যে কারণে চলতি বছরের সিনেমা, সিরিজগুলো আলাদা

প্রহেলিকা, প্রিয়তমা ও সুড়ঙ্গ সিনেমার দৃশ্য। ছবি: পরিচালকের সৌজন্যে
বলিউডের প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে চলতি বছর নিজেদের গল্প বলার চেষ্টা করেছে ঢাকাই সিনেমা, চমক ছিল দৃশ্যায়ন আর উপস্থাপনাতেও। অন্যদিকে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোয় থ্রিলারের বাইরে সায়েন্স ফিকশন, পিরিয়ড ড্রামাসহ নানা বৈচিত্র্যময় কাজ চোখে পড়েছে।

মাসুদ বুঝে গেছে, সে প্রতারিত হয়েছে। এ ঘর থেকে ও ঘর ছুটে বেড়াচ্ছে। তাঁর চোখে ভাসছে স্ত্রীর অন্য সম্পর্কের কথা। এ দৃশ্য পর্দায় পরিচালক দেখিয়েছেন ওয়ান টেক শটে। সঙ্গে ছিল রঙের ব্যবহার, যা মাসুদের তখনকার মানসিক অবস্থাকেই বোঝায়। চলতি বছর মুক্তি পাওয়া রায়হান রাফীর আলোচিত সিনেমা ‘সুড়ঙ্গ’-এর দৃশ্য এটি। প্রতারিত, অসহায় প্রেমিকের চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন আফরান নিশো। একই সঙ্গে দৃশ্যায়নের মুনশিয়ানার জন্য পরিচালক রাফীরও বাহবা পাওনা। কেবল ‘সুড়ঙ্গ’ই নয়, বছরজুড়েই দেশের সিনেমা ও সিরিজে ভিজ্যুয়াল গল্প বলার আরও অনেক সফল উদাহরণ রয়েছে।

‘প্রহেলিকা’ সিনেমার দৃশ্য
সংগৃহীত

নতুন গল্প, নতুন উপস্থাপনা
সংগীতনির্ভর থ্রিলার ঘরানার কাজ দেশে খুব একটা হয়নি। তাই স্বভাবতই চয়নিকা চৌধুরীর ‘প্রহেলিকা’ মুক্তির পর আলোচনা তৈরি হয়। সিনেমার আবহসংগীত রাগনির্ভর, এর ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে নানা রহস্য। শেষ বিচারে সিনেমাটি কেমন হয়েছে বা কতটা ব্যবসায়িক সাফল্য পেয়েছে, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ ধরনের গল্প বাছাই। সিনেমাটিতে বাণিজ্যিক সিনেমার দাপুটে নায়ক ছিলেন না, মিউজিক্যাল থ্রিলারের ঢঙে গল্প বলার ব্যাপারটিও নতুন। তবে এসব সংশয়কে পেছনে ফেলে ছবিটি যখন আলোচনা তৈরি করে, তখন এ ধরনের গল্প নিয়ে কাজ করতে প্রযোজক, পরিচালকেরা নিশ্চয় নতুন করে ভাববেন।

‘সুড়ঙ্গ’ ছবিতে তমা মির্জা ও আফরান নিশো
ছবি : চরকির সৌজন্যে

একইভাবে বলা যায়, গত এপ্রিলে মুক্তি পাওয়া নাদের চৌধুরীর ‘জ্বীন’ সিনেমার কথাও। দেশে হাতে গোনা ভৌতিক সিনেমার মধ্যে নতুন সংযোজন এটি। হরর সিনেমা নির্মাণে নানা ধরনের প্রযুক্তিগত মুনশিয়ানার প্রয়োজন হয়, সঙ্গে অবশ্যই ভালো গল্প। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ‘জ্বীন’ মোটামুটি আলোচনায় ছিল।

‘জ্বীন’ ছবিতে সজল ও পূজা। ছবি: সংগৃহীত

এ দুই সিনেমা ছাড়াও উল্লেখ করতে হবে ‘অন্তর্জাল’-এর কথা। সাইবার থ্রিলার ঘরানার সিনেমার বিষয়বস্তু ঢাকাই সিনেমার জন্য একেবারে নতুন। বিষয়বৈচিত্র্য ও আধুনিক নির্মাণের জন্য নজর কেড়েছে দীপংকর দীপনের চলচ্চিত্রটি।

নায়ক যখন অচেনা
গত ঈদুল ফিতরের আগে অন্তর্জালে পোস্ট করার পরমুহূর্তেই ভাইরাল হয় একটি ছবি। ২০২৩ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমার ফার্স্ট লুকের মধ্যে এটি যে সবচেয়ে আলোচিত ছবি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ছবিটি ‘প্রিয়তমা’ সিনেমার, শাকিব খানের।

শাকিবের সেই ছবির প্রশংসা করেছেন তাঁর ভক্ত থেকে শুরু করে বিনোদন-দুনিয়ার তারকারাও
পরিচালকের সৌজন্যে

বৃদ্ধ লুকে শাকিবের সেই ছবির প্রশংসা করেছেন তাঁর ভক্ত থেকে শুরু করে বিনোদন-দুনিয়ার তারকারাও। স্বভাবতই মুক্তির পর আলোচনায় আসে সিনেমাটির শেষ আধঘণ্টা, যেখানে বৃদ্ধ লুকের শাকিবের দেখা পাওয়া যায়। ‘হিরো ইমেজ’ থেকে বেরিয়ে চরিত্রের প্রয়োজনে শাকিব যে এভাবে নিজেকে ভাঙতে পারেন, সেটা ছিল চমকে দেওয়ার মতো।

আরও পড়ুন

নিজেদের গল্প বলি
বাণিজ্যিক সিনেমার বাইরে শৈল্পিক ঘরানার বিভিন্ন কাজ মুক্তি পেয়েছে চলতি বছর। এখানেও ছিল বৈচিত্র্য। মোটাদাগে চলতি বছরের দুটি সিনেমার কথা বলা যায়—‘আদিম’ ও ‘সাঁতাও’। দুটি সিনেমাই পুরোপুরি ‘দেশি’ গল্প বলেছে।

‘আদিম’ সিনেমায় শুটিংয়ের দৃশ্য। ছবি : পরিচালকের সৌজন্যে

নেশাগ্রস্ত কালা, তার বউ সোহাগী আর তার প্রতি আকৃষ্ট ল্যাংড়া—তৃণমূলের এই তিন চরিত্রকে নিয়ে এগিয়েছে ‘আদিম’। আমাদের আশপাশের চেনা চরিত্রগুলো নিয়ে যুবরাজ শামীমের সিনেমাটি ঠিক ‘সিনেমা’ মনে হয় না, মনে হয় নিজের চোখে দেখা সত্যিকারের জীবন। সীমিতসংখ্যক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির পরও সিনেমাপ্রেমীরা ঠিক হাজির হয়েছিলেন সিনেমাটির রস আস্বাদনে।

‘সাঁতাও’ সিনেমার পোস্টার
ছবি: সংগৃহীত

চলতি বছর মুক্তি পাওয়া ভিন্ন ধারার আরেকটি আলোচিত সিনেমা ‘সাঁতাও’। রংপুর অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের জীবন ও সংকটের গল্প নিয়ে সিনেমাটি বানিয়েছেন খন্দকার সুমন। রংপুর অঞ্চলে টানা কয়েক দিনের বর্ষণকে ‘সাঁতাও’ বলা হয়, এটা ধরেই সিনেমাটির নামকরণ করা হয়েছে। গল্প, অভিনয় আর দৃশ্যায়ন মিলিয়ে চলতি বছরের অন্যতম সেরা সিনেমা এটি।

বড় পরিসরে যুদ্ধের গল্প
‘জেকে ১৯৭১’, ‘ওরা ৭ জন’ ও ‘১৯৭১ সেই সব দিন’—চলতি বছর ফখরুল আরেফিন খান, খিজির হায়াত খান ও হৃদি হক নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের এ তিন সিনেমা আলোচনায় ছিল। তিনটি সিনেমাতেই ছিল বড় ক্যানভাসে গল্প বলার চেষ্টা। ‘জেকে ১৯৭১’ যেমন বিমান ছিনতাইকে কেন্দ্র করে নির্মিত, ওরা ৭ জন আবার আলোচনায় ছিল অ্যাকশনের জন্য; অন্যদিকে শিল্প নির্দেশনায় নজর কেড়েছে ‘১৯৭১ সেই সব দিন’।

‘১৯৭১ সেই সব দিন’ সিনেমার দৃশ্যে সজল ও সানজিদা প্রীতি
ছবি : পরিচালকের সৌজন্যে

কেবলই থ্রিলার নয়
তুষারপাত হচ্ছে। বরফের কণা এসে পড়ছে চোখেমুখে; নায়িকার সেকি উচ্ছ্বাস! দৃশ্যটি ভিকি জাহেদের ওয়েব সিরিজ ‘আমি কী তুমি’র। দেশি এই সিরিজে তুষারপাত দেখিয়েছেন নির্মাতা। আই স্ক্রিনে মুক্তি পাওয়া সায়েন্স ফিকশন ড্রামা ঘরানার ছবিটির মূল উপজীব্য ছিল প্যারালাল ইউনিভার্স। দেশি সিরিজের দর্শকের জন্য যা ছিল বড় চমক। কেবল এটিই নয়, চলতি বছর ওয়েবে মুক্তি পেয়েছে এমন বেশ কয়েকটি বৈচিত্র্যময় সিরিজ ও সিনেমা, যেগুলো দেখার পর ওটিটি মানেই থ্রিলার—এই রায় আর দেওয়া যায় না।

‘ইন্টার্নশিপ’-এর একটি দৃশ্য
ছবি : চরকির সৌজন্যে

বছরের শুরুর দিকে চরকিতে মুক্তি পায় ‘ইন্টার্নশিপ’। সিচুয়েশন কমেডি ঘরানার সিরিজটি ওয়েবের দর্শকের জন্য ছিল তাজা হাওয়ার মতোই। এ ছাড়া চরকির রোমান্টিক ওয়েব ফিল্ম ‘উনিশ২০’ প্রশংসা কুড়ায় পাত্র-পাত্রীর রসায়নের জন্য।
আগস্টে হইচইয়ে মুক্তি পায় ইয়াসির আল হকের সিরিজ ‘সাড়ে ষোলো’। সিরিজটি ছিল চেম্বার ড্রামা ঘরানার। এ ধরনের সিরিজও এই প্রথম তৈরি হয়েছে দেশে।

‘আমি কী তুমি’র পোস্টার। ছবি : সংগৃহীত

গত বৃহস্পতিবার একই প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে সিরিজ ‘মোবারকনামা’। এটি কোর্টরুম ড্রামা ঘরানার, যে ধরনের সিরিজ বাইরে প্রচুর হলেও দেশে খুব একটা দেখা যায়নি।

আরও পড়ুন

একইভাবে বলা যায় চরকির ‘ভাইরাস’-এর কথাও। ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া নিয়ে নির্মিত সিরিজটিতে নতুনত্বের স্বাদ পেয়েছে দর্শক।

গল্পের নতুনত্বের জন্য আরও একটি সিরিজ ছিল আলোচনায়, এটি হলো বিঞ্জে মুক্তি পাওয়া সিদ্দিক আহমেদের পিরিয়ড ড্রামা ‘অগোচরা’, যা নির্মিত হয়েছে পুরান ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড দুনিয়া নিয়ে।

‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ ছবিতে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও তিশা
চরকির সৌজন্যে

চলতি বছর আরেকটি ওয়েব ফিল্মের কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে, চরকির ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’। নিজের জীবনের কিছু গল্পের সঙ্গে সমাজ, সংসার আর রাজনীতিকেও এই সিনেমায় তুলে এনেছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। দেশে-বিদেশে ওটিটিতে যে ধরনের কাজ দর্শক দেখে অভ্যস্ত তার মধ্যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম এ সিনেমা।

নারীকেন্দ্রিক গল্প বেড়েছে
‘গুটি’তে বাঁধন, ‘দ্য সাইলেন্স’-এ মেহজাবীন অথবা ‘ফ্রাইডে’তে তমা মির্জা—চলতি বছর ওটিটিতে নারীপ্রধান বেশ কয়েকটি কাজ মুক্তি পেয়েছে। এ ছাড়া ‘নিকষ’, ‘মারকিউলিস’-এর মতো কাজগুলোও ছিল আলোচনায়। ‘নিকষ’–এ এক বোনকে খুঁজতে আরেক বোনের মরিয়া যাত্রা দেখানো হয়েছে। এক বোনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাসনিয়া ফারিণ। পাশের বাড়ির মেয়ের ইমেজ ভেঙে ওয়েব ফিল্মটিতে তাঁকে দেখা গেছে গ্ল্যামারহীন চরিত্রে। বোনকে খোঁজার অনিশ্চয়তার পুরোটাই ফুটে উঠেছিল তাঁর চোখেমুখে।

ওয়েব সিরিজ ‘মারকিউলিস’ এর দৃশ্যে অভিনয়শিল্পী সাবিলা নূর
ছবি : চরকির সৌজন্যে

অন্যদিকে ‘মারকিউলিস’–এ জয়িতা চরিত্রে অভিনয় করেন সাবিলা নূর। ছোট পর্দার রোমান্টিক ইমেজের এই অভিনেত্রী পর্দায় যেভাবে জয়িতা চরিত্রটির অসহায়ত্ব, আবেগ আর হার না মানা মানসিকতা ফুটিয়ে তুলেছেন, তাতে চমকে গেছেন তাঁর ভক্তরাও।

নারীপ্রধান কাজগুলোয় চরিত্র নির্মাণেও ছিল বৈচিত্র্য। অসহায়ত্ব, সাধারণ পারিবারিক দৃশ্য থেকে নৃশংসতা—পর্দায় নানা ধরনের চরিত্রে দাপট দেখিয়েছেন শিল্পীরা।