বক্স অফিস কবে কার্যকর হবে

বাংলাদেশে পাঁচ দশকেও কার্যকর হয়নি বক্স অফিসছবি: কোলাজ

বক্স অফিস মানে সিনেমা হলের টিকিটঘর। কোনো চলচ্চিত্রের লাভ কিংবা লোকসান—সবটাই নির্ভর করে টিকিটের বিক্রিবাট্টার ওপর। টিকিট বিক্রির ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত সিনেমার আয়ের হিসাব-নিকাশ ‘বক্স অফিস’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।
তবে বাংলাদেশে বক্স অফিসের কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। গুটিকয় মাল্টিপ্লেক্স বাদে সিনেমা হলগুলোয় এখনো হাতে হাতে টিকিট বিক্রি হয়। ফলে কোন শোতে কত টিকিট বিক্রি হয়েছে, তা সুনির্দিষ্ট করে জানার কোনো সুযোগ নেই।
পরিবেশকেরা বলছেন, হলে প্রতিটি টিকিট ১০০ টাকায় বিক্রি হলে সেখান থেকে ১০ টাকা সরকারকে ট্যাক্স বাবদ দিতে হয়। বাকি ৯০ টাকা হলমালিক, প্রযোজক ও পরিবেশকদের মধ্যে বাঁটোয়ারা হয়। পরিবেশকদের দাবি, কোনো শোতে আড়াই শ টিকিট বিক্রি হলেও অনেক হলমালিক ১০০ টিকিট বিক্রির হিসাব দেন। হাতে হাতে টিকিট বিক্রি হওয়ায় বিষয়টি মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

প্রযোজনা ও পরিবেশক প্রতিষ্ঠান টাইগার মিডিয়ার কর্ণধার জাহিদ হাসান গতকাল সোমবার দুপুরে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, টিকিট হাতে হাতে বিক্রি করার ফলে হিসাব–নিকাশে স্বচ্ছতার ঘাটতি থাকে। বক্স অফিস কার্যকরের জন্য ডিজিটালি টিকিট বিক্রির বিকল্প নেই।
বলিউড তারকা শাহরুখ খানের সিনেমা ‘পাঠান’–এর মুক্তি ঘিরে দেশে বক্স অফিস কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছে সিনেমাটির আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাকশন কাট এন্টারটেইনমেন্ট। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) আওতায় আগামী শুক্রবার বাংলাদেশের ৪০টি প্রেক্ষাগৃহে সিনেমাটি মুক্তি পাচ্ছে। এর মধ্যে ৮টি সিনেপ্লেক্স ও ৩২টি একক সিনেমা হল।

টিকিট হাতে হাতে বিক্রি করার ফলে হিসাব–নিকাশে স্বচ্ছতার ঘাটতি থাকে। বক্স অফিস কার্যকরের জন্য ডিজিটালি টিকিট বিক্রির বিকল্প নেই।
পরিবেশক জাহিদ হাসান
একক সিনেমা হলে এখনও হাতে হাতে টিকিট বিক্রি হয়
ছবি: মাসুম অপু

অ্যাকশন কাট এন্টারটেইনমেন্টের স্বত্বাধিকারী ও চলচ্চিত্র পরিচালক অনন্য মামুন গতকাল প্রথম আলোকে জানান, বক্স অফিস কার্যকরের জন্য ৩২টি সিনেমা হলে সার্ভার ও ই-টিকেটিং কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। আগামীকাল থেকে ই–টিকেটিং ব্যবস্থা কার্যকর হবে।
অনন্য মামুনের ভাষ্যে, কোন সিনেমা হলে কোন শোতে কত টিকিট বিক্রি হয়েছে, মুহূর্তেই তা জানতে পারবে অ্যাকশন কাট এন্টারটেইনমেন্ট। ফলে ‘পাঠান’ সিনেমার টিকিট বিক্রি নিয়ে ফাঁকিজুকির সুযোগ থাকবে না।
দেশের একক সিনেমা হলগুলো পরিবেশকদের কাছ থেকে পেনড্রাইভে সিনেমা নিয়ে প্রদর্শন করে। তবে হলিউড কিংবা বলিউডের সিনেমা প্রদর্শনে সার্ভারের প্রয়োজন। সাথীসহ বেশ কয়েকটি সিনেমা হলের মালিকেরা জানান, সার্ভার না থাকায় আগ্রহ থাকলেও ‘পাঠান’ চালাতে পারছেন না তাঁরা।

দেশের একক সিনেমা হলগুলো পরিবেশকদের কাছ থেকে পেনড্রাইভে সিনেমা নিয়ে প্রদর্শন করে। তবে হলিউড কিংবা বলিউডের সিনেমা প্রদর্শনে সার্ভারের প্রয়োজন। সাথীসহ বেশ কয়েকটি সিনেমা হলের মালিকেরা জানান, সার্ভার না থাকায় আগ্রহ থাকলেও ‘পাঠান’ চালাতে পারছেন না তাঁরা।

‘পাঠান’ মুক্তির সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই পুরোদমে বক্স অফিস ব্যবস্থা কার্যকর করতে পারবেন বলে দাবি করলেন অনন্য মামুন। কোন সিনেমা হলে কত টিকিট বিক্রি হলো, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব প্রকাশ করা হবে। আস্তে আস্তে দেশের সব সিনেমা হলে ই–টিকেটিং চালু করা গেলে বাংলা সিনেমাও লাভবান হবে বলে আশা করছেন পরিবেশকেরা।

দেশের ৪০ প্রেক্ষাগৃহে শুক্রবার মুক্তি পাচ্ছে শাহরুখ ও দীপিকার ‘পাঠান’
ছবি: ফেসবুক

সাথী সিনেমা হলের কর্ণধার ও হলমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ প্রদর্শক সমিতির নেতা মিয়া আলাউদ্দিন গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, শুধু সাথী নয়, দেশের বেশির ভাগ একক সিনেমা হলেই বিদেশি সিনেমা প্রদর্শনের জন্য সার্ভার নেই। তবে হলমালিকেরা সার্ভার বসানোর চেষ্টা করছেন।

পাঁচ দশকেও বক্স অফিস কার্যকর হয়নি কেন
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারতে বক্স অফিস কার্যকরে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে ভারতের প্রযোজক, পরিবেশকদের সংগঠন দ্য ইন্ডিয়ান মোশন পিকচার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশন (ইমপা)। ঢাকাই চলচ্চিত্রে সংগঠনের অভাব না থাকলেও বক্স অফিস কার্যকরে কোনো সংগঠনের দৃশ্যত কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
এককভাবে কেউ চাইলে বক্স অফিস কার্যকর করা কঠিন। পরিবেশক, প্রযোজক, হলমালিক সবাইকেই সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন প্রযোজক খোরশেদ আলম। তিনি গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রযোজকেরা কখনোই স্বীকার করি না, সিনেমা ভালো চলছে না। অনেকে বলেন, তাঁর সিনেমা সুপারহিট। কিন্তু দেখা যায়, হলে চারজনের বেশি দর্শক নেই। এখন ছবির ব্যবসাই নেই, ফলে বক্স অফিসের কার্যকারিতা নেই।’

সিনেমা না চললেও প্রযোজকেরা কেন সুপারহিট বলেন? খোরশেদ আলমের দাবি, প্রযোজক নিজের ছবিকে খারাপ বললে অন্য হলমালিকেরা নেবেন না। ফলে প্রযোজক, পরিবেশক কিংবা হলমালিকের কথায় নির্ভর করে পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় না। বক্স অফিস কার্যকর থাকলে অনেকে প্রযোজনায় আগ্রহী হতেন বলে মনে করেন এ প্রযোজক। পাশাপাশি সিনেমা নিয়ে দর্শকের উৎসাহও বাড়বে।

মাল্টিপ্লেক্সগুলো কী করছে
বলা হচ্ছে, ই–টিকেটিং ব্যবস্থা ও সার্ভার থাকলে বক্স অফিস কার্যকর করা সম্ভব। স্টার সিনেপ্লেক্স, ব্লকবাস্টার সিনেমাস, লায়ন সিনেমাসের নিজস্ব সার্ভার ও ই–টিকেটিং ব্যবস্থা রয়েছে। মাল্টিপ্লেক্সগুলোর টিকিট বিক্রির হিসাব–নিকাশ প্রকাশ্যে আসে না। স্টার সিনেপ্লেক্সের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে জানান, পরিবেশকদের সঙ্গে ‘নন ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট’ থাকার কারণে টিকিট বিক্রির হিসাব প্রকাশের এখতিয়ার তাঁদের নেই। তাঁরা প্রতি সপ্তাহে পরিবেশকদের কাছে টিকিট বিক্রির হিসাব পাঠিয়ে থাকেন।

লায়ন সিনেমাস
ছবি: ফেসবুক

লায়ন সিনেমাসের প্রতিষ্ঠাতা মির্জা খালেক গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানান, লায়ন সিনেমাস প্রতিদিনই পরিবেশকদের রিপোর্ট পাঠায়। হল রিপোর্ট প্রকাশ করা কিংবা না করা—পুরোটাই পরিবেশকের ওপর নির্ভর করে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মাল্টিপ্লেক্স চাইলেই বক্স অফিস কার্যকর করতে পারে না। এটি কার্যকরে ভারতের ইমপার মতো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সংগঠনগুলোর জোট প্রয়োজন; যেখানে প্রযোজক, পরিবেশক ও হলমালিকেরা একসঙ্গে কাজ করবেন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, মাল্টিপ্লেক্স চাইলেই বক্স অফিস কার্যকর করতে পারে না। এটি কার্যকরে ভারতের ইমপার মতো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সংগঠনগুলোর জোট প্রয়োজন; যেখানে প্রযোজক, পরিবেশক ও হলমালিকেরা একসঙ্গে কাজ করবেন।

ভারতের বক্স অফিস কীভাবে কাজ করে
‘আগে বেশির ভাগ সিনেমার অর্থ চুরি হতো। ৫ লাখ টাকার টিকিট বিক্রি করে মাত্র ৫০ হাজার টাকা দেখানো হতো। তখন কোনো নিয়মকানুনই ছিল না। প্রযোজক, পরিবেশকেরা লোকসান গুনতেন,’ আড়াই দশক আগে ভারতের সিনেমা হলের চিত্র তুলে ধরলেন ভারতীয় প্রযোজক ও পরিবেশক অশোক ধানুকা। ‘ভাইজান এল রে’, ‘নবাব’, ‘শিকারী’, ‘খোকাবাবু’সহ বেশ কয়েকটি আলোচিত সিনেমা প্রযোজনা ও পরিবেশনা করেছে অশোক ধানুকার প্রতিষ্ঠান এসকে মুভিজ।

‘আগে বেশির ভাগ সিনেমার অর্থ চুরি হতো। ৫ লাখ টাকার টিকিট বিক্রি করে মাত্র ৫০ হাজার টাকা দেখানো হতো। তখন কোনো নিয়মকানুনই ছিল না। প্রযোজক, পরিবেশকেরা লোকসান গুনতেন।’
ভারতীয় প্রযোজক ও পরিবেশক অশোক ধানুকা
ভারতের সিনেমার হিসাব–নিকাশ দেখভাল করে প্রযোজক, পরিবেশকদের সংগঠন ইমপা কাজ করে যাচ্ছে
ছবি: ইমপা

গতকাল দুপুরে অশোক ধানুকা প্রথম আলোকে জানান, আড়াই দশক আগে ভারতে বক্স অফিস কার্যকরের পর এখন চুরি নেই বললেই চলে। শৃঙ্খলাও ফিরেছে। দুই মিনিটের মধ্যে কোন শোতে কত টাকা এসেছে, তা পরিবেশকদের জানানো হয়।
ভারতের সিনেমার হিসাব–নিকাশ দেখভাল করে প্রযোজক, পরিবেশকদের সংগঠন ইমপা কাজ করে যাচ্ছে। ভারতের নানা শহরে সংগঠনটির শাখা কার্যালয় রয়েছে। কলকাতাকেন্দ্রিক সিনেমাগুলোর হিসাব–নিকাশ পাওয়া যায় ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশন পিকচার অ্যাসোসিয়েশনে।
অশোক ধানুকার ভাষ্য, হলগুলো সিনেমার প্রতিদিনের টিকিট বিক্রির তথ্য পরিবেশকদের পাঠিয়ে দেয়। সেই হিসাব ইমপা কার্যালয়ে জমা দেন পরিবেশকেরা। সেখানে প্রতিটি সিনেমার হিসাব টেনে আয়ের হিসাব কষা হয়। এখানে ফাঁকির কোনো সুযোগ নেই। প্রযোজক, পরিবেশকেরা সম্মিলিতভাবে কাজ করলে এটা বাংলাদেশেও সম্ভব। বক্স অফিস কার্যকরের ফলে প্রযোজক ও পরিবেশক লাভের মুখ দেখেছেন, নতুন নতুন সিনেমা প্রযোজনায় আগ্রহী হচ্ছেন বলে জানান তিনি।
মূলত ইমপা থেকে বলিউডের চলচ্চিত্র বিশ্লেষক তারান আদর্শসহ বক্স অফিস মোজো, বলিমুভিরিভিউজ ডটকমসহ ভারতের মূলধারার গণমাধ্যমগুলো বক্স অফিস রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন