগাটি লাগবে না। এই গয়নাগাটি হলো মা, বাবা, ভাই-বোন যাঁরা আছেন। আমাকে একটা ভালো বাবা, ভালো মা বের করে দিন তো। নেই কেউ। কে ছবি বানাবে?  

প্রশ্ন :

বলা হচ্ছে, সিনেপ্লেক্সগুলোতে এফডিসিকেন্দ্রিক মূলধারার ছবিকে বাদ দিয়ে বাইরের ছবিগুলোকে বেশি প্রোমোট করছে।

এফডিসিকেন্দ্রিক ছবিই তো হচ্ছে না। পৃথিবীতে চলচ্চিত্রের দুইটা ধারা আছে। একটা ভালো ছবি, আরেকটা মন্দ ছবি। ভালো ছবি হলো দর্শক যেটা পছন্দ করে। আর যেটা দর্শক পছন্দ করে না, সেটা মন্দ ছবি। এর বাইরে আর কোনো চলচ্চিত্র নেই।

প্রশ্ন :

তাহলে যে ছবিগুলো ভালো ছবি হিসেবে পুরস্কার পাচ্ছে। কিন্তু হলে চলছে না, সেগুলোকে আপনি কী বলবেন?

সেগুলো নিয়ে আমি বলব না। আমি ‘হাওয়া’কে ভালো ছবি বলব। ছবিটা আমি দেখছি।

প্রশ্ন :

তার মানে গুণগত মান ভালো বলেই ‘হাওয়া’র মতো ছবিগুলো সিনেপ্লেক্স নিচ্ছে। অন্যগুলো তাই নিচ্ছে না? কোনো ঘাটতি আছে তাহলে?

ঘাটতি তো অবশ্যই আছে। আমার কিছু বলার আছে। আমার জানা নেই, পৃথিবীর আর কোনো দেশে সরকারি অনুদানে ছবি হয় কি না। অনুদান দিয়ে ছবি হয় না, সোজা হিসাব। আমরা যে চিৎকার করছি ২০০ কোটি টাকা দেন আমরা ছবি বানাব। ভিক্ষা করে ছবি হয় না। ফিল্ম ইজ আ লর্ড গেম ইউ হ্যাভ টু প্লেড লাইক আ লর্ড । ইউ হ্যাভ টু মেইক আ লাইক লর্ড। আমরা এখন জোড়াতালি দিয়ে ২০-৩০ লাখ টাকা দিয়ে ছবি বানাই। দুঃখিত, ওটা চলচ্চিত্র হতে পারে না।  

প্রশ্ন :

তাহলে এর থেকে উত্তরণের পথ কী? আমরা তো পুরোনো জায়গায় আমাদের চলচ্চিত্রকে দেখতে চাই। এ ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?

পরামর্শ আমরা ইতিমধ্যেই সরকারকে দিয়েছি। একটা পরামর্শ দিয়েছি, অল্প সময়ের জন্য কিছুসংখ্যক বিদেশি ছবির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। তাহলে দর্শক হয়তো আবার হলমুখী হবে। তাহলে হয়তো আবার হলের সংখ্যা বাড়বে।

কিন্তু ৫২ সপ্তাহের মধ্যে ২০ সপ্তাহের বেশি কোনো বিদেশি ছবি চলবে না। ৩২ সপ্তাহ আমাদের দিতে হবে। এবং এটা এক বছর বা দেড় বছরের জন্য। তখন হল বাড়লে যেসব প্রযোজক টাকা নিয়ে বসে আছেন তাঁরা অটোমেটিক্যালি ছবি বানাতে শুরু করতে পারেন।

চিত্রনায়ক আলমগীর
ছবি : সংগৃহীত
আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

এই যে শাহরুখ খানের ‘পাঠান’–এর দেশে মুক্তির যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটাকে কী চোখে দেখছেন।

আমি এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। একটা কথা বলি, আমাদের ‘সূর্যস্নান’, আমাদের ‘মাটির পাহাড়’, ‘আকাশ আর মাটি’ যখন চলেছে, তখন কি এখানে হিন্দি ছবি আর উত্তমকুমারের ছবি চলত না? আমাদের তো কম্পেটিশন থাকতে হবে। কোনো কম্পেটিশন নেই আমাদের। বিশ্ব একদিকে চলছে, আর আমরা নিজেদের প্রটেকশন দিতে তাদের সঙ্গে ফেস করতে রাজি নই। কেন? আমার কথা হলো বিদেশি ছবি থেকে কিছুটা সাহায্য নিয়ে আমাদের এখন ঘুরে দাঁড়াতে হবে। কিছু বললেই সরকার করে দেবে। সরকার করে দেবে কেন? উদ্যোগ আমাদেরই নিতে হবে।

প্রশ্ন :

সর্বশেষ ‘একটি সিনেমার গল্প’ পরিচালনা করেছিলেন, তারপর বলেছিলেন ধারাবাহিকভাবে ছবি পরিচালনা করবেন?

ছবি যে বানাব, সে ছবি কোথায় চালাব। আমাদের তো হলই নেই। আমাকে কালকে ১০০ হল দিন, আমি আগামীকাল ছবি নির্মাণে নামব। নাহলে আপনারা আমার ৫০ বছরের সব ইতিহাস থেকে মুছে ফেলেন। আমি অনুদান নিয়ে ছবি করব না। আমি নিজের টাকায় ছবি বানাব। কারণ, আমি দান নিয়ে ছবি করতে রাজি না। দানের টাকায় ছবি হয় না।

প্রশ্ন :

বাংলা চলচ্চিত্রের এই দুর্দিনে আপনি কি তারপরও আশাবাদী?

হ্যাঁ, তারপরও আমি আশাবাদী। চলচ্চিত্র ঘড়ির কাঁটার মতো চলে। সকাল থেকে সন্ধ্যা, তারপর রাত হয়। আবার সকাল আসে। আমরা একটা সুন্দর সকালের অপেক্ষায় রয়েছি।