গত রোববার বিকেল থেকে রাত অবধি ঘুরে ঘুরে দেখা গেল, নানা বয়সের দর্শক আসছেন। নারী দর্শকের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। মা–বাবার হাত ধরে শিশুরা আসছে, খেলছে হলের নিচের ফ্লোরে। সবাই মিলে বড় বড় পোস্টার, ফেস্টুনের পাশে সেলফি তুলছেন। সব মিলে রীতিমতো উৎসবমুখর পরিবেশ।
নব্বইয়ের দশক পর্যন্তও যাঁরা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতেন, ইসলামপুরের লায়ন সিনেমা হলের কথা তাঁদের মনে থাকার কথা। ঢাকার প্রথম ১০টি সিনেমা হলের ১টি লায়ন। চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ জানালেন, মহারানি ভিক্টোরিয়ার রাজ্য শাসনের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৮৮৭ সালে জগন্নাথ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার কিশোরীলাল রায়চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেন ‘ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার’। পরে থিয়েটারটির কর্তৃত্ব পান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অন্যতম স্থপতি হামিদুর রহমান ও নাট্যকার সাঈদ আহমদের চাচা মির্জা আবদুল কাদের সরদার। ১৯২৭ সালে ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার হাউসকে প্রেক্ষাগৃহে রূপান্তর করা হয়। এটি লায়ন সিনেমা নামে পরিচিতি পায়। ১৯৩১ সালে এ প্রেক্ষাগৃহে সবাক চিত্রের যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়।
লায়ন শপিং কমপ্লেক্সের পঞ্চম তলা পর্যন্ত বিপণিবিতান। ষষ্ঠ তলায় স্পোর্টস জোন, গেম বক্স। এরপর আছে ব্যায়ামাগার, সুইমিংপুল, খাবারের দোকান। আর ওপরে চারটি আলাদা প্রেক্ষাগৃহ। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মির্জা আবদুল খালেক বলেন, ২৫ কাঠা জমির ওপর ১৬ হাজার বর্গফুটে তৈরি হয়েছে হলগুলো। পুরোপুরি শীততাপনিয়ন্ত্রিত চারটি হলেই আধুনিক সব সুবিধা আছে। আছে ডিজিটাল পর্দা, সর্বাধুনিক শব্দব্যবস্থা। প্রতিটি হলে ২০০ করে মোট ৮০০ আসন। তাঁর দাবি, এই মুহূর্তে লায়নেই রয়েছে ঢাকার সবচেয়ে বড় চারটি স্ক্রিন। এর মধ্যে দুটি আবার থ্রি–ডি স্ক্রিন। সিনেমা হলগুলো পরিচালনা করছে জয় সিনেমাস।
দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের বাজার বর্তমানে বেশ মন্দা, এ সময়ে এত বড় বিনিয়োগ করলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা আবদুল খালেক বলেন, ‘এই লায়ন হলের সঙ্গে যেমন ঢাকা চলচ্চিত্রের ইতিহাস জড়িয়ে আছে, তেমনি আমার বাবার স্মৃতিও আছে। পুরান ঢাকা ও বুড়িগঙ্গার ওই পারের সঙ্গে এই সিনেপ্লেক্স একটা যোগসূত্র তৈরি করবে বলে আমরা আশা করছি। কেরানীগঞ্জ এলাকায় এখন বিপুল জনগোষ্ঠীর বাস। আবার যানজট ঠেলে আর নতুন ঢাকায় যেতে চায় না পুরান ঢাকার মানুষ। তাদের জন্য এক ছাদের নিচে শপিং, খাবার আর বিনোদনের সুযোগ এখানে মিলছে।’
ইসলামপুরের সৈয়দ আওলাদ হোসেন লেনের মুখে ছিল আদি লায়ন প্রেক্ষাগৃহ। হলটি বন্ধ হওয়ার পর সেখানে বাণিজ্যিক ভবন করা হয়েছে। ওখানে কেন সিনেমা হল করলেন না, এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা আবদুল খালেক বলেন, এলাকাটির রাস্তাঘাট সরু। দিনে দিনে দোকানপাট বেড়ে যাওয়ায় এখানে সিনেমা হল পরিচালনা আর বাস্তবসম্মত মনে হয়নি।
রোববার লায়ন সিনেমাসে বগুড়ার মধুবন সিনেমা হলের মধুবন সিনেপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর এম ইউনুসের সঙ্গে দেখা। তিনি বলেন, ‘এই সময়ে এমন আধুনিক সুবিধা নিয়ে লায়ন সিনেমার চালুর ঘটনা আমাদের জন্য প্রেরণা। বগুড়ায় একটি হল চালু করেছি আমরা, আশা করছি ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।’
পুরান ঢাকার হাটখোলা থেকে সপরিবার এসেছিলেন মোর্শেদা রহমান। মোর্শেদা এককথায় বললেন, ‘সারপ্রাইজড!’ তিনি বলেন, ‘পরিবেশের কারণে আমরা তো হলে গিয়ে ছবি দেখাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। সিনেপ্লেক্সগুলো সব বাসার থেকে দূরে দূরে। ভাবতেও পারিনি বুড়িগঙ্গার এপারে এসে এমন দারুণ পরিবেশ পাব। ভালোই হলো, আমরা এখন নিয়মিত আসতে পারব।’
এবারের ঈদের ছবির বাজারে আশার আলো দেখছে লায়ন কর্তৃপক্ষ। তারা আশা করছে, নিয়মিত দর্শকের পছন্দমতো ছবি মুক্তি পাবে, দেশ–বিদেশের ভালো ভালো ছবি আসবে। টিকে থাকবে সিনেমা হল সংস্কৃতি।