‘তুমি জানো না আমি কে? তোমাকে বরিশাল পাঠিয়ে দেব’

অভিনেতা ফাইয়াজ আহমেদ ও জ্যাকি আলমগীর। ছবি: প্রথম আলো

‘তোমার কত বড় সাহস, আমার চরিত্রে অভিনয় করো। তোমার বাড়ি কোথায়, বরিশাল না? তুমি জানো না আমি কে? তোমাকে বরিশাল পাঠিয়ে দেব। তোমাকে আমি দেখে নেব। আমাকে তুমি চেনো না।’ তিন যুগের বেশি সময় আগে একটি শুটিং ইউনিটে এভাবে সহ-অভিনেতা জ্যাকি আলমগীরকে উচ্চ স্বরে কথাগুলো বলেছিলেন আরেক অভিনেতা ফাইয়াজ আহমেদ ববি। সেদিন দুই অভিনেতার মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়েছিল। সেই ঝগড়া থেকেই পরবর্তী সময় তাদের মধ্যে জমে ওঠে গভীর বন্ধুত্ব।

সিনেমার নাম ‘লড়াকু’। সেই সিনেমায় শুটিংয়ের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিলেও শুটিং স্পটে আসতে কিছুটা দেরি করেন অভিনেতা ববি। শুটিংয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকন। কিছু সময় তাঁরা অপেক্ষাও করেন। পরে বাধ্য হয়েই ববিকে বাদ দিতে হয় পরিচালককে। তিনি অপেক্ষা না করে সিনেমার সহকারী পরিচালক জ্যাকি আলমগীরকে দাঁড় করিয়ে দেন ক্যামেরার সামনে। শুটিংয়ের পরেই হাজির হন অভিনেতা ববি। তিনি সব শুনে মেজাজ হারিয়ে ফেলেন। রেগে যান সহকারী পরিচালক জ্যাকি আলমগীরের ওপর।

অভিনয় ক্যারিয়ার শুরুর আগে জ্যাকি সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ‘সেদিন সবার সামনে কি রাগারাগি। আমাকে ববি ভাই যা-তা বলতে থাকেন। ভয়ভীতি পর্যন্ত দেখান। আমাকে আর কাজ করতে দেবেন না। পাঠিয়ে দেবেন বরিশালের গ্রামের বাড়ি। ববি ভাই তখন খুবই রাগান্বিত থাকতেন। তিনি অল্পতেই রেগে যেতেন। এটা আমরা সবাই জানতাম। আমিও কোনো কথার উত্তর দিলে আরও রেগে যেতেন। আমাদের মধ্যে রাগারাগি হলেও একসময় আমি নিজেই কোনো কথা বলতাম না। চুপচাপ হাসতাম।’

অভিনেতা ফাইয়াজ আহমেদ ও জ্যাকি আলমগীর। ছবি: প্রথম আলো

অভিনয়শিল্পী সংঘের নির্বাচনের দিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির গেট দিয়ে বের হচ্ছিলেন অভিনেতা জ্যাকি আলমগীর ও ববি। তাঁদের চিনতে পেরে ঘিরে ধরেছিলেন ভক্তরা। এর মধ্যেই কথা হয় এই ঢালিউডের দুই অভিনেতার সঙ্গে। পাশ থেকে কেউ কেউ ‘আম্মাজান’ সিনেমার ‘নবাব’ চরিত্রের নবাব নাম ধরেই ডাকছিলেন জ্যাকি আলমগীরকে।

বোঝা গেল, চরিত্রের নাম ধরে ডাকায় খুশি এই অভিনেতা। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও সেদিন ববি ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করতে চাইনি। আমার ক্যারিয়ারে আমি সৎভাবে কাজ করেছি। এই যে দেখলেন, দর্শক নবাব বলে ডাকছে। এই নবাব চরিত্রেও কিন্তু আমার অভিনয় করার কথা ছিল না। অভিনয় করার কথা ছিল দিলদার ভাইয়ের। পরে দিলদার ভাই যখন করলেন না, তখন পরিচালক আমাকে প্রস্তাব দেন। আমি সবার আগে দিলদার ভাইয়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সিনেমাটি করেছি।’

কিন্তু ‘লড়াকু’ সিনেমার শুটিংয়ের সময় ‘না’ বলার সুযোগ ছিল না উল্লেখ করে এই অভিনেতা বলেন, ‘“লড়াকু” সিনেমার শুটিংয়ের সময় আমি নতুন ছিলাম। সবে মিডিয়ায় পা দিয়েছি। পরিচালক যখন আমাকে সবার সামনে বললেন, ববি ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য দাঁড়িয়ে যেতে, তখন আমার কিছু করার ছিল না। তখন বারবার না করার সাহস আমার থাকার কথা নয়।’

অভিনেতা ফাইয়াজ আহমেদ ববি। ছবি: ফেসবুক

তবে সম্পর্কের সেই চিত্র এখন আর নেই। দীর্ঘদিন ধরেই নিয়মিত এফডিসিতে বা বাইরেও তাঁদের একসঙ্গে হাঁটতে, কখনো আড্ডা দিতে দেখা যায়। ‘আপনাদের এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পরবর্তী সময় কীভাবে তৈরি হলো?’ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘৩০ বছর আগে আমাদের মধ্যে যে ঝগড়া হয়েছিল, সেই ঝগড়া থেকেই বন্ধুত্ব। এখন আমরা এক আত্মা।’

‘লড়াকু’ সিনেমার শুটিংয়ের পর একাধিকবার তাঁদের দেখা হয়। বেশির ভাগ সময়ই জ্যাকি আলমগীরের ওপর উত্তেজিত হয়ে থাকতেন অভিনেতা ববি। এ ঘটনা সেই সময়ে এফডিসির অনেকেই জানতেন। অভিনেতা ববি বলেন, ‘আমাদের ইন্ডাস্ট্রি ছোট। এখানে কাজ করতে গেলে সবার সঙ্গেই প্রতিনিয়ত দেখা হয়। আমিও একসময় বুঝতে পারলাম, সে বাধ্য হয়েই আমার চরিত্রে নাম লিখিয়েছিল। পরে সে অভিনেতা হিসেবে নিয়মিত কাজ করতে থাকে। আমাদের প্রায়ই দেখা হতো। তখন আমরা অতীতের প্রসঙ্গ তুলতাম না। নিয়মিত একসঙ্গে অভিনয় করেছি। এভাবেই একসময় অভিমান ভুলে আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। তাঁর সঙ্গে রাগারাগি হওয়ার কারণে পরে সম্পর্কটা আরও মজবুত হয়েছে।’

জ্যাকি আলমগীর। ছবি: ফেসবুক

অভিনেতা ববি আরও জানালেন, ‘কাবুলিওয়ালা’সহ প্রায় শতাধিক সিনেমায় একসঙ্গে তাঁরা অভিনয় করেছেন। শুটিংয়ের এই সময়ে একসঙ্গে তাঁরা ছুটেছেন দেশের নানা প্রান্তে। তিনি বলেন, ‘একসঙ্গে চলতে গিয়ে আর অভিমান থাকে না। এই সময়ে মেশার পরে বুঝতে পারি, আমাদের মধ্যে অনেক বিষয়েই মিল রয়েছে। দিন শেষে তো আমরা অভিনয়শিল্পী। শিল্পীরা একটু ইমোশনালই হয়। দেখবেন সব শিল্পীই এই রেগে যায় আবার ঠান্ডা।’

চা খেতে খেতে ঢালিউডের দুই অভিনেতার সঙ্গে চলচ্চিত্রের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হয়। এই অভিনয়শিল্পীরা জানালেন, একসময় তাঁরা শিডিউল দিতে হিমশিম খেতেন। অনেক সিনেমা ছেড়ে দিতে হতো। কিন্তু এখন তাঁদের অনেকেই আর আগের মতো কাজে ডাকেন না। এটা তাঁদের কষ্ট দেয়।

‘কাবুলিওয়ালা’ সিনেমায় তারা অভিনয় করেছিলেন। ছবি: সংগৃহীত

অভিমান করে জ্যাকি আলমগীর বলেন, ‘আমরা তো সিনিয়র হয়ে গেছি। আমাদের এখন কাজে নিতে অনেকেই আগ্রহ দেখায় না। আবার আমাদেরও হয়তো সমস্যা রয়েছে, যোগাযোগ রক্ষা করতে পারি না। এখন পরিবার–পরিজন হয়েছে।’ তাঁর কথা শেষ না হতেই পাশ থেকে অভিনেতা ববি বললেন, ‘অভিনয় তো আমরা নিয়মিত করতেই চাই। অভিনয় দিয়েই তো দর্শক আমাদের চেনেন। সেখানে আমরা তো বলতে পারি না বা কাজ চাইতে পারি না। ডিরেক্টররা যোগাযোগ করলে আমরা নাটক বা সিনেমায় যেকোনো সময় কাজ করব।’

বেশির ভাগ সময় পর্দার বাইরে থাকলেও অভিনয় ক্যারিয়ার নিয়ে তাঁরা খুশি। এখনো নিয়মিত তাঁদের ঢালিউড সিনেমার সোনালি দিনগুলো নিয়েই আড্ডা হয়। সেগুলোকে ছাড়িয়ে আড্ডায় স্থান পায় দুই পরিবারের সুখ-দুঃখের কথা। দুজন একে অন্যের সব কথা ভাগাভাগি করেন। তাঁরা সব সময় একে অন্যের পাশে থাকেন।

অভিনেতা ববি বলেন, ‘এখন আমাদের প্রতিনিয়ত দেখা হয়। একদিনও বলা যায় দেখা বা কথা না বলে থাকতে পারি না। এমনও হয় রাতে শুধু আমরা বাসায় গিয়ে ঘুমাই। বাকি সময় আমাদের একসঙ্গেই পাবেন। আমাদের বন্ধুত্বের কথা আরও শুনতে চাইলে একদিন এফডিসিতে আসবেন। আরও অনেক কথা বলব।’ মনঃক্ষুণ্ন হয়ে জ্যাকি আলমগীর সব শেষে বললেন, ‘এখন সম্পর্কগুলো আগের মতো নাই। এখন সহশিল্পীদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয় না। সবার মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়।’

ভক্তদের সঙ্গে দুই অভিনেতা। ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন