কবরীর সঙ্গে পর্দার প্রথম প্রেম: পাঁচ নায়কের স্বপ্নযাত্রা

কবরী ও বাংলাদেশি সিনেমার সোনালী দিনের ৫ নায়ককোলাজ

চলচ্চিত্রের ‘মিষ্টি মেয়ে’ কবরী ছিলেন বাংলা সিনেমার এক অনন্য নাম—যাঁর হাসিতে, চোখের ভাষায় আর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। ষাটের দশকে চলচ্চিত্রে আবির্ভাবের পরই তিনি হয়ে ওঠেন রোমান্স, সৌন্দর্য ও শুদ্ধ অভিনয়ের প্রতীক। ‘সুতরাং’, ‘হীরামন’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘ময়নামতি’, ‘সারেং বৌ’, ‘দেবদাস’, ‘সুজন সখী’, ‘পারুলের সংসার’, ‘রংবাজ’, ‘বধূ বিদায়’, ‘আগন্তুক’, ‘বাহানা’ থেকে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’—সিনেমায় তিনি ছুঁয়ে গেছেন দর্শকের হৃদয়। অভিনেত্রী, নির্মাতা ও জননেত্রী—সব ভূমিকাতেই কবরী ছিলেন দৃঢ়, প্রেরণাদায়ী। তাঁর নাম উচ্চারিত হলেই যেন ভেসে ওঠে বাংলা চলচ্চিত্রের এক সোনালি সময়।

সারাহ বেগম কবরী
ছবি : প্রথম আলো

পাঁচ দশকের দীর্ঘ অভিনয়জীবনে শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন কবরী। কবরী বাংলাদেশের একমাত্র অভিনেত্রী, যাঁর বিপরীতে অভিষেক হয়েছিল পাঁচ নায়কের। বাংলাদেশি সিনেমার সোনালি যুগে কবরীর বিপরীতে অভিষেক ঘটা এই পাঁচ নায়ক পরবর্তী সময়ে ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছেন। বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিনয় দিয়ে তাঁরা জায়গা করে নিয়েছেন মানুষের হৃদয়ে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তাঁদের কেউ এখনো স্বপ্নের মানুষ। কবরীর বিপরীতে যে পাঁচ নায়কের অভিষেক ঘটেছে তাঁরা হলেন—উজ্জ্বল, ফারুক, আলমগীর, সোহেল রানা ও জাফর ইকবাল।

ষাটের দশকে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজারে বেড়ে ওঠা ভীরু ডাগর চোখের কিশোরী মিনা পাল মাত্র ১৪ বছর বয়সে নির্মাতা সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বড়পর্দায় যাত্রা শুরু করেন। কয়েক বছরের ব্যবধানে নির্মাতা জহির রায়হানের উর্দু ছবি ‘বাহানা’ ও নির্মাতা খান আতাউর রহমানের ‘সোয়ে নদীয়া জাগে পানি’সহ কয়েকটি চলচ্চিত্রে কবরীর চোখের চাহনিতে উত্তাল সারা দেশ।

সারাহ বেগম কবরী
ছবি : সংগৃহীত

তারকা কবরীর বিপরীতে নায়ক হিসেবে সোহেল রানার অভিষেক ঘটে সত্তরের দশকে; ১৯৭৪ সালের ২৪ মে মুক্তি পাওয়া ‘মাসুদ রানা’ চলচ্চিত্রে। অভিনয়ের পাশাপাশি ছবিটি প্রযোজনা–পরিচালনাও করেন সোহেল রানা। ক্যারিয়ারের প্রথম নায়িকা হিসেবে কবরীকে আজীবন ‘হিরোইন’ বলে সম্বোধন করেছেন সোহেল রানা; আর সোহেল রানাকে ‘পারভেজ ভাই’ বলে ডাকতেন কবরী।

কবরীর মধ্যে মানুষ আবহমান বাংলার চিরায়ত নারীর প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছিলেন বলে মনে করেন সোহেল রানা। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলার নারীদের প্রতিচ্ছবি হিসেবে আমরা যেমনটা অনুভব করি, কবরীকে তেমনভাবেই সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টিকর্তা।

কবরী ও সোহেল রানা
ছবি : প্রথম আলো

এখনকার নায়ক-নায়িকারা সবাই একই রকমভাবে কথা বলে। চুলে নানা রং করে। কিন্তু বাংলার সাধারণ নারীকে এমনটা কেউ কল্পনা করে না। বাংলার মানুষকে মিষ্টি মেয়ের কথা ভাবতে বললে, শুধু কবরীর কথাই ভাবে। সে কারণেই তাঁকে ‘মিষ্টি মেয়ে’ বলা হয়। বাংলার মানুষের অন্তর থেকে এ উপাধি এসেছে। এমনকি গ্রামে যাঁরা হালচাষ করেন তাঁরাও বলবেন কবরী মিষ্টি মেয়ে; কবরী বাংলার মেয়ে। কবরী তুলনাহীন। সি ওয়াজ জাস্ট আন প্যারালাল। ওই মিষ্টি মুখ বা ওই মিষ্টি হাসি বা ওই মিষ্টি অভিনয়—বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আসেনি এর আগে, এক কবরী ছাড়া। আগামী ৫০ বছরে আসবে বলেও আমার ধারণা নেই। আমি বিশ্বাস করি, শত বছরে কবরী একটাই জন্মায়।’

১৯৭০ সালে সুভাষ দত্তের ‘বিনিময়’ ছবিটি দিয়ে চলচ্চিত্রে ক্যারিয়ার শুরু করেন উজ্জ্বল

সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘বিনিময়’ চলচ্চিত্রে কবরীর বিপরীতে নায়ক হন উজ্জ্বল। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে। ‘বিনিময়’ সুপারহিট সিনেমা। এটি ছাড়াও কবরীর সঙ্গে উজ্জ্বল আরও কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেন নায়ক হিসেবে, ‘লালন ফকির’, ‘বলাকা মন’ ও ‘অনুরোধ’।

নায়িকা কবরী সম্পর্কে উজ্জ্বল বলেন, ‘কবরী যখন সুপারহিট নায়িকা তখন তাঁর বিপরীতে নতুন নায়ক হিসেবে সুভাষ দত্তের পরিচালনায় জীবনের প্রথম চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করি। প্রথম চলচ্চিত্রে কবরীর মতো জনপ্রিয় অভিনেত্রীকে নায়িকা হিসেবে পাওয়া ওই সময় আমার জন্য বড় বিষয় ছিল। কেননা, সে সময় কবরীর মতো জনপ্রিয় নায়িকা কেউ ছিলেন না, নায়িকা হিসেবে তাঁকে পেয়ে দেখেছি, কবরী খুব “ঠোঁট-কাটা স্বভাবের” ছিলেন। স্পষ্ট কথা বলতেন সব সময়। তবে আমি নতুন হলেও অসম্ভব সহযোগিতা করেছেন। তাঁকে সব সময় সহযোগিতাপরায়ণ নায়িকা মনে হয়েছে। এ জন্যই তিনি মিষ্টি মেয়ে-খ্যাত নায়িকা।’

জাফর ইকবাল
ছবি: সংগৃহীত

বাংলা সিনেমার চিরসবুজ নায়ক বলা হয় জাফর ইকবালকে। তিনি তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ‘আপন পর’ সিনেমা দিয়ে। বশির হোসেন পরিচালিত এই সিনেমায় কবরীর বিপরীতে নায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটে জাফর ইকবালের। সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭০ সালে। বাংলা চলচ্চিত্রের এক স্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে আছে ‘আপন পর’। কবরীর বিপরীতে প্রথমবার স্ক্রিনে হাজির হওয়া তিনি নতুন রোমান্স এবং চরিত্রের গভীরতা দর্শকের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন।

‘আপন পর’ সিনেমায় কবরীর বিপরীতে প্রথম নায়ক হিসেবে অভিষেক হয় জাফর ইকবালের

নায়ক ফারুকের অভিনয়জীবন শুরু হয় ১৯৭১ সালে। সিনেমার নাম ছিল ‘জলছবি’। এটি নির্মাণ করেছিলেন এইচ আকবর। সিনেমাটিতে ফারুক নায়িকা হিসেবে পেয়েছিলেন ওই সময়ের জনপ্রিয় কবরীকে। সিনেমায় অভিনয়ের আগে টুকটাক নাটকে অভিনয় করতেন। তার আগে শিল্পসত্তার সঙ্গে ফারুকের কোনো যোগ ছিল না। এগুলোকে গুরুত্বও দিতেন না; বরং শিল্পচর্চায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছেন তিনি। ফারুক নিজেই জানিয়েছিলেন, শৈশবে কোথাও নাটক হচ্ছে, সেখানে গিয়ে নাটক মঞ্চায়নের পরিবেশ নষ্ট করেছেন। কখনো ডিমও মেরেছেন। সেখান থেকে নাটকে আসার গল্পটাও নাটকীয়। তিনি একসময় শিল্পের প্রেমে পড়েন। ফারুকের মতে, নাটকে অভিনয় করে তাঁর জীবনে বড় একটা পরিবর্তন আসে। তখন বুঝতে পারেন, নাটকের সেট ভেঙে ফেলার কষ্ট। নাটক দিয়েই তাঁর অভিনয়ের শুরু। কিন্তু অভিনয় নিয়ে তাঁর নিজের ওপর নিজেরই আস্থা ছিল না।

‘সারেং বৌ’ ছবিতে কবরী ও ফারুক
ছবি: সংগৃহীত

প্রায়ই নাটকে অভিনয় করলেও হঠাৎ ফারুক সিনেমায় আসেন। বেঁচে থাকতে এক সাক্ষাৎকারে ফারুক বলেছিলেন, ‘একবার তিনি অনেকের সঙ্গে একটি রুমে বসে ছিলেন। সেখানে সিনেমার পরিকল্পনা করছিলেন এইচ আকবর, এ টি এম শামসুজ্জামানেরা। সিনেমার প্রায় সবকিছু প্রস্তুত। একজন জানতে চান, সিনেমার নায়ক কে হবে? এইচ আকবর জানান, কেন, ওই যে বসে ফারুক। পাশ থেকে আরেকজন জানান, ও তো ফারুক নন দুলু। আকবর জানান, সিনেমায় এখন থেকে ওর নাম হবে ফারুক। সেই থেকে দুলু দর্শকের কাছে ফারুক হয়ে ওঠেন।’ ‘জলছবি’ দিয়ে সিনেমার অভিনয়জীবন শুরু, যে ছবিতে নায়িকা তখনকার তুমুল জনপ্রিয় কবরী। ‘জলছবি’ সিনেমার শুটিং শুরুর আগে অনেকে ফারুককে নায়ক হিসেবে মানতে কবরীকে নিষেধ করেছিলেন। ফারুক এসব কথা জানান।

তিনি বলেছিলেন, ‘সিনেমায় নাম লেখাচ্ছি শুনে বেড়ে গেল সমালোচনা করার মানুষ। তাঁরা কেউ নায়ক হিসেবে মেনে নিতে পারছিলেন না। যে-ই শোনে, আমি নায়ক হয়েছি, সে-ই বলতে লাগল, আমি কীভাবে অভিনয় করব। আমি তো অভিনয় পারি না। আমি শুধু মারামারি পারি, আমি গালাগালি পারি। আমি নাকি উগ্র ধরনের লোক। আমার পথচলা থামানোর জন্য কবরীর সঙ্গেও অনেকে দেখা করেন। কিন্তু কবরী সেসবে পাত্তা দেননি।’ ‘জলছবি’ সিনেমার পর ‘সারেং বৌ’ এবং ‘সুজন সখী’র মতো জনপ্রিয় সিনেমা উপহার দিয়েছেন কবরী ও ফারুক।

আলমগীর
ছবি : প্রথম আলো

১৯৭৩ সালে পরিচালক আলমগীর কুমকুমের পরিচালনায় ‘আমার জন্মভূমি’ চলচ্চিত্রে প্রথমবার অভিনয় করেছিলেন আলমগীর; নায়িকা ছিলেন কবরী। আলমগীর জানান, তিনি তখন নবীন শিল্পী ছিলেন; জ্যেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে প্রথম ছবির শুটিংয়ে সব সময় খোঁজখবর রাখতেন কবরী। নিজের টাকায় চকি, চাদর কিনে এনে শুটিং সেটে আমাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা করতেন। আলমগীর বলেন, ‘কবরী আমাদের শ্রদ্ধেয় আপা। মানুষ হিসেবে দুর্দান্ত ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। আর শিল্পী হিসেবে যাচাই করার ক্ষমতা আমার নাই। যাচাই করতে চাওয়াটাও আমার জন্য ধৃষ্টতা।’

সারাহ বেগম কবরী
ছবি: প্রথম আলো

শুধু অভিনেত্রী হিসেবে নন, কবরী ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। জড়িয়ে পড়েছিলেন রাজনীতিতেও। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘স্মৃতিটুকু থাক’। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার, ঋষিজ পদকসহ দেশে-বিদেশে অসংখ্য সম্মাননা। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননাও।

১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে জন্ম কবরীর। প্রকৃত নাম মিনা পাল। বাবা শ্রীকৃষ্ণদাস পাল, মা লাবণ্যপ্রভা পাল। মাত্র ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে ওঠেন তিনি। এরপর আসেন টেলিভিশনে, তারপর সিনেমায়। ১৯৬৪ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান প্রথমবার। ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল মারা যান কবরী। ঢাকার বনানী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।