‘গ্লিসারিন ছাড়াই কাঁদতাম’, সোনালি দিনের সিনেমা নিয়ে বললেন সুজাতা

‘রূপবান’ অভিনেত্রী সুজাতাছবি: সংগৃহীত

বাংলা সিনেমার সোনালি দিন যখন ধীরে ধীরে গতি পাচ্ছিল, তখনই আবির্ভূত হয়েছিলেন এক মায়াবী  নায়িকা সুজাতা। সমালোচকদের মতে, তাঁর হাসি ছিল নিখাদ আর অভিনয়ে ছিল ঔজ্জ্বল্য। বিশেষত লোককাহিনিনির্ভর কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘রূপবান’ তাঁকে এমনভাবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিল যে দর্শকের মনে আজও ‘রূপবান’ নামের সঙ্গে মিলেমিশে আছে তাঁর নাম। বর্তমানে যদিও তিনি অভিনয় থেকে অনেকটাই দূরে, তবু ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম লেখা আছে প্রগাঢ় অক্ষরে—বাংলা চলচ্চিত্রের এক কিংবদন্তি হিসেবে।

স্মৃতির জানালায় সুজাতা
সম্প্রতি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভির শিল্প–সাহিত্য ও সংস্কৃতিভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘অক্ষরের গল্পে’ এসে নিজের দীর্ঘ পথচলার গল্প বলেছেন এই গুণী অভিনেত্রী। সেখানে তিনি যেমন নিজের অভিনয়জীবনের কথা জানিয়েছেন, তেমনি দর্শকদের জন্য খুলে দিয়েছেন সুখ–দুঃখের স্মৃতির ঝাঁপি। তিনি জানান, তাঁর মা ছিলেন অত্যন্ত সংস্কৃতিমনা ও উদারমনস্ক নারী। জমিদারবাড়ির বউ হয়েও সিনেমাকে অবজ্ঞার চোখে দেখেননি। বরং স্বপ্ন দেখেছিলেন—সন্তানদের মধ্যে অন্তত একজন যেন চলচ্চিত্রে কাজ করে। উত্তম–সুচিত্রার সেই সোনালি যুগে এটা ছিল এক সাহসী স্বপ্ন।

সিনেমায় আগমনের গল্প
দাঙ্গা–উত্তাল সময় পেরিয়ে পরিবার নিয়ে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন তাঁরা। নতুন ঠিকানায় এক বাসিন্দা ছিলেন নাটকের সঙ্গে যুক্ত। সুজাতার মায়ের আগ্রহেই নাটকে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান তিনি। আর সেই ছোট্ট সুযোগই বদলে দেয় তাঁর জীবন। এরপর শুরু হয় চলচ্চিত্রে আগমন। নির্মাতারা তাঁর অভিনয় দেখে নিশ্চিত হয়েছিলেন—এই মেয়েটির মধ্যে আছে আলাদা এক দীপ্তি। আর সেই বিশ্বাসেই প্রথম সিনেমা ‘ধারাপাত’–এ সুযোগ পান তিনি। পর্দায় তাঁর স্বাভাবিক উপস্থিতি ও সাবলীল অভিনয় খুব অল্প সময়েই নজর কাড়ে সবার।

রাজ্জাক ও সুজাতা
ফাইল ছবি

পরিচালক মানেই ছিলেন অভিভাবক
তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করা সুজাতা যখন সেই সময়কার চলচ্চিত্রের পরিবেশ নিয়ে কথা বলেন, সেখানে উঠে আসে দায়িত্ববোধ ও আন্তরিকতার এক উজ্জ্বল চিত্র। তাঁর ভাষ্যে, ‘আমাদের সময়ে পরিচালকই ছিলেন পরিবার–অভিভাবকের মতো। কীভাবে থাকতে হবে, কীভাবে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে—সবকিছু তাঁরা বুঝিয়ে দিতেন। ব্যায়াম করতেও বলতেন। গল্পটা আগেভাগেই পরিষ্কার করে দিতেন।’ নায়িকা হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। তবু নির্মাতারা তাঁদের ব্যক্তিগত চলাফেরায় সীমাবদ্ধ রাখতেন, যেন রহস্যময়তা অটুট থাকে। সে সময় তারকা মানে সত্যিকারের দূরের নক্ষত্র—এটাই ছিল প্রচলিত ধারণা।

নায়করাজ রাজ্জাক ছিলেন তাঁর প্রিয় সহ–অভিনেতাদের একজন। আর ভারতীয় তারকাদের মধ্যে তাঁর পছন্দ—ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ বচ্চন ও উত্তম কুমার।

‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ সিনেমার একটি দৃশ্য সুজাতা ও সুচন্দা
ছবি: সংগৃহীত

সত্যিকারের কান্না, সত্যিকারের অনুভূতি

অভিনয়ে সততার জায়গাটি ছিল তাঁর খুব প্রিয়। তাই গুরুত্বপূর্ণ আবেগঘন দৃশ্যে নিজের অনুভূতিতে ডুবে গিয়ে কেঁদেছেন তিনি। ‘গ্লিসারিন থাকত ঠিকই, কিন্তু আমরা চেষ্টা করতাম নিজের আবেগে কাঁদতে।’ সুজাতার মতে, অভিনয় তখন শুধু পেশা ছিল না—ছিল শিল্পের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ।অসংখ্য সুপারহিট সিনেমায় অসংখ্য নায়কের সঙ্গে কাজ করেছেন সুজাতা। কিন্তু জীবনের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন অভিনেতা আজিমকে। তিনি বলেন, ‘বিয়ে হলো আল্লাহর ইচ্ছায়। ওরও ভালো লাগল, আমারও। বিয়ের পর ক্যারিয়ারে কোনো বিঘ্ন হয়নি, বরং সমানতালে কাজ করেছি।’

জনপ্রিয়তার শিখরে ওঠার পথ

১৯৪৭ সালে কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন সুজাতা। পারিবারিক নাম ছিল তন্দ্রা মজুমদার। ১৯৬৩ সালে ‘ধারাপাত’–এর মাধ্যমে অভিনয়ে আসেন। এরপর পরিচালক সালাউদ্দিন তাঁর নাম পরিবর্তন করে ‘সুজাতা’ রাখেন। মাত্র দুই বছরের মাথায় মুক্তি পায় লোককাহিনিনির্ভর সিনেমা ‘রূপবান’—যা তাঁকে একলাফে পৌঁছে দেয় জনপ্রিয়তার চূড়ায়।

দর্শক তাঁকে ভুলতে পারেননি আজও। কারণ, পর্দায় তাঁর উপস্থিতি ছিল কোমল, অথচ গভীর প্রভাববিস্তারী। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অসংখ্য সাফল্য তাঁর ঝুলিতে। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আজীবন সম্মাননা এবং ২০২১ সালে পেয়েছেন দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক। এই স্বীকৃতিগুলো তাঁর শিল্প-অবদানের প্রকৃত স্বীকৃতি বহন করে।

একটি চলচ্চিত্রের দৃশ্যে সুজাতা। ছবি: সংগৃহীত

শাসন, ভালোবাসা আর সংগ্রামের দিনগুলো

সেই সময়ের চলচ্চিত্র ছিল নির্মোহ, নিয়মশৃঙ্খলাপূর্ণ। পরিচালকের শাসন ও যত্নকে তিনি এখনো সম্মান করেন। তাঁর ভাষায়, ‘তখনকার পরিচালকেরা ভুল দেখিয়ে দিতেন, সাজিয়ে দিতেন। তাই ভুল হওয়ার সুযোগ কম ছিল। আমরা পেশার প্রতি খুবই সৎ ছিলাম।’