আশপাশের বাসায় মাংস বিলি করতাম

বরেণ্য অভিনয়শিল্পী ফরিদা আক্তার ববিতার ছয় দশকের অভিনয়জীবন। ইদানিং তিনি অভিনয় করছেন না। এই অভিনেত্রীর রয়েছে ঈদ নিয়ে নানা স্মৃতি। সেই গল্প উঠে এসেছে ‘ঈদ উপহার’–এ।

ফরিদা আক্তার ববিতাছবি: প্রথম আলো

বেশ কয়েক বছর ধরে আমাকে বাংলাদেশ–কানাডা–বাংলাদেশ, এমনটা করতে হচ্ছে। কারণ, আমার একমাত্র ছেলে অনিক কানাডায় থাকে। ওখানে পড়াশোনা শেষে এখন চাকরি করছে। কানাডা গেলে আমাকে যুক্তরাষ্ট্রেও ঢুঁ মারতে হয়, সেখানে আমার ভাইয়েরা তাঁদের পরিবার নিয়ে থাকেন। তাই কখনো ঈদ উদ্​যাপন কানাডায়, আবার কখনো যুক্তরাষ্ট্রে। সিনেমায় যখন কাজ করতাম, তখন একবার ঈদের দিনও শুটিং করতে হয়েছিল। এ নিয়ে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়। কেঁদেছিলামও। তবে পৃথিবীর বেশ কয়েকটা দেশ ঈদ উদ্​যাপন করলেও বাংলাদেশের মতো ঈদের আনন্দ আর কোথাও নেই। 

ববিতা
ছবি: প্রথম আলো

কানাডার ওয়াটারলু ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে আমার ছেলে এখন চাকরি করে। ছেলের কারণে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমাকে কানাডায় যেতে হয়। আগামী জুলাইয়েও যাব। সে থাকে কানাডার কিচেনার শহরে। ঈদের সময়ে কয়েকবার সেখানে থেকেছি। দেখতাম, ঈদের দিনেও ছেলে কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আমি যখন দেশে থাকি, ঈদের দিন ফোনে জিজ্ঞাসা করি, কী করো বাবা? ওপাশ থেকে ছেলে বলে, ‘মা, অফিস করি।’ আমারও কয়েকবার কানাডায় ছেলের সঙ্গে ঈদ উদ্​যাপন করা হয়েছে। অনিক ঈদের দিন সকালে অফিসে চলে যেত, তখন আমি বাসায় একদম একা। দিনের বেলায় তাই আমি ওর জন্য পছন্দের খাবার রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। ছেলে অফিস শেষ করে বাসায় আসার পর খেয়ে আমরা ঘুরতে বের হতাম। ঘোরাঘুরি শেষে স্ন্যাকস খেয়ে বাসায় ফিরে আসতাম। এটাই ছেলের সঙ্গে আমার কানাডায় ঈদ উদ্​যাপনের চিত্র।

চিত্রনায়িকা ফরিদা আক্তার ববিতা
ছবি প্রথম আলো

অনিক আমার হাতে সব ধরনের রান্না পছন্দ করে। আমি তো একটা সময় রান্নাবান্না সেভাবে পারতাম না। শুটিংয়ের ব্যস্ততায় রান্না করার সময়ও অবশ্য পেতাম না। এখন অবশ্য অনেক ধরনের রান্না পারি। ঈদের সময় সেসব রান্না করি। দেশে থাকলে আত্মীয়স্বজন আসেন। আবার কখনো সহকারী রান্না করলেও নিজে রান্নার পুরো বিষয়টা তদারকি করি। আমার ছেলে তো এখন বলে, ‘মা তুমি তো পাকা রাঁধুনি হয়ে গেছ।’ কোরবানির ঈদের সময়ে গরুর মাংসের ভুনা রান্না করি, সঙ্গে ডালও রান্না করি। কোরবানির পর সব মাংস বিলিয়ে দিয়ে অল্প কিছু বাসার জন্য রাখা হয়। বড় একটা হাঁড়িতে ৮ থেকে ১০ কেজি রান্না করা হয়। সবাই ওটা খুব মজা করে খায়। আমাকে সবাই এ–ও বলে, খুব ভালো রান্না করি।

ববিতা ও তাঁর একমাত্র ছেলে অনিক
ছবি : ববিতার সৌজন্যে

আমি একা হলেও ঈদের সময়টায় কেউ না কেউ থাকে। কখনো বোনের পরিবার, কখনো ছেলে, এবার তো আমার ভাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে। ঈদের সময়টায় দেশে থাকবে। আমাদের একসঙ্গে আড্ডা হবে। ঈদের সময়টায় ভাইয়ের পছন্দের খাবার বানাব। মোরগ পোলাও, বিফ রোস্ট বানাব। আমার হাতের রাশিয়ান সালাদ আত্মীয়স্বজন সবারই খুব পছন্দের। ঈদের সময়টায় এটা বানাতে হয়, সবার চাহিদা থাকে। ঈদের পর আবার আমার ছেলে দেশে আসবে। তারপর কয়েক দিন দেশে ঘোরাঘুরি করে মা–ছেলে একসঙ্গে কানাডায় চলে যাব। আমি খুব ভালো চিকেন কোরমা বানাতে পারি, এটা অবশ্য বড় আপার (বরেণ্য অভিনয়শিল্পী কোহিনূর আক্তার সুচন্দা) কাছ থেকে শিখেছি। ঈদের সময়টায় সবাই মাংস খেলেও আমি চিংড়িপাতুরি বানাই, এটা আমার হাতে নাকি মন্দ হয় না, যারাই খেয়েছে, এমনটা তাদের সবার মত। এখনকার ঈদ এভাবেই কেটে যায়।

ববিতা
ছবি : ববিতার সৌজন্যে

ছোটবেলার ঈদের আনন্দ একেবারে অন্য রকম। আমরা তখন পুরান ঢাকায় থাকতাম। সবার বাড়ি বাড়ি যেতাম। দুই ঈদে সবাইকে সালাম করতাম। সালামি পাওয়া নিয়ে অনেক এক্সাইটমেন্ট কাজ করত। রোজার ঈদে নতুন জামাকাপড় নিয়ে সবার মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা চলত। কোরবানির ঈদে আনন্দটাও আবার বেশ অন্য রকম। গরু কেনা হতো। ঢাকায় তো সবার অন্য রকম ব্যস্ততা। তাই ঈদের ঠিক দুই দিন আগে গরু কেনা হতো। কোরবানির আগে গরুকে খাওয়ানো নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। আমরা তিন বোন এসব করতাম। আবার কোরবানির দিন আশপাশের বাসায় মাংস বিলি করতাম—সত্যি বলতে, ঈদে যা সবাই করে, আমরাও তা–ই করতাম।

তিন বোন ববিতা, সুচন্দা ও চম্পা
ছবি : প্রথম আলো

বাংলাদেশের মতো ঈদের আনন্দ পৃথিবীর আর কোথাও নেই, এমনটা আমার সব সময় মনে হয়। এই জীবনে অনেক দেশে ঈদ উদ্​যাপন করে তেমনই মনে হয়েছে। যখন সিনেমায় কাজ করি, একবার ঈদের সময় শুটিং করতে হয় শান্তিনিকেতনে। অশনিসংকেত ছবির শুটিং। ঈদের দিন শুটিং, তাই খুব কষ্ট লাগছিল, কেঁদেছিও। কারণ, পরিবারের সবাইকে ছাড়া ঈদ। সেটা অবশ্য রোজার ঈদ ছিল। ঈদের দিন শুটিং করছি, পরিবারের কেউ নেই, আত্মীয়স্বজনও নেই। আমার যে মন খারাপ, তা সৌমিত্রদা (অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) খেয়াল করেন। তিনি বলেন, ‘কী ববিতা, তোমার চোখ ছলছল করছে কেন, কী হয়েছে তোমার?’ আমি বললাম, ‘সৌমিত্রদা, আজ তো আমাদের ঈদ, আর আমি শুটিংয়ে! তাই মন একটু খারাপ। তখন তিনি বললেন, ‘মোটেও ভেবো না, দেখো আমরা কী করি।’

তিন বোন, তিন অভিনেত্রী—চম্পা-ববিতা-সুচন্দা
ছবি : ববিতার সৌজন্যে

সন্ধ্যার সময় দেখলাম, আমাকে খুশি করার জন্য নানা আয়োজন করা হয়েছে। আমরা গেস্টহাউসের যে রুমে ছিলাম, সেখানে দেখি, সন্ধ্যার সময় বাজি–পটকা ফাটানো হচ্ছে, তারাবাতি জ্বালানো হয়েছে। বাবুর্চিকে বলা হয়েছে সেমাই পাকাতে। তখন সৌমিত্রদা বললেন, ‘এই দেখো, আমরা ঈদ করছি।’

অনুলিখন: মনজুর কাদের