সিনেমা আছে, হল নেই

গত ২৩ সেপ্টেম্বর একসঙ্গে দুটি নতুন ছবি মুক্তি পায়। তার একটি ‘অপারেশন সুন্দরবন’। ছবিটি প্রথম সপ্তাহে ৩৫টি হলে মুক্তি পেলেও পঞ্চম সপ্তাহে এসে হলসংখ্যা এখন ১৬। সার্বিকভাবে কমলেও সিনেপ্লেক্সে ছবিটির শোর সংখ্যা বেড়েছে। ঢাকার বাইরে কিছু একক হলে ছবিটির দর্শক থাকলেও পরে ধারাবাহিকভাবে একাধিক নতুন ছবির মুক্তির কারণে ছবিটি নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে করে ছবিটির একক হলসংখ্যা কমেছে।
অপারেশন সুন্দরবন ছবির পরিচালক দীপংকর দীপন বলেন, ‘ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বেশ কিছু একক হলে ছবির দর্শক খারাপ ছিল না। কিন্তু পরপর নতুন ছবি মুক্তির কারণে তৃতীয় সপ্তাহ ও চতুর্থ সপ্তাহে এসে অনেক হল ছেড়ে দিতে হয়েছে। হল বেশি থাকলে এই সমস্যা সমস্যা হতো না।’
কিছুদিন আগেও শোনা গিয়েছিল, সিনেমার অভাবে হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন এসে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। হলের অভাবেই সিনেমার মুক্তি আটকে যাচ্ছে। ছবির মুক্তির সময় বেশিসংখ্যক হল পাচ্ছেন না প্রযোজকেরা। কমসংখ্যক হলে ছবি মুক্তি দিয়ে লোকসান গুনছেন তাঁরা।

দীপংকর দীপন আরও বলেন, এখন আস্তে আস্তে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে সিনেমা দেখার আগ্রহ বাড়ছে দর্শকের। নতুন নতুন সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। কিন্তু হল কোথায়? সীমিত হলসংখ্যার মধ্যে একাধিক সিনেমা মুক্তির কারণে হলগুলোতে বেশি দিন প্রদর্শনেরও সুযোগ থাকছেন না নতুন ছবির। আবার কোনো কোনো জেলায় একটিমাত্র হল আছে। একাধিক হল না থাকায়, অর্থাৎ বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় নতুন ছবি মুক্তি পেলে সদ্য মুক্তি পাওয়া ছবি নামিয়ে নতুন ছবি নিচ্ছে ওই সব হল। কিছু করার থাকছে না।

‘পরাণ’–এর দৃশ্যে শরিফুল রাজ ও মিম
ছবি: সংগৃহীত

বর্তমানে সারা দেশে নিয়মিত–অনিয়মিত মিলিয়ে প্রায় দেড় শ হল আছে। এর মধ্যে নিয়মিত হলসংখ্যা প্রায় ১০০। কোভিডের কারণে অনেক নতুন সিনেমার মুক্তি আটকে ছিল। গত ঈদুল ফিতর থেকে সিনেমা মুক্তির সংখ্যা বেড়েছে। বিশেষ করে পবিত্র ঈদুল আজহা থেকে পরাণ ও হাওয়া ছবি সফলতা পাওয়ায়  প্রযোজকদের ছবি মুক্তির আগ্রহ বেড়েছে। দু-তিন মাস ধরে মাসে চার-পাঁচটি করে নতুন ছবি মুক্তি পাচ্ছে। চলতি মাসের এখনো সপ্তাহখানেক বাকি। এরই মধ্যে ছয়টি নতুন ছবি মুক্তি পেয়েছে। সিনেমাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, হলসংকটের মধ্যে একাধিক নতুন ছবি মুক্তির সময় ভাগাভাগিতে বেশি হল পাচ্ছে না কোনো ছবিই। এতে করে সীমিত হল থেকে ব্যবসা তো দূরের কথা, লগ্নির অর্থই ফেরত আসছে না প্রযোজকদের ঘরে।

প্রযোজক ও পরিবেশকদের কথা, একটি নতুন ছবি মুক্তির সময় বেশি হল পেলে প্রথম সপ্তাহেই লগ্নির বড় অঙ্ক উঠে আসা সহজ হয়। কিন্তু হলসংকটের মধ্যে একাধিক নতুন ছবির মুক্তির কারণে সেই সুযোগ থাকছে না। এতে সব ছবির ক্ষেত্রেই আর্থিক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। হলসংকটের মধ্যেই বর্তমানে দেশের প্রেক্ষাগৃহে আটটি সিনেমা—‘পরাণ’, ‘হাওয়া’, ‘অপারেশন সুন্দরবন’, ‘বিউটি সার্কাস’, ‘ঈশা খাঁ’, ‘হৃদিতা’, ‘যাওয়া পাখি বলো তারে’, ‘রাগী’, ‘জীবন পাখি’, ‘বসন্ত বিকেল’ও ‘রোহিঙ্গা’।

‘বসন্ত বিকেল’ ছবির দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

এ ব্যাপারে পরাণ, ‘ঈশা খাঁ’, ‘যাও পাখি বলো তারে’ ও ‘জীবন পাখি’ ছবিগুলোর পরিবেশক জাহিদ হোসেন বলেন, ‘যখন সিনেমার দিন আসছে, তখন হলসংকট তা চেপে ধরছে। কিছুদিন আগেও শুনলাম, সিনেমার অভাবে হল বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু এখন দেখছি, হলের অভাবে সিনেমার জায়গা হচ্ছে না। এই সমস্যা দ্রুত সমাধান না হলে ভালো ভালো ছবি মুক্তি পেয়েও লাভ হবে না।’
এই পরিবেশকের কথা, যেসব একক হল এখনো বন্ধ আছে, সেগুলো দ্রুতই সংস্কার করে খুলে দিতে হবে। তার আগে অবশ্যই হলের আসন, পর্দা, সাউন্ড সিস্টেমের দিকে নজর দিতে হবে হলমালিকদের। অর্থাৎ পুরো প্রজেকশন সিস্টেমকে আধুনিকায়ন করেই হলগুলো খুলতে হবে।

এ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক মতিন রহমান বলেন, একসময় ভালো সিনেমার অভাবে হলগুলো চলেনি। এরপর করোনা মহামারিতে অনেক দিন হলগুলো বন্ধ ছিল। হতাশ হয়ে অনেক হলমালিক হয় জায়গা বিক্রি করে দিয়েছেন অথবা হল ভেঙে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছেন, করছেন। এখন নতুন নতুন সিনেমা আসছে কিন্তু হল পাওয়া যাচ্ছে না। এই সীমিতসংখ্যক হল দিয়ে তো সিনেমার ব্যবসা হবে না। সিনেমাটা একটা যৌথ শিল্প। একে বাঁচাতে এখন থেকেই হলমালিক ও প্রযোজকদের সিরিয়াস হয়ে একযোগে কাজ করা উচিত।
এই পরিচালক আরও বলেন, সরকার সিনেমা বাঁচাতে কম সুদে হলমালিকদের এক হাজার কোটি টাকার ঋণের যে ব্যবস্থা করেছে, অনেকেই আবেদন করেছেন। যথাযথভাবে ঋণ পেলে নতুন হল নির্মাণের বা বন্ধ হলগুলোর সংস্কারকাজ শুরু হতে পারে, তা না হলে সিনেমাও থাকবে না। কারণ, পণ্য বিক্রির জন্য তো জায়গা লাগবে, তা না হলে একটা সময় সিনেমার পুঁজি অন্য জায়গায় চলে যাবে, অন্য জায়গায় বিনিয়োগ হবে।