‘ডুমুরের ফুল’, ‘ডানপিটে ছেলে’র শাকিল ফিরছেন
‘এই ছেলে, তুমি না মারা গেছ?’ একটা সময় এমন কথা শুনে হাসতেন আজাদ রহমান শাকিল। কারণ, অনেক সিনেমাতেই তাঁর চরিত্রের মৃত্যু ঘটত। রাস্তায় কিংবা স্কুলে, এমনকি বাজারেও কেউ কেউ সিরিয়াস মুখে এসে বলতেন, ‘তুমি তো মারা গেছ!’
সত্তর-আশির দশকে শিশুশিল্পীদের নিয়েও সিনেমার গল্প লেখা হতো। সিনেমার কেন্দ্রে তারা থাকত। সেই সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন শাকিল, ‘মাস্টার শাকিল’ নামেই পরিচিত ছিলেন বেশি। একসময় ছিলেন ঢাকাই সিনেমার শিশু চরিত্রে নিয়মিত মুখ, দর্শকের চোখের মণি। ‘ডুমুরের ফুল’, ‘পুরস্কার’ কিংবা ‘ডানপিটে ছেলে’র মতো ছবিতে কাঁদিয়েছেন-হাসিয়েছেন, সেই শাকিল দীর্ঘ ২৮ বছর ছিলেন আড়ালে। এবার ফিরছেন। বললেন, ‘কখনো অভিনয় ছাড়িনি। এটাই আমার প্রশান্তির জায়গা।’
শিশুশিল্পী থেকে জাতীয় স্বীকৃতি
শাকিলের প্রথম সিনেমা ডুমুরের ফুল, পরিচালক সুভাষ দত্ত। এরপর একে একে ‘পুরস্কার’, ‘ডানপিটে ছেলে’, ‘এতিম’, ‘কলমীলতা’, ‘দেবদাস’, ‘আঘাত’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘সৎমা’, ‘ঘর সংসার’সহ ১৪টি ছবিতে অভিনয়। তিনটি ছবিতে শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সিনেমার বাইরে টেলিভিশনেও ছিল তাঁর দাপুটে উপস্থিতি। ঢাকায় থাকি, সংশপ্তক, মাটির কোলেসহ শতাধিক নাটকে অভিনয় করেছেন। তাঁর শুরুটা হয়েছিল মঞ্চ থেকে, ১৯৭৬ সালে আবু সাঈদ খানের নির্দেশনায় ‘বাপ্পু কেন কাঁদে’ নাটকে। এরপর বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘শিশুমেলা’ ও ‘নতুন কুঁড়ি’ প্রতিযোগিতায় একক অভিনয়, ছড়াগান ও পল্লিগীতিতে পুরস্কার।
দীর্ঘ বিরতি এবং ফেরা
চলচ্চিত্রে শাকিলের শেষ কাজ ছিল খান আতাউর রহমান পরিচালিত এখন অনেক রাত, ১৯৯৭ সালে। এরপর শাকিলকে আর বড় পর্দায় দেখা যায়নি। দীর্ঘ এ বিরতির পেছনে কোনো অভিমান ছিল? প্রশ্নের জবাবে শাকিল বললেন, ‘যাঁরা আমাকে নির্মাণ করতেন—সুভাষ দত্ত, চাষী নজরুল ইসলাম, আতা চাচা—তাঁরা চরিত্র বানাতেন ভালোবাসা দিয়ে। তাঁদের সঙ্গে একটা মানসিক বোঝাপড়া ছিল। পরবর্তী সময়ে সে সম্পর্ক আর তৈরি হয়নি। আবার যাঁরা ডাকতেন, তাঁদের কাজ বা চরিত্র আমাকে টানত না।’
২৮ বছর আগে সর্বশেষ বড় পর্দায় অভিনয় করলেও এখনো অনেকেই গুগল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শাকিলের খোঁজ করেন। হাসতে হাসতে শাকিল বলেন, ‘অনেকেই এখনো আমার খোঁজ করেন, ভালো লাগে। এত বছর আগের কাজ নিয়ে যখন আলাপ হয়, তখন মনে করি, হয়তো মানুষের মনে দাগ কাটতে পেরেছিলাম।’ সে সময়ের খ্যাতির বিড়ম্বনার কথাও তুলে ধরেন শাকিল। বলেন, ‘অনেক সিনেমায় তো আমার চরিত্রের মৃত্যু হয়েছে, তো এমনও হয়েছে, আমাকে দেখে কেউ বলছেন, “এই ছেলে, তুমি না মারা গেছ?” অনেক মজা পেতাম। স্কুল কিংবা বাইরে গেলেই মানুষ ভিড় করতেন। এটা মনে পড়ে।’
দীর্ঘ বিরতির পর ফিরছেন শাকিল। অভিনয়ের পাশাপাশি এবার পরিচালনাও করবেন। নিজের নির্দেশনায় নির্মিতব্য একটি নাটকে অভিনয় করবেন তিনি। চিত্রনাট্যের কাজ শেষ, শুটিং শুরু হবে আগামী মাসের শুরুতেই। ‘কয়েকটি কাজের পরিকল্পনা করেছি। একটির নির্মাণ শিগগিরই শুরু করব। এরপর একে একে বাকিগুলো,’ বললেন শাকিল।
শাকিল এখন
পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দা আজাদ রহমান শাকিল বর্তমানে গেন্ডারিয়ায় বসবাস করছেন। নিজের ব্যবসা আছে। ২০১৮ সালে বিয়ে করেন খালেদা রহমানকে। তাঁদের দুই পুত্র—তাবরেজ রহমান ও ফাওয়াদ রহমান। অভিনয়ের বাইরে গানবাজনায়ও সক্রিয় শাকিল। নিজেই লেখেন, সুর করেন। এরই মধ্যে তাঁর তিনটি গানের অ্যালবাম প্রকাশ পেয়েছে। বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই গান করতাম। এখন অ্যালবামের যুগ নেই। তবে আসরে গিয়ে পুরোনো গান করি, সিনেমার গান করি।’ সংসার, গান, লেখা, নির্মাণ আর অভিনয়—সব মিলিয়ে আবারও শুরু হচ্ছে শাকিল–অধ্যায়ের নতুন পর্ব।
শাকিলের সময় দেশে ছিল প্রায় ১ হাজার ৫০০ সিনেমা হল। এখন তা শতাধিকে নেমে এসেছে। বিষয়টি তাঁকে ব্যথিত করে। তবে সাম্প্রতিক কিছু সিনেমার সাফল্যে তিনি আশাবাদী। ‘একসময় সিনেমা মুক্তি মানেই উৎসব। হলগুলো গমগম করত। এখন সেই জায়গাগুলোতে মার্কেট কিংবা পরিত্যক্ত ভবন। তবে এখনো যখন দেখি মানুষ সিনেমা দেখছে, হলে যাচ্ছে, তখন আনন্দ পাই,’ বললেন শাকিল।
শাকিল ফিরে আসুন, শাকিলের সময়ের চলচ্চিত্রের সেই উজ্জ্বল দিন আবার ফিরে আসুক, আমাদেরও সে প্রত্যাশা।