পুরান ঢাকায় জন্ম; আসল নাম শাহিদ হাসান, যেভাবে তিনি মিশা সওদাগর

মিশা সওদাগরছবি: ফেসবুক

নায়ক থেকে দেশের সফল খলনায়ক মিশা সওদাগর। তিন দশকের বেশি সময় ধরে বড় পর্দায় দর্শক মাতাচ্ছেন এ অভিনেতা। এখন পর্যন্ত সাত শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করে রেকর্ড গড়েছেন তিনি। এখনো প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গেই প্রতিযোগিতা করেন তিনি। আজকের জায়গায় আসার জন্য তুখোড় খল অভিনেতাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে হয়েছে তাঁকে। এ জন্য ছিল তাঁর আলাদা কৌশল। আজ তাঁর জন্মদিন।

১৯৬৬ সালের ৪ জানুয়ারি পুরান ঢাকায় মিশা সওদাগর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ওসমান গনি ও মা বিলকিস রাশিদা। তাঁদের তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে মিশার অবস্থান চতুর্থ। ব্যক্তিগত জীবনে তিনিও দুই ছেলের বাবা।

১৯৮৬ সালে এফডিসি আয়োজিত নতুন মুখ কার্যক্রমে নির্বাচিত হয়ে সিনেমায় যাত্রা শুরু করেন মিশা সওদাগর। ছটকু আহমেদ পরিচালিত ‘চেতনা’ সিনেমার মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালে নায়ক হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ‘অমরসঙ্গী’ সিনেমাতেও তিনি নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন, কিন্তু দুটির একটিতেও ব্যবসায়িক সাফল্য পাননি। পরে বেশ কয়েকজন পরিচালক তাঁকে ভিলেন হিসেবে অভিনয়ের পরামর্শ দেন। প্রথম তমিজ উদ্দিন রিজভীর ‘আশা ভালোবাসা’ সিনেমাতে ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করেন মিশা। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ভিলেন হিসেবে নিজেকে বড় পর্দায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হুমায়ুন ফরীদিকে দেখে নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করতে আগ্রহী হন মিশা। এ কারণে ফরীদিকে তিনি বলেন ‘আত্মিক ওস্তাদ’।

তার আসল নাম শাহিদ হাসান
ফেসবুক থেকে

মিশার প্রকৃত নাম শাহিদ হাসান। ফেসবুকে এ নামই ব্যবহার করেছেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, সিনেমায় আসার পর স্ত্রী মিতার নামের ‘মি’ এবং নিজের নামের ‘শা’ একসঙ্গে করে নিজেই নাম রাখেন মিশা। তাঁর দাদার নাম থেকে সওদাগর টাইটেল নিয়ে নিজের পুরো নামকরণ করেন মিশা সওদাগর। ২০২২ সালে জন্মদিন উপলক্ষে ‘বিনোদন’–এর মুখোমুখি হন তিনি। সেই সাক্ষাৎকারটির কিছু অংশ আবার প্রকাশ করা হলো।

প্রথম আলো :

শুভ জন্মদিন...

অনেক অনেক ধন্যবাদ।

প্রথম আলো :

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, এই ভালোবাসা কেমন লাগে?

জন্মদিন আমি সেই অর্থে পালন করি না। এবার ছেলে জোর করে কেক এনেছিল। তাকে দিয়ে কেক কাটিয়েছি। কিন্তু অনেকেই ফেসবুক, ফোনে শুভকামনা জানাচ্ছেন। অনেক আগের ছবি দিয়ে স্মৃতিকাতর করে তুলছেন। এসব ভালোবাসা সব পুরস্কারের চেয়ে বড়।

প্রথম আলো :

শুনেছি শুরু থেকেই শুটিংয়ে আপনি ডামি ব্যবহার করেন। কেন?

এটা আমার টিকে থাকার জন্য করে যেতে হয়েছে। যখন আমি ভিলেন হিসেবে অভিনয় শুরু করি, তখন চারজন মহিরুহ ছিলেন। শ্রদ্ধেয় এ টি এম শামসুজ্জামান, খলিল সাহেব, হুমায়ুন ফরীদি ও রাজীব সাহেব। তাঁদের সামনে দাঁড়াতে আমাকে অনেক ঝুঁকি নিতে হয়েছে। অভিনয়ে তো তাঁদের ধারেকাছেও যেতে পারব না। তখন কৌশল হিসেবে নাচ, ফাইট ইত্যাদির দিকে বাড়তি মনোযোগ দিতে হয়েছে।

প্রথম আলো :

শুটিং করতে গিয়ে আর কী ধরনের সমস্যায় পড়েছেন?

একবার ফাঁসির দৃশ্য করতে গিয়ে গলায় ফাঁস লেগে যায়। একদম আচমকা গলায় ফাঁস লেগে গেল। সেদিন মনে হয়েছিল, আমি আর বাঁচব না। পরে ফাঁসির দড়ি খুলে কীভাবে নামানো হয়েছিল, কিছুই মনে ছিল না। সেদিন মনে হয়েছিল, মারা যাচ্ছি। পরে চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, আর ৩০ সেকেন্ড ফাঁস গলায় থাকলে বাঁচতাম না। এ ছাড়া ‘প্রাণের স্বামী’ সিনেমায় ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। সেটা এখনো ভোগাচ্ছে। আর কেটে যাওয়া, আঘাত পাওয়ার ঘটনা তো অহরহ।

মিশা সওদাগর
ফেসবুক থেকে

প্রথম আলো :

নায়ক থেকে প্রতিষ্ঠিত খলনায়ক—কীভাবে সম্ভব হয়েছে?

আমি কাজ ভালোবাসি। দর্শকেরা আমাকে ভালোবাসেন। আমি চেয়েছি অভিনয় দিয়ে দর্শকের ভালোবাসা আরও বেশি পেতে। এ জন্য আমি শুরু থেকেই একটা অনুশীলনের মধ্যে রয়েছি। ব্যায়াম করি, নিজেকে ছোট হতে হয়, এমন কিছু করি না, চরিত্র ঠিক রেখেছি, কেউ কোনো দিন বলতে পারবে না যে খারাপ ব্যবহার করেছি। আল্লাহর রহমত সবার আগে।

প্রথম আলো :

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে কোন কথাগুলো মেনে চলেন?

আমার মা সব সময় বলতেন, ‘সৎ থাকবে, সত্য কথা বলবে। কখনোই গড্ডলিকায় গা ভাসাবে না।’ পরিশ্রম আর সততা দিয়েই আমি প্রতিনিয়ত চেষ্টা করি টিকে থাকার।

প্রথম আলো :

অনেকের সঙ্গে অভিনয় করেছেন, কারও উপদেশ মেনে চলেন?

রাজীব সাহেব বলেছিলেন, ‘ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করো তো আব্বু, এই কথা মেনে চলো। আমরা এমনিতেই খারাপ চরিত্রে অভিনয় করি। মানুষ ধরে নেয়, আমরা ব্যক্তিজীবনেও খারাপ। শুটিংয়ের বাইরে সমাজের সাধারণ মানুষ যেন তোমাকে খারাপ মনে না করে। এ জন্য তোমাকে সব সময় সাদাসিধে পোশাক পরতে হবে, সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে।’ রাজীব সাহেবের কথায় কানে দুল পরাসহ অতিরিক্ত ফ্যাশন ছেড়ে দিই। এ টি এম শামসুজ্জামান সাহেব বলেছিলেন, ‘তুই লুঙ্গি পরলে গ্রামের, কোট–টাই পরলে শহুরে। এমন লুকে তোর মতো এই প্রজন্মে আর কোনো ভিলেন নেই। তুই সফল হবি।’ জসিম ভাই বলতেন, ‘এমন ভিলেন হবি যেন তোর অভিনয়ে দর্শকের চোখের পাতা না পড়ে।’ এ ছাড়া অনেকেই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। সবার উপদেশ মেনে চলেছি।

মিশা সওদাগর
ফেসবুক থেকে

প্রথম আলো :

ভিলেন চরিত্রে প্রাপ্তি কতটা, কখনো কি এই ভরসা সরে যাবে বলে মনে হয়?

৮০০–৯০০ সিনেমায় খলচরিত্রে অভিনয় করেছি। পৃথিবীতে আমার মতো কেউ প্রধান ভিলেন চরিত্রে এত বেশি অভিনয় করেননি। পৃথিবীতে মান্না–শাকিব বাদে আমার মতো কেউ নামভূমিকায় এত ছবিতে অভিনয় করেননি। তার মানে আমাকে নিয়ে চরিত্র হয়েছে, হচ্ছে। ‘নুরা পাগলা’, ‘জ্যান্ত কবর’, ‘টপটেরর’সহ এমন অনেক সিনেমায় নামভূমিকায় অভিনয় করেছি। ‘কুস্তি’সহ একাধিক সিনেমায় নামভূমিকায় অভিনয় করছি। তিন যুগ আমার ওপর ভরসা পাচ্ছেন, ভবিষ্যতেও পাবেন। এ জন্য নির্মাতা ও প্রযোজকদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

প্রথম আলো :

দীর্ঘ প্রায় তিন যুগে এফডিসিতে আপনার বিচরণ। ইন্ডাস্ট্রির দিকে তাকালে কী মনে হয়?

এফডিসিকে একটি সারশূন্য ইন্ডাস্ট্রি মনে হয়। এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কি আমরা চেয়েছিলাম? আমরা একটা ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ শুরু করেছিলাম। সেই ধারাবাহিকতা আগের মতো তো নেই। একটি ব্যাখ্যা দিই, ছোটদের স্নেহ করা আর বড়দের সম্মান করা, এটাই এখন নেই। এখন তরুণদের মধ্যে অভিনয় যে নেশা, সে বিষয়ই নেই। অনেকেই এখন আগে বলেন, ‘কত টাকা দেবেন?’ আমাকে রাজীব ভাই, সোহেল রানা ভাই কাজের জন্য ডাকলে গিয়ে বলেছি, কোথায় স্বাক্ষর করব? টাকা নয়, কাজটাই বড় ছিল। সবার মধ্যে পেশাদারত্ব আগের মতো নেই।