‘ঐক্যই আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার’

মুক্তি পেয়েছে তারিক আনাম খান অভিনীত চলচ্চিত্র ‘মেকআপ’। চলছে নতুন নাটক ও সিরিজের কাজ। পাশাপাশি পালন করছেন অভিনয়শিল্পী সংঘের অন্তর্বর্তী সভাপতির দায়িত্ব। এসব বিষয়ে গত মঙ্গলবার দুপুরে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন মনজুর কাদের

তারিক আনাম খানপ্রথম আলো

প্রকাশিত হয়েছে ‘ফেউ’–এর টিজার। ওয়েব সিরিজটিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন তারিক আনাম খান। ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বনে সিরিজটি বানিয়েছেন সুকর্ন সাহেদ ধীমান। এর বাইরে সম্প্রতি ‘সুখ অসুখ’ নামের নতুন একটি নাটকের শুটিং শেষ করেছেন। খুব শিগগিরই নতুন আরেকটি নাটকের শুটিং শুরু হবে। তবে মঙ্গলবার দুপুরে যখন কথা হচ্ছিল, তখন বাসায়ই ছিলেন এই অভিনেতা–নির্দেশক। জানালেন, শুটিং নেই।

তারিক আনাম খান। কবির হোসেন

‘একটু বেছে কাজ করি। তা ছাড়া আমাদের বয়সীদের কাজ ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। নাটকে তো এখন তরুণ, ভিউ, ফেসবুক, ফলোয়ার, অমুক–তমুক। নামগুলো দেখলেও বোঝা যায়। ‘কখন দেখা হবে তোমার সাথে’, ‘কাছে দূরের মানুষ’, ‘তোমাকে চাই তোমাকে চাই’—এ রকম আরও কত কী! ঘুরেফিরে একই। যেই লাউ সেই কদু। এসব নিয়ে কিছু বলতেও ইচ্ছা হয় না,’ তারিক আনামের কণ্ঠে হতাশা। ‘আপনি তো ভালো নামগুলোই বলেছেন’ কথাটা শুনেই হেসে বললেন, ‘প্রেমের নাটকেরও তো কত সুন্দর নাম হতে পারে; কিন্তু তা দেখি না। আমাকে ব্যথিত করে। নাটকের সঙ্গে সাহিত্যের একটা যোগ আছে। আমরা যে সংলাপ বলি, এটার মধ্যে তো চিত্রকল্প থাকে, কাব্য থাকে, রূপক থাকে, সুন্দর কথা থাকে।  সুন্দর কথা একটা সময় চলচ্চিত্রেও ছিল। বাংলা নাটকে তো সাংঘাতিকভাবে ছিল। সেগুলোর অনুপস্থিতি, কিছু অর্থহীন নাম এখন দেখি—সত্যিই এসব ব্যথিত করে। মনে হয় যে আমরা বুঝি কিছুই করতে পারিনি। কোনো শিক্ষাই রেখে যেতে পারলাম না।’

ডিজিটাল মাধ্যমের প্রভাব
দর্শক নাটক বা অন্যান্য অনুষ্ঠান এখন টেলিভিশনে সেভাবে দেখেন না। ফেসবুক, ইউটিউব কিংবা অন্য সব ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে দেখে নেন। তারিক আনাম বললেন, ‘নাটকটা এখন ডিজিটাল মাধ্যমে চলে গেছে। এমনকি টেলিভিশনও নির্ভর করে তাদের ডিজিটাল মাধ্যমে কী বলছে। বিজ্ঞাপনদাতারা সেসবের মধ্যে আছে। জনপ্রিয় তালিকায় প্রেমের নাটক, কমেডি নাটক। সূক্ষ্মতা যা থাকার কথা, সেটা নাই। আমি বলছি না যে ওই জনপ্রিয়তার কোনো মূল্য নেই। কিন্তু সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় একটা জায়গা হচ্ছে শিক্ষা, উন্নত জীবন।’

তারিক আনাম খান। প্রথম আলো

উদাহরণ টেনে তারিক আনাম বললেন, ‘আমরা শুনেছি, বোম্বে ফিল্ম নাকি প্রেম করা শিখাত। কত সুন্দরভাবে প্রেম করা যায়। কত সুন্দরভাবে কথা বলা যায়—এটা বোম্বে ফিল্ম দেখেই অনেকে করত।’ এ প্রসঙ্গে নিজের জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাও বললেন, ‘আমাকে কাজের কারণে বিভিন্ন সময় ব্যাংকে যেতে হয়। সেখানে শুনতে হয়, নাটকের ভাষা এমন কেন! ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, বিশ্বাস করেন, আপনাদের যখন নাটক হতো আমাদের মা–বাবারা আমাদের টেলিভিশনের সামনে জোর করে বসিয়ে রাখত। বলত দেখ, কত সুন্দর করে কথা বলতে হয়। আমরা কথা বলা শিখেছি, আপনাদের লক্ষ করেছি, অনুসরণ করেছি‌—তখনকার বিটিভি নাটক থেকে। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়। কিন্তু পরিবর্তন যদি ঊর্ধ্বের দিকে না যায়, উন্নতির দিকে না যায়, তাহলে তো মুশকিল। এখন তো অনেক কিছুই হচ্ছে, জনপ্রিয়তা, ভিউ ইত্যাদির মধ্যে আটকে আছি। জনপ্রিয়তা নিয়ে আমার কোনো ধরনের বিরক্তি নাই। জনপ্রিয়তা থাকে, সিনেমায়ও থাকে। নায়ক–নায়িকার জনপ্রিয়তার ওপর নির্ভর করে ছবি হয়। কিন্তু একটা রুচি ও নান্দনিকতার জায়গা যেটা, সেটার বড় দুর্দশা হয়েছে বলে মনে হয়। বাংলা ছবির ক্ষেত্রেও এটা শুরু হয়েছিল। যখন নামতে শুরু করেছিল, কাটপিস শুরু হলো—সেখান থেকে বাংলাদেশি সিনেমা কিন্তু দারুণভাবে ফিরে এসেছে।’

প্রসঙ্গ ‘মেকআপ’
কয়েক বছর সেন্সর বোর্ডে আটকে থাকার পর মাসখানেক আগে মুক্তির অনুমতি পায় ‘মেকআপ’। মুক্তির পর ছবিটি দেখেছেন তারিক আনাম খান। বললেন, ‘এমনিতে গল্পের টানটান ব্যাপার আছে। তবে নিজের সিনেমা দেখলে খুতখুতানি লাগে। এটা ঠিক হলো না। এ রকম দরকার ছিল। এটা তো ঠিক করি নাই। নানা অসংগতি চোখে পড়ে।’ তবে পরিচালক অনন্য মামুন গল্পটা ভালো বাছাই করেছেন, এমনটাই জানালেন তারিক আনাম খান।

‘মেকাপ’ সিনেমার পোস্টার। নির্মাতার সৌজন্যে

বলেন, ‘শোবিজের ওপর একটা বক্তব্য আছে। যদিও এই সিনেমা আর বাস্তব পুরোপুরি আলাদা। ৫–৬ বছর আগের সিনেমা। এখন বানালে হয়তো আরো অন্য রকম হতো। সঠিক সময়ে ছবি মুক্তি পাওয়াও একটা ব্যাপার। অনেকে বলছে, অতিরঞ্জনও আছে। সিনেমার গল্প ও কাহিনিচিত্রে অতিরঞ্জন থাকবে, সবটা তো বাস্তব থেকে নেয় না। যদি বাস্তব থেকে নেয় তাহলে সেটা ডকুমেন্টারি হয়ে যাবে।’

অভিনয়শিল্পী সংঘ
ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানের পর টেলিভিশন নাটকের অভিনয়শিল্পীদের সংগঠন অভিনয়শিল্পী সংঘের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে। সংস্কার থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি দাবি নিয়ে সমাবেশও হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৮ সেপ্টেম্বর জরুরি সাধারণ সভা ডাকে অভিনয়শিল্পী সংঘ।

তারিক আনাম খান। প্রথম আলো

শিল্পীদের তোলা সংস্কারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান কমিটিকে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত রেখে অন্তর্বর্তী সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছে। চার মাস মেয়াদি নতুন এই কমিটির প্রধান করা হয়েছে তারিক আনাম খানকে। তিনি জানালেন, আগামী ৩১ জানুয়ারি সংগঠনটির সাধারণ সভায় সংস্কারের পুরো বিষয়টি তুলে ধরা হবে।

তারিক আনাম বলেন, ‘সংস্কৃতি অঙ্গনের বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেছি। ৩১ জানুয়ারি সাধারণ সভায় সব প্রকাশ করব। তারপর যাঁরা অভিনয়শিল্পী সংঘে আছেন, তাঁরা যদি মনে করেন, এটা গ্রহণীয়; করবেন। আমরা এখানে পেশাজীবী হিসেবে পেশাদারি জায়গাটা দেখার চেষ্টা করেছি। একজন অভিনয়শিল্পীর জন্য কী কী এভিনিউ খোলা যায়, সুবিধার জন্য কী করা যায়, এসব নিয়ে আমরা কাজ করেছি। সবকিছুর মধ্যে রাজনীতি থাকে। একজন কেউ দল করতেই পারে, সমর্থন করতে পারে, তবে সেটা তাঁর একান্তই ব্যক্তিগত জায়গা। এসবের প্রভাব সংগঠনে যেন প্রবেশ না করে—এটা নিয়ে কাজ করেছি। দায়িত্ব নেওয়ার পর একটা বিবৃতি দিয়েছিলাম, বিভেদ বিভাজন নয়। সত্যিকার অর্থে এখনো বলছি, বিভেদ বিভাজন নয়। ঐক্যই আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার।’

আরও পড়ুন