গানে আছেন, আছেন অভিনয়েও

আনান সিদ্দিকা। ছবি : অভিনেত্রীর সৌজন্যে

লন্ডনভিত্তিক ব্যান্ড ‘লক্ষ্মীটেরা’র ভোকালিস্ট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন আনান সিদ্দিকা; সঙ্গে নৃত্য ও অভিনয়েও আলো কেড়েছেন তিনি। সম্প্রতি মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার জিতেছে তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘বাড়ির নাম শাহানা’।

আনান সিদ্দিকা। ছবি : অভিনেত্রীর সৌজন্যে

কৈশোর পেরোনোর আগেই শাহানাবাড়ির মেয়ে দীপাকে বিয়ে দেওয়া হয়। স্বামীর শোষণের জাল ছিঁড়ে নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছেন তিনি। নব্বইয়ের দশকের দৃঢ়চেতা নারী দীপার বেঁচে থাকার লড়াইয়ের গল্পে নির্মিত হয়েছে ‘বাড়ির নাম শাহানা’। এতে দীপা চরিত্রে প্রাণ দিয়েছেন আনান সিদ্দিকা। এটি নির্মাণ করেছেন ‘রাইজিং সাইলেন্স’ নির্মাতা লিসা গাজী; গল্পও তাঁর। লিসার সঙ্গে যৌথভাবে সিনেমার চিত্রনাট্যও লিখেছেন আনান।

আরও পড়ুন

দেড় দশকের ক্যারিয়ারে সংগীতশিল্পী, মঞ্চশিল্পী ও নৃত্যশিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেলেও অভিনয় খুব একটা করা হয়নি আনানের। দেড় দশকের বেশি সময় লন্ডনে বাস করেছেন তিনি। লন্ডনে থাকাকালে লেখিকা ও নির্মাতা লিসা গাজীর সঙ্গে আনানের পরিচয়, বন্ধুত্ব। ২০২০ সালের দিকে লিসা গাজীর কাছে সিনেমার গল্প শোনেন আনান।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আনান সিদ্দিকা বলেন, ‘লিসা আপা গল্পটা শুনিয়ে আমাকে বললেন, ‘আমি তোকেই কেন জানি এই চরিত্রে দেখি।’ দীপা চরিত্রটি পড়ে আমি ভীষণ রোমাঞ্চিত হয়েছি।’

এক বছরের মধ্যে লিসা গাজীর সঙ্গে চিত্রনাট্যের কাজটা শেষ করেছেন আনান, তাঁর ভাষ্যে, ‘গল্প নিয়ে আলাপ করতে করতেই সিনেমার দৃশ্য ভাবছিলাম। চিত্রনাট্যের জন্য লিসা আপা আমাকে কেন ভরসা করেছিলেন, জানি না। উনি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক, অনেক চিত্রনাট্য লিখেছেন। কখনো সেভাবে লিখিনি আমি।’

গাইছেন আনান সিদ্দিকা। ছবি : অভিনেত্রীর সৌজন্যে

দীপা চরিত্রে লিসা গাজী ও আনান সিদ্দিকার জীবনের ছায়া রয়েছে। আনানের ভাষ্যে, ‘নব্বইয়ের দশকে আমাদের দেখা মানুষের আদলে চরিত্রটি নির্মিত হয়েছে। দীপার মতো বহু মানুষকে আমরা খুব কাছ থেকে দেখেছি।’

এই সিনেমা-যাত্রায় নির্মাতা লিসা গাজীর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা জানিয়ে আনান বলেন, ‘আমাদের ভেতরের যেই সৃজনশীল অনুরণন ঘটেছে, সেটি ছাড়া এই সবকিছুই সম্ভব হতো না।’

সিনেমাটি প্রযোজনা করেছে লন্ডনভিত্তিক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কমলা কালেক্টিভ। ২০২১ সালে সিনেমাটির দৃশ্যধারণ শুরু হয়। যুক্তরাজ্য ও ঢাকার বাইরে দৃশ্যধারণ হয়েছে। গত বছরের শুরুতে সিনেমার নির্মাণকাজ শেষ হয়।

‘বাড়ির নাম শাহানা’ সিনেমার দৃশ্য। ছবি : প্রযোজনা সংস্থার সৌজন্যে

গত ২৭ অক্টোবর থেকে ৫ নভেম্বর আয়োজিত ভারতের জিও মামি মুম্বাই চলচ্চিত্র উৎসবে ‘জেন্ডার সেনসিটিভিটি অ্যাওয়ার্ড’ পায় সিনেমাটি। আরও কয়েকটি উৎসব ঘুরে আগামী বছর বাংলাদেশ ও বিশ্বজুড়ে সিনেমাটি মুক্তি দেবে পরিবেশক প্রতিষ্ঠান গুপী বাঘা প্রডাকশন লিমিটেড।

এতে আরও অভিনয় করেছেন লুৎফর রহমান জর্জ, ইরেশ যাকের, কাজী রুমা, কামরুন্নাহার মুন্নী, মুগ্ধতা মোর্শেদ ঋদ্ধি, আমিরুল হক চৌধুরী, নায়লা আজাদ, আরিফ ইসলাম, নাইমুর রহমান আপন, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।

‘বাড়ির নাম শাহানা’র পোস্টার। ছবি : অভিনেত্রীর সৌজন্যে

‘বাড়ির নাম শাহানা’ দিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে নাম লেখালেও আনানকে এর আগে ২০১৭ সালে তরুণ নির্মাতা আবরার আতাহারের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘লাইফ ইন আদার ওয়ার্ডস’–এ দেখা গেছে তাঁকে। শৈশবে মুহম্মদ জাফর ইকবাল বুবুনের বাবা অবলম্বনে নাটকে অভিনয় করেছেন আনান।

আনানের ভাষ্যে, ‘আমি কখনো ভাবিনি, অভিনয়শিল্পী হব। আমি নৃত্যশিল্পী ও সংগীতশিল্পী হতে চেয়েছি। শৈশবে শখের বশে “বুবুনের বাবা”র জন্য অডিশন দিয়ে টিকেছিলাম। আবরার আতাহারের স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাটি করে অভিনয়ে উৎসাহ পেয়েছি। লিসা আপা বলার পর ভাবলাম, অভিনয়েও নিজেকে এক্সপ্লোর করতে চাই। ’

মঞ্চে আনান সিদ্দিকা। ছবি : অভিনেত্রীর সৌজন্যে

লিসা গাজীর পরের সিনেমায়ও পাওয়া যাবে আনানকে; পাশাপাশি চিত্রনাট্যেও করছেন তিনি। সিনেমার পাশাপাশি মঞ্চনাটকেও কাজ করেছেন তিনি। কমলা কালেক্টিভ, কালচারপট গ্লোবাল ও তারা আর্টসের উইমেন অব শেকস্‌পিয়ার, ডেমনস রিভেঞ্জ ও বনবিবি—ডটার অব ফরেস্ট–এ যুক্ত ছিলেন তিনি।

লক্ষ্মীটেরা–অধ্যায়
ঢাকার মেয়ে আনান আইনে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে ২০০৬ সালে লন্ডনে পাড়ি জমান। ২০০৮ সালের দিকে ভোকালিস্ট হিসেবে যোগ দেন লক্ষ্মীটেরা ব্যান্ডে। আনানের ভাষ্যে, লক্ষ্মীটেরার সঙ্গে যাত্রাটা অনেক কঠিন ছিল; ব্যান্ডটি লাতিন, জ্যাজের সঙ্গে বাংলার মেলবন্ধন করে। ব্যান্ডের এই ভাবনাগুলো ধারণ করতেই তিন-চার বছর লেগেছে। এরপর বুঝেছি, গানে অনেক চর্চা, অনুশীলন ও নিবেদনের ব্যাপার আছে। ’

দেড় দশকের মতো লন্ডনের জীবনে ১৪ বছরের মতো লক্ষ্মীটেরা ব্যান্ডে ছিলেন আনান। গানের সঙ্গে নৃত্য, থিয়েটারও করতেন। ছুটিছাটায় ঢাকায় এসেও টুকটাক কাজ করতেন। করোনাভাইরাস মহামারিকালে ঢাকায় বাবা–মায়ের কাছে ফিরেছেন আনান। গুলশানে বাবা–মায়ের সঙ্গে থাকছেন। এখন থেকে ঢাকায় থাকবেন, নিয়মিত গানের শো করবেন। মাঝে মাঝে লন্ডনেও গিয়ে কাজ করবেন।

লোকগান, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলের গান করতে ভালোবাসেন আনান। তিনি জানান, ঢাকায় থিতু হওয়ায় বছরখানেক আগে লক্ষ্মীটেরা ছেড়েছেন তিনি। ঢাকায় শো করার পরিকল্পনা করছেন; তাঁর সঙ্গে কে বাজাবেন, তা ঠিকঠাক করেই ঢাকার মঞ্চে উঠবেন।
‘অনেক দিন বড় কোনো স্টেজ শো করিনি, বুকটা খাঁ খাঁ করছে শো করার জন্য।

‘বাড়ির নাম শাহানা’ সিনেমার দৃশ্য। ছবি : প্রযোজনা সংস্থার সৌজন্যে

পাশাপাশি অভিনয়ের জন্যও অডিশন দিতে চাই’, বলছিলেন লক্ষ্মীটেরার সাবেক ভোকালিস্ট আনান। লক্ষ্মীটেরার সঙ্গে দলগতভাবে ওয়ার্ল্ড অব মিউজিক, আর্টস অ্যান্ড ড্যান্স ফেস্টিভ্যাল, বিবিসি রেডিওতে গান করেছেন তিনি।

পাকিস্তানের মিকাল হাসান ব্যান্ড, ভারতের লোকসংগীতশিল্পী অর্ক মুখার্জির সঙ্গেও কাজ করেছেন আনান। ভারতীয় তথ্যচিত্র ‘দ্য সেইন্টস অব শিন’–এও কাজ করেছেন তিনি; তথ্যচিত্রটির প্রচারণায়ও তাঁর গান ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রায় দুই দশক ধরে তিনি ভারতনাট্যম ও কত্থক নৃত্য চর্চা করছেন। মা নার্গিস সিদ্দিকার অনুপ্রেরণায় শৈশবে নাচ শিখেছেন তিনি। আনান পেশায় আইনজীবী, মিউজিক কপিরাইট আইনের ওপর পিএইচডি করেছেন।