গ্রাম থেকে পালিয়ে এসে নায়িকা, ‘ম্যাডাম ফুলি’ এখন কোথায়

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রনায়িকা সিমলা।ছবি:সংগৃহীত

১১ ভাই-বোনের পরিবারের সবার ছোট মেয়েটি। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন রুপালি পর্দার নায়িকা হবেন। ১৯৯৮ সালে একদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই ঝিনাইদহের শৈলকুপা থেকে ভাইয়ের হাত ধরে পালিয়ে এলেন রাজধানীতে। মেয়ের বয়স তখন ১৬। অচেনা শহরে কোথায় গিয়ে উঠবেন, কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। চারপাশে অন্ধকার দেখলেও মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছিল ঝলমলে রঙিন দুনিয়া। পরের গল্পটা সিনেমার মতোই। শৈলকুপা থেকে এসে ঢাকাই সিনেমার নায়িকার হওয়ার সেই গল্পে এবার ঢুকে পড়া যাক।

সিমলা
সংগৃহীত

শৈলকুপার তরুণী যখন ‘ম্যাডাম ফুলি’
ঢাকায় পৌঁছে এলাকার বড় ভাই গীতিকার ও সংগীত পরিচালক মিল্টন খন্দকারের কাছে গিয়ে হাজির হলেন মেয়েটি। তাঁর মনের কথা জানালেন তাঁকে। সেই সময় গীতিকার ও সুরকার হওয়ার সুবাদে অনেক পরিচালকের সঙ্গে পরিচয় ছিল মিল্টন খন্দকারের। তিনি ফোন দিলেন চিত্র পরিচালক শহিদুল ইসলাম খোকনকে। মেয়েটির আগ্রহের কথা তাঁকে জানালেন। সন্ধ্যায় তাঁর কাকরাইলের অফিসে যেতে বললেন পরিচালক। পরিচালক সে সময় ‘ভণ্ড’ ছবি নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

আরও পড়ুন

মেয়েটিকে দেখে, কথা বলে পছন্দ হয় পরিচালকের। মেয়েটিকে বললেন, ‘“ভণ্ড” ছবির সব প্রস্তুতি শেষ। এখন আমার কাছে “ম্যাডাম ফুলি” নামে একটি চিত্রনাট্য আছে, ওইটাতে কাজ করতে পারো।’ মেয়েটি রাজি হয়ে গেলেন। এত দেখার কিছু নেই, নায়িকা হতে হবে, এটাই তাঁর চাওয়া ছিল। ওই দিনই সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হলেন মেয়েটি। কিছুদিনের মধ্যে শুরু হলো শুটিং।

সিমলা
সংগৃহীত

পরের বছর ১৯৯৯ সালে ‘ম্যাডাম ফুলি’ মুক্তি পেল। প্রথম ছবিতেই বাজিমাত। ‘ম্যাডাম ফুলি’ দেখতে প্রেক্ষাগৃহে প্রেক্ষাগৃহে টিকিট নিয়ে কাড়াকাড়ি দর্শকের। ‘ম্যাডাম ফুলি’ চরিত্রের সেই মেয়েটি নায়িকা সিমলা। প্রথম সিনেমা মুক্তির পরই তাঁর নাম দর্শকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। রাতারাতি নায়িকা বনে গেলেন। নড়েচড়ে বসলেন অনেক চিত্র পরিচালক। গ্রামের সেই মেয়ে দর্শকের কাছে হয়ে উঠলেন শহরের ‘ম্যাডাম ফুলি’।

স্মৃতির ভেলায় ভেসে
এত দিন পর ‘ম্যাডাম ফুলি’র প্রসঙ্গ তুলতেই সিমলা ফিরে গেলেন দুই যুগের বেশি সময় আগে। বলতে শুরু করলেন, ‘প্রথম ছবিই আমার জীবনের ইতিহাস। এই ছবিতেই আমি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি। আমার প্রথম ছবিই দর্শকের এত পছন্দ হবে, এত আলোড়ন তুলবে, বুঝতে পারিনি। এত ঝড় তুলেছিল, পরিচিতজনদের ছবিটি দেখানোর জন্য ছদ্মবেশে হলে গিয়ে আমি নিজে পর্যন্ত টিকিট পাইনি।’

সিমলা
সংগৃহীত

প্রথম ছবিই দর্শক আলোচনায় আসতে পারে, সিমলা তখন টের না পেলেও পরিচালক ঠিকই বুঝেছিলেন। তাই ‘ম্যাডাম ফুলি’ ছবির শুটিংয়ের শেষ পর্যায়ে এসে শহিদুল ইসলাম খোকন ‘পাগলা ঘণ্টা’ ও ‘ভেজা বিড়াল’ নামে আর দুটি ছবিতে চুক্তি করিয়েছিলেন সিমলাকে। এই অভিনেত্রী বলেন, ‘প্রথম ছবির মুক্তি না পেতেই খোকন ভাই তাঁর আরও দুটি ছবিতে আমাকে চুক্তি করালেন। তখন মনে হলো, আমার কাজে সন্তুষ্ট। পরিচালক আমার মধ্যে এমন কিছু পেয়েছেন, আমার প্রতি তাঁর বিশ্বাস তৈরি হয়েছে।’

প্রথম ছবি মুক্তির পর সিমলাকে নিয়ে পরিচালকের সেই বিশ্বাস বাস্তবে রূপ পেল। আর ফিরে তাকাতে হয়নি সিমলাকে। একের এক ছবিতে কাজ করতে থাকেন। কিন্তু ২০১০ সালের পর সিনেমায় ছন্দপতন ঘটে তাঁর। আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়তে থাকেন।

এখন কী
সিমলার সিনেমার ক্যারিয়ারের বয়স দুই যুগ। এখন কালেভদ্রে তাঁকে অভিনয়ে দেখা যায়। শুটিংয়ের বাইরেও অনেক অভিনয়শিল্পী ব্যস্ত নানা ইভেন্ট নিয়ে। কিন্তু সিমলা সেভাবে প্রকাশ্যে নেই। বর্তমান এই অভিনেত্রী কোথায় আছেন, কী করছেন, দর্শকেরা অনেকেই সে খবর জানেন না।

শিবচরে ‘দক্ষিণ দুয়ার’ ছবির শুটিংয়ে ফেরদৌস ও শিমলা
ছবি : ফেরদৌসের সৌজন্যে

গত মঙ্গলবার দুপুরে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় এই নায়িকার। জানালেন, মাকে সঙ্গে নিয়ে রাজধানীতে তাঁর নিজের ফ্ল্যাটেই থাকেন। মাঝেমধ্যে মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ঘুরতে যান। গ্রামে ভাই-বোনের সঙ্গে সময় কাটান। এভাবেই দিন যাচ্ছে তাঁর। বলেন, ‘এখন তো সিনেমায় সেভাবে কাজ করি না। চলতি বছরে ডায়মন্ড (সৈয়দ অহিদুজ্জামান) ভাইয়ের “দক্ষিণ দুয়ার’’ ছবিতে কাজ করলাম। সব সময় তো কাজ আসে না। এ ধরনের ভালো কাজ হাতে এলে করি।’

সিনেমার মানুষের সঙ্গে খুব একটা বন্ধুত্ব নেই সিমলার। তাঁর সময়কার সহশিল্পী ইরিন জামান, তামান্না দেশের বাইরে চলে গেছেন। একসময় শাবনূরের সঙ্গে ভালো সখ্য থাকলেও তিনি দেশের বাইরে। ঢাকাই সিনেমার এই নায়িকা বলেন, ‘শুরু থেকেই সিনেমার মানুষজনের সঙ্গে কাজের বাইরে খুব একটা খাতির ছিল না আমার। তবে মৌসুমী আপা, শাবনূর আপার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। তাঁদের বাসায় যাতায়াত ছিল। শাবনূর দেশের বাইরে, যোগাযোগ নেই। এখন শুধু মৌসুমী আপার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। মৌসুমী আপার ভক্ত আমি। তাঁর সঙ্গে আমার দুটি সিনেমা করার সুযোগও হয়েছিল।’

আরও পড়ুন

এদিকে সিমলা জানান, ২০১৮ সালে ‘সফর’ নামে একটি ভারতীয় ছবিতে কাজ করেছেন। এটি পরিচালনা করেছেন অর্পণ রায় চৌধুরী। ছবিটি এখনো মুক্তি পায়নি। তা ছাড়া হিন্দি ও বাংলা ভাষায় নির্মিত হবে, এমন একটি ছবির কাজে প্রস্তাব পেয়েছেন তিনি।

‘নিষিদ্ধ প্রেমের গল্প’ চলচ্চিত্রে সিমলা

সিমলা বলেন, ‘“সফর” ছবিটির শুটিং করতে গিয়ে করোনায় আটকা পড়েছিলাম। ওই সময় মুম্বাইতে প্রায় এক বছর থাকতে হয়েছিল। তখন রানি মুখার্জির চাচার একটি প্রোডাকশনে কাজের প্রস্তাব পাই। চিত্রনাট্য পেয়েছি। গল্পটি ভালো। গত পূজার পরপর শুটিং করার কথা ছিল, শুরু হয়নি।’

গোপনে ২০১৮ সালে পলাশ আহমেদ নামের একজনের সঙ্গে বিয়েও হয় সিমলার। পরের বছর একটি উড়োজাহাজ ছিনতাইচেষ্টার পর কমান্ডো অভিযানে নিহত হন পলাশ। আর বিয়ে করেননি তিনি। তবে বিয়ের জন্য পাত্রের খোঁজে আছেন বলেও জানালেন সিমলা, ‘বারবার তো ভুল করা যাবে না। এখন একটু চিন্তাভাবনা করেই বিয়েটা করতে হবে। তবে এখন আমার একটু পরিণতি স্বামী দরকার। সেই সন্ধানেই আছে পরিবার।’