টিকে থাকার লড়াইয়ে এফডিসির জুনিয়র শিল্পীরা

এফডিসির বাগানে সিনেমার কাজের অপেক্ষায় দিনের পর দিন কেটে গেলেও ধুঁকতে থাকা চলচ্চিত্রে কোনো কাজ মিলছে না জুনিয়র শিল্পীদেরমকফুল হোসেন

ধুঁকতে থাকা ঢাকাই চলচ্চিত্রে কাজ কমে আসায় অভিনয়ের পাশাপাশি ঢাকার এক হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ নিয়েছিলেন সাথী; দেড় মাস পর সেখানে কাজ হারিয়ে মগবাজারের এক সুপারশপে কাজ নিয়ে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে চেয়েছিলেন, দিন চারেক পর সেখানেও কাজ হারিয়ে অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে শাবানা, জসিম, রাজীবদের সঙ্গে কাজ করা এই শিল্পীর।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) আমতলায় দিনের পর দিন কাজের জন্য অপেক্ষায় থাকেন সাথী, কাজ আর মেলে না। সাথী জানালেন, তিন মাস ধরে ঢাকায় কোনো ঠিকানা নেই তাঁর, কোথাও জায়গা না পেয়ে পেয়ারাবাগ বস্তিতেও কয়েক দিন থাকতে হয়েছে তাঁকে। শাবানা-জসিমের হিংসা সিনেমায় চিত্রনায়িকা শাহনাজের বান্ধবীর চরিত্রে রুপালি পর্দায় যাত্রা শুরু করেন তিনি, তারপর অসংখ্য চলচ্চিত্রে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাথী। সাথীর মতো অভিনয়শিল্পীরা এফডিসিতে একসময় ‘এক্সট্রা’ হিসেবে পরিচিতি ছিলেন। পরে তাঁদের ‘জুনিয়র আর্টিস্ট’ নাম দেওয়া হয়।

দর্শকেরা সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার দুই দশক ধরে ক্রমেই চলচ্চিত্র নির্মাণ কমে এসেছে। আবার সমকালীন চলচ্চিত্রের ধরন পাল্টে যাওয়ায় জুনিয়র শিল্পীদের চাহিদাও কমে গেছে। কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী টিকে থাকলেও জুনিয়র শিল্পীদের অনেকেই পেশা ছেড়েছেন। মাঝে করোনা মহামারির মধ্যে অনেকে গ্রামে ফিরে গেছেন। করোনাভাইরাসের ক্ষত সেরে উঠতে না উঠতেই লাগামহীন দ্রব্যমূল্য জেঁকে ধরেছে সাথীদের।
কান্নাজড়ানো কণ্ঠে সাথী বললেন, ‘এখন এফডিসিতে কোনো কাজ নেই, আমি অনেক দিন পেয়ারাবাগ বস্তিতে ঘুমিয়েছি। আপাতত একটি মেসে উঠলেও কত দিন থাকতে পারব, তা জানি না। বলতে গেলে, ঢাকায় আমার এখন কোনো ঠিকানা নেই। আমি কী করে খাব? একটা হাসপাতালে চাকরি নিছিলাম। দেড় মাস কাজ করেও অর্ধেক মাসের টাকা দিয়েছে। পরে আরেকটা সুপারশপে কাজ নিয়েছিলাম। আমার হাতটা কেটে যাওয়ায় মেশিন মুছতে পারিনি বলে ওরা আমাকে বের করে দিয়েছে।’
আরেক জুনিয়র শিল্পী হাসি জানালেন, সিনেমায় কাজ না পেয়ে হাজারীবাগে পিঠার দোকান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছেন, এর মধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। তিনি বললেন, ‘কেরোসিনের অনেক দাম, কিনে পোষাতে পারি না। কীভাবে জীবন চলবে? দোকান খুললেও লাভ হয় না। আটটার পর দোকান বন্ধ করে দিতে হয়।’ সপ্তাহে এক দিন কাজের আশায় এফডিসিতে আসেন হাসি। কখনো কখনো আসা-যাওয়ার ভাড়াও থাকে না বলে জানান তিনি।

হাসির আক্ষেপ, ‘করোনাভাইরাসের মধ্যে কোথাও এক কেজি চাল পর্যন্ত পাইনি। আমার এমনও দিন গেছে, আমি না খেয়ে ভাত-তরকারির পাতিলে পানি দিয়ে রাখছিলাম, যাতে কেউ না বলতে পারে। কোনো ত্রাণ পাইনি। আর কী বলব, বলার আর ভাষা নেই।’

সিলেটের মেয়ে পলি ইয়াসমিন নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই কয়েক দশক আগে এফডিসিতে এসেছিলেন
মকফুল হোসেন

প্রিয় অভিনয়শল্পী আলমগীর ও শাবানাকে দেখতে শৈশবে এফডিসিতে এসেছিলেন ফরিদপুরেরর মেয়ে হাসি। পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু তাঁকে নায়িকার ছোটবেলার চরিত্রে নিয়েছিলেন, নাগরানীসহ বেশ কয়েকটি সিনেমায় শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ করেন তিনি। বীর বাহাদুর, মেঘমালাসহ বেশ কয়েকটি সিনেমায় কাজ করেছেন তিনি। সবশেষ শাবনূরের সঙ্গে মুঘল-ই-আজম সিনেমায় কাজ করেছেন হাসি। তিনি স্বপ্ন দেখেন, আবার সিনেমার অবস্থা ভালো হবে, সিনেমায় মা কিংবা ভাবির চরিত্র পাবেন। তাঁর নায়িকা হওয়ার কোনো শখ ছিল না বলে জানালেন হাসি।
হাসির নায়িকা হওয়ার শখ না থাকলেও সিলেটের মেয়ে পলি ইয়াসমিনের নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্ন নিয়েই কয়েক দশক আগে এফডিসিতে এসেছিলেন তিনি। তবে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি, পার্শ্ব শিল্পী হিসেবেই জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন পলি। মান্নার সঙ্গে গরিব কেন কাঁদে সিনেমায় একজন প্রতিবাদী গ্রামবাসীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। পরবর্তী সময়ে শাকিব খানের সঙ্গে মায়ের জিহাদসহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে দেখা গেছে পলিকে।

একটা সময় এফডিসির অবস্থা রমরমা থাকলেও এখন সুনসান অবস্থা দেখে কষ্ট লাগার কথা জানালেন পলি। তিনি বলেন, ‘আগে যখন এফডিসিতে আসতাম, তখন মনে হতো মেলায় আসছি। জায়গায় জায়গায় নাচ, ফাইট হচ্ছে। তো এগুলো আর নাই। ২০১৩ সালের পর থেকে আস্তে আস্তে কাজ কমে এল। এখন কোনোরকম জীবনটা চলছে। ফিল্মটাকে ভালোবাসি বলে ঢাকা ছাড়তে পারি না। আমি যেতে চাই না, এটা আমার প্রাণের এফডিসি। এখানে আসতেই হবে আমাকে। আমার প্রাণের নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে দেখা করতে হবে।’

সিনেমায় কাজ কমে আসায় এখন বিভিন্ন স্কুলের বাচ্চাদের নাচ শিখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন পলি। মাঝে বিত্তবান আত্মীয়স্বজন তাঁকে সহযোগিতা করেন বলে জানান, মাঝেমধ্যে এফডিসি থেকেও সহযোগিতা পান।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সদস্যপদ পাননি অনেকে। ফলে কাগজে-কলমে অভিনয়শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতিও মেলেনি তাঁর। এ বিষয়ে শিল্পী সমিতির সহসাধারণ সম্পাদক সাইমন সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে ৮৪ জনকে সদস্যপদ দেওয়া হয়েছে, পরে আবার তালিকা করা হলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সদস্যপদ দেওয়া হবে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সদস্যপদ পেতে ন্যূনতম ১০টি চলচ্চিত্রে উল্লেখযোগ্য চরিত্রে অভিনয় করতে হবে।