আফজাল চৌধুরীর নিভৃত বিদায়

আফজাল এইচ চৌধুরীসংগৃহীত

মাত্রই মুক্তি পেয়েছে ‘কখনো আসেনি’, অচিরেই শুরু হবে নতুন ছবি ‘কাচের দেয়াল’-এর কাজ। নিজের প্রথম ছবিটির চিত্রগ্রহণ নিয়ে পুরোপুরি তৃপ্ত ছিলেন না জহির রায়হান। তাই নতুন একজন চলচ্চিত্রগ্রাহক খুঁজছিলেন তিনি।

এই অঞ্চলের ১ নম্বর চলচ্চিত্রগ্রাহক তখন বেবী ইসলাম। পশ্চিমবঙ্গের অজয় করের কাছে ক্যামেরার কাজ শিখেছেন, উত্তম-সুচিত্রার ছবিতে কাজ করেছেন, এখন এই বাংলায় চলে এসেছেন। তাঁর কাছেই গেলেন জহির। আলাপ–আলোচনা সব ভালোই হলো। শেষে তাঁকে বললেন, ৩০ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। শুনেই আঁতকে উঠলেন বেবী, এত হুড়োতাড়ায় কাজ করে তিনি অভ্যস্ত নন। লাইট-টাইট করে দিনে খুব বড়জোর ৩টি শট নিতে পারবেন, সেখানে জহির কিনা তাঁর কাছে চাইছেন ১৫–২০টি শট। কিন্তু অত সময় দেওয়ার মতো বাজেট যে জহিরের নেই। অন্য ব্যবস্থা দেখতে বললেন বেবী। তাহলে কাকে নেওয়া যায়, এই চিন্তায় জহির রায়হান যখন জেরবার, তখন তাঁকে আফজাল চৌধুরীর কথা বললেন তাঁর নতুন ছবির নায়ক খান আতা।

ছোটবেলা থেকেই ছেলেটা আলোকচিত্রে আগ্রহী। এই আগ্রহের জেরেই প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে ১৯৫০ সালে আলোকচিত্রের কাজ শিখতে বোম্বাই চলে যান আফজাল চৌধুরী। কয়েক বছর সেখানে বোম্বের বিখ্যাত দুই চিত্রগ্রাহক ভাই জাল মিস্ত্রি-ফলি মিস্ত্রির কাছে কাজ শেখেন। তারপর ঢাকায় ফিরে ইউএসআইএসে কিছুদিন কাজ করে চলে যান পশ্চিম পাকিস্তান। এখন লাহোরের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন। সব শুনে জহির রায়হানের মনে হলো, পরীক্ষা করে দেখতে দোষ কী! রিটার্ন টিকিট আর একটা চিঠি দিয়ে খান আতাকে লাহোর পাঠালেন জহির রায়হান। চিঠিতে লিখলেন, তুমি এক মাসের জন্য ঢাকা আসো।

আরও পড়ুন

চিঠি পেয়ে ঢাকায় এলেন আফজাল চৌধুরী। তাঁর কাছে ঠিক কী চান, ব্রিফ করলেন জহির। একটা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারকে নিয়ে ছবি, শেষ সিকোয়েন্সটা বাদে পুরো ছবির কাহিনিই একটা বাড়ির ভেতরে ঘটবে। ফলে চিত্রগ্রহণ সব ইনডোরে হবে, আরও কিছু চাহিদা আছে। একটা চরিত্র এ ঘরে বসে আছে তো আরেকটা ১৫–২০ ফুট দূরে আরেক ঘরে; একজন ক্লোজ শটে, আরেকজন লং। কিন্তু দুজনকেই ফোকাসে চাই। শুনেই আফজাল বুঝলেন, লো কি লাইটিংয়ে ডিপ ফোকাস চাইছেন পরিচালক। অচিরেই দুজনের বনে গেল।

চিত্রগ্রাহক আফজাল চৌধুরী। আইএমডিবি

জহিরের চাহিদামতো স্বল্পতম সময়েই শেষ হলো ‘কাচের দেয়াল’ ছবির চিত্রধারণের কাজ। ঢাকায় এটাই আফজাল চৌধুরীর প্রথম ছবি। এরপর ঢাকায় প্রায় ১০০ ছবির চিত্রধারণ করেন। এর মধ্যে আছে পুরো পাকিস্তানের প্রথম সম্পূর্ণ রঙিন চলচ্চিত্র সঙ্গম (১৯৬৪), প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র বাহানা (১৯৬৫), প্রথম ‘ট্রিপল রোল’-এর চলচ্চিত্র জ্বলতে ‘সুরুজ কে নিচে’ (১৯৭০), প্রথম রাজনৈতিক ছবি ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০)। এই পাঁচ ছবিরই পরিচালক কিন্তু জহির রায়হান। এসব ছবিতে আলোকচিত্র নিয়ে অনেক ধরনের নিরীক্ষাই করেছেন আফজাল চৌধুরী।

ঢাকায় তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে আছে অনেক দিনের চেনা (১৯৬৪), আপন দুলাল (১৯৬৬), ‘নয়নতারা’ (১৯৬৭), ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ (১৯৬৭), ‘বাঁশরী’ (১৯৬৮), ‘মনের মত বউ’ (১৯৬৯)। স্বাধীনতার পরও অনেক দিন পর্যন্ত পাকিস্তানেই থেকে গিয়েছিলেন আফজাল চৌধুরী, এই সময়কালে অনেক ছবির চিত্রগ্রহণ করেন। এর মধ্যে আছে পাকিস্তানের সবচেয়ে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র ‘আয়না’। সব মিলিয়ে চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ৬৫ বছর।

চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০১৬ সালে আফজাল চৌধুরীকে ‘হীরালাল স্মারক সম্মাননা পদক’ প্রদান করে আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসব কর্তৃপক্ষ। বাংলা চলচ্চিত্রের কালজয়ী কিছু ছবির চিত্রগ্রাহক হয়েও জাতীয় কোনো সম্মাননা পাননি। সেই দুঃখ নিয়েই গত ৩১ আগস্ট রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন আফজাল চৌধুরী। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। স্ত্রী সুরাইয়া আফজাল ও দুই মেয়েকে রেখে গেছেন তিনি।

১ সেপ্টেম্বর বাদ জুমা বারিধারার বায়তুল আতীক জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় আফজাল চৌধুরীর জানাজা। আজ ৩ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জে তাঁকে সমাহিত করা হবে। এই সিরাজগঞ্জেই ১৯৩১ সালের ৩১ অক্টোবর জন্মেছিলেন আফজাল চৌধুরী।

তথ্যসূত্র: অনুপম হায়াতের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিকথা; ওমর শাহেদ ও বর্তমান প্রতিবেদক গৃহীত সাক্ষাৎকার; বিএমডিবি