‘বেহুলা নাচারি’ নিয়ে ‘বেহুলা দরদী’

‘বেহুলা দরদী’ ছবির একটি দৃশ্যছবি: নির্মাতার সৌজন্যে

২০১৭ সালের কথা। ঢাকার নাখালপাড়ায় বেড়ে ওঠা অভিনেত্রী সূচনা শিকদার গেলেন শ্বশুরবাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুরে। গ্রামে কিছুদিন থাকার পর জানতে পারেন, তাঁর স্বামীর পরিবারের সবাই একসময় টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী গীতিনাট্য বেহুলা নাচারির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই বেহুলা নাচারিতে নৃত্যের সঙ্গে গান পরিবেশন করা হতো, যা এখন প্রায় বিলুপ্তের পথে। সেই সময়ে শ্বশুর তাঁকে বেহুলা নাচারি এবং এই হারিয়ে যেতে বসা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে বলেন। কীভাবে তাঁরা এখনো কিছুটা টিকিয়ে রেখেছেন, তা জানান। প্রায় ২০০ বছর ধরে চলে আসা এই গীতিনাট্যের কথা শুনে ভালো লেগে যায় সূচনার।

বেহুলা নাচারিতে নৃত্যের সঙ্গে গান পরিবেশন করা হতো, যা এখন প্রায় বিলুপ্তের পথে
ছবি: নির্মাতার সৌজন্যে

সূচনার স্বামী পরিচালক সবুজ খান। তিনি সবুজকে জানান, এ ঘটনা নিয়ে সিনেমা বানানো উচিত। প্রস্তাবটা মন্দ নয়। সবুজ জানান, এই নৃত্য ছিল একসময় গ্রামের মানুষের জীবনের অন্যতম বিনোদনের উৎস। তাঁর বাবা-দাদা ও পূর্বপুরুষদের হাত ধরেই এই বেহুলা নাচারির নৃত্যের পরিসর বেড়েছে। একসময় নিয়মিত আসর বসেছে। কয়েক গ্রামের মানুষ এই নৃত্য ও পালা দেখতে ভিড় করেছে।
‘আমার শৈশব থেকেই দেখেছি বেহুলা নাচের গীতিনাট্য। এটা ছিল আমাদের জীবনের একটা অংশ ছিল। বাপ-দাদারাই ছিলেন এর প্রধান। আমাদের বাড়িতে ও আশপাশে এই আয়োজন হতো। দল ধরে মানুষ আসতেন দেখতে। এখন আর এই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের চল নেই। পরে আমার স্ত্রী বললেন, “জনপ্রিয় এই শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে। হয়তো একদিন একেবারেই হারিয়ে যাবে। তার আগেই এটি সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মকে জানানো উচিত।” আমি একমত হই। একই সঙ্গে এর সঙ্গে জড়িত মানুষদের সম্মান দিতেই সিনেমাটি বানানোর পরিকল্পনা করি,’ বলেন সবুজ।

আরও পড়ুন

২০২০ সালে চিত্রনাট্যের কাজ শুরু করেন সবুজ। আগে থেকেই সব দেখা ও জানা ছিল, যা চিত্রনাট্য ও নির্মাণকে কিছুটা সহজ করে দেয়। সেগুলো নিয়েই গত বছর ‘বেহুলা দরদী’ নামে সিনেমার শুটিং শুরু করেন। শুটিং লোকেশন হিসেবে বেছে নেন তাঁদের গ্রাম। নির্মাতা বলেন, ‘যদি এখনো আমাদের এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থাকত, তাহলে হয়তো বংশপরম্পরায় আমিও এর সঙ্গে থাকতাম। যেহেতু বিলুপ্তির পথে, সে কারণে আমাদের প্রজন্মের পর থেকে এই বেহুলা নাচের সঙ্গে কেউ যুক্ত নেই। কিন্তু এটা আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। এখনো আমার বাবার মুখে গল্প শুনে আপ্লুত হই। আমার দেখা গল্পটাই আমি বলছি।’

‘বেহুলা দরদী’ সিনেমার একটি দৃশ্য
ছবি: নির্মাতার সৌজন্যে

সবুজ জানান, ‘বেহুলা নাচারির পালা’কে উপজীব্য করে গল্পটি লিখেছেন। এটি ২০০ বছর আগের পালা। প্রথম এই পালা লিখেছিলেন কিশোরগঞ্জের এক নারী। সেই থেকেই এই পালা কখনো ‘বেহুলা নাচারি’, কখনো ‘বেইলা নাচানি, ‘বেইলা সতী’, ‘বেইলা সুন্দরী’, ‘বেইলা-লখিন্দর’ নামেও মঞ্চায়িত হয়। এতে বেহুলা, মনসা, সনেকা, নরেকা, দাসী ইত্যাদি চরিত্রে পুরুষেরা নারী সেজে সংলাপ ও নৃত্যগীতে অংশ নেন। এসব চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফজলুর রহমান বাবু, প্রাণ রায়, সূচনা শিকদার, আশরাফুল আশীষ, আফফান মিতুল, মেরাজুল ইসলাম, আজিজুন মিম।

আরও পড়ুন

এ সিনেমা দিয়েই ঢালিউডে নির্মাতা হিসেবে অভিষেক ঘটছে সবুজের। সিনেমায় তিনি তুলে ধরেছেন নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকের গল্প। এর সঙ্গে যুক্ত মানুষের জীবনযাপন কেমন ছিল, সেটা। সিনেমাটি আগামীকাল ৯টি হলে মুক্তি পাবে। পরিচালক বলেন, ‘সবাই আমরা বাঙালি সংস্কৃতির কথা বলি। কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতির এই ঐতিহ্যের গল্পটি অনেকে সিনেমা হলই চালাতে চাইছে না। অনেকেই মনে করছেন, সিনেমাটি চলবে না। কিন্তু তার আগে তো সিনেমা হলে চালিয়ে দেখা উচিত।’