নুহাশের অন্য রকম ভৌতিক গল্প, কেন পাচ্ছে প্রশংসা?

ভূতের সঙ্গে নুহাশ হুমায়ূনের সখ্য দিন দিন বেড়েই চলেছেকোলাজ: প্রথম আলো

ভূতের সঙ্গে নুহাশ হুমায়ূনের সখ্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। ‘পোকা’, ষ-এর পর হরর জনরার তাঁর আরও দুটি ছবি মুক্তি পেয়েছে—ভিমিওতে ‘মশারি’ আর হুলুতে ‘ফরেনার্স অনলি’। আর তার পর থেকেই বাংলাদেশের নবীন এই নির্মাতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ কলকাতার পরিচালক সৃজিত মুখার্জি, ঢাকার অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনসহ দেশ-বিদেশের তারকা, সমালোচকেরা।

ভিমিওতে মুক্তি পেয়েছে নুহাশের ‘মশারি’
ছবি: সংগৃহীত

কেন এই প্রশংসা? ‘পোকা’, চরকির অ্যান্থলজি সিরিজ 'ষ'-এর ‘এই বিল্ডিংয়ে মেয়ে নিষেধ’, ‘মিষ্টি কিছু’, ‘লোকে বলে’ ও ‘নিশির ডাক’ গল্পগুলো দেশের দর্শকদের অন্য ধরনের ভৌতিক গল্পের স্বাদ দিয়েছে। কখনো মাছ, কখনো মিষ্টি বা গ্রামের লোককথাকে কেন্দ্র করেই ভৌতিক গল্পগুলো।

একসময় দেশের দর্শকদের কাছে ভৌতিক গল্প মানেই ছিল ডাইনি বুড়ি, যার মাথার চুল থাকবে সাদা। কখনো রাতে সাদা-কালো কাপড় পরে ভয় দেখাবে। কখনো কঙ্কাল হয়ে দেখা যাবে অদ্ভুত কোনো আত্মা। কখনো চরিত্ররা মানুষের রূপ নিয়ে ঘুরবে।

সেই জায়গা থেকে কতটা বের হতে পেরেছেন নুহাশ? তাঁর ‘পোকা’, ‘ষ’, ‘ফরেনার্স অনলি’, ‘মশারি’ নিয়ে দর্শকদের মন্তব্য, 'বাংলাদেশে এই মানের হরর ফিল্ম কেউ আগে করেছে কি না, জানা নেই'; 'রাতের বেলা কেউ মশারি থেকে বের হবেন না'; 'নিঃসন্দেহে নুহাশ হুমায়ূন ভৌতিক কনটেন্টের মাস্টার'; 'হরর কনটেন্ট অনেকেই নির্মাণ করেন, কিন্তু কখনোই রিয়েলিস্টিক মনে হয় না, মনে হয় না গল্পটা অনেক কাছের। সেখানে এই নুহাশ ব্যতিক্রম'; 'হররকে অন্য এক লেভেলে নিয়ে যাচ্ছেন নুহাশ।'

মশারি গল্পটি এমন। চলছে মহামারি। দুই বোন একটি পুরোনো ধাঁচের বাড়িতে থাকে। মশার হাত থেকে রক্ষা পেতে তারা মশারি দিয়ে ঘুমায়। বড় বোন ঘুমিয়ে গেলেও ছোট বোন আয়রা রাতে ঘুমায় না। ঘুম না আসায় সে মশারিতে আঙুল ঘষতে থাকে। হঠাৎ দেখা যায়, মশারি একটু ছেঁড়া। সেই জায়গা দিয়ে আঙুল বের করলেই অদ্ভুত একটি দানবের আঙুল আয়রার আঙুলকে স্পর্শ করতে এগিয়ে আসে। আয়রা ভয়ে বোনের দিকে তাকায়। পরে দেখে, মশারির ওপাশে কেউ নেই। একসময় মেয়েটি কৌতূহল নিয়ে আবার আঙুল দেয়, ঘটে একই ঘটনা। আয়রা মশারি থেকে বের হলে ঘটতে থাকে অদ্ভুত সব ঘটনা। দুই বোন কি বাঁচতে পারবে এই দানবের হাত থেকে? নির্মাণ, উপস্থাপনা ও আবহ সংগীত দারুণভাবে ভৌতিক আবহ তৈরি করতে পেরেছে।

ভৌতিক গল্প ‘মিষ্টি কিছু’
ছবি: সংগৃহীত

দর্শকদের প্রশংসা পাওয়া গল্পগুলো নিয়ে নুহাশ বলেন, 'ভূতের গল্পগুলো আমি ভিন্নভাবে দেখছি না। এগুলো আমাদের গল্প। শৈশবে নানা-দাদা-চাচারা ভূতের বা রূপকথার গল্পই করতেন। সেসব গল্পে কিছুটা ভৌতিক, কখনো সুপারন্যাচারাল বিষয় থাকত। সেই গল্পগুলোই দর্শকদের বলছি। এগুলো নিয়ে দর্শক এতটা আগ্রহ দেখাবেন, ভাবিনি। আমাদের দর্শক নতুন কিছু দেখার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। এখন ওটিটিগুলো ভৌতিক গল্প নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে।'

নুহাশের ক্যারিয়ার কিন্তু হরর জনরা দিয়ে শুরু হয়নি। হোটেল আলবাট্রস, পিৎজা ভাইকে বড় দাগে কমেডি থ্রিলার ঘরানাতেই ফেলা যায়। পরে ভৌতিক ঘরানায় ডার্ক কিছু করতে ইচ্ছা হলো। নুহাশের ভাষায়, 'তখন স্পন্সর, প্রযোজক, চ্যানেলসহ সবাই আগেই বলত, গল্প, কালার যেন বেশি ডার্ক না হয়। প্রিতমকে নিয়ে প্রথম হরর পোকা নির্মাণের সময় সবাই চাইত, কমেডি যেন বেশি থাকে। তারা ভাবত, হরর মানুষ নিতে পারবে না। তখন আমার কাছে মনে হলো, পুরোপুরি হরর একটু ট্রাই করে দেখি। পরে দেখলাম, কাজ করছে।'

হুলু’তে মুক্তি পেয়েছে ‘ফরেনার্স অনলি’
ছবি: সংগৃহীত

নুহাশ জানালেন, একটি ভৌতিক সিনেমার পরিকল্পনা করছেন। তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, ভৌতিক গল্পের প্রতি ভালোবাসা কীভাবে জন্ম নিল? তিনি বলেন, 'বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে ভূতের গল্পটার সম্পর্ক রক্তের মতো। এই গল্পগুলো আমাদের সাহিত্যে আছে, আমাদের জীবনে আছে, কিন্তু স্ক্রিনে তেমন একটা নেই। সেটা থেকে মনে হলো ভৌতিক গল্প নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা যায়।'আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসা ও পুরস্কার পাওয়া মশারি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ করেছে। তারা কেউ এটাকে নারীবাদী, কেউ তৃতীয় বিশ্বের সঙ্গে প্রথম বিশ্বের সম্পর্ক, কেউ আবার বলছে, এটা আসলে জলবায়ু পরিবর্তনের গল্প। নুহাশ জানান, 'দর্শক-সমালোচক ভৌতিক সিনেমাগুলো থেকে অনেক ধরনের মিনিং বের করছেন। এটা বেশ ভালো লাগছে।'

এসব কারণেই হয়তো ভৌতিক গল্পের প্রতি তাঁর দুর্বলতা সবচেয়ে বেশি। তাঁর অনুপ্রেরণা জর্ডান পিল। গেট আউট সিনেমা দিয়ে অস্কার জিতেছিলেন এই পরিচালক। তবে নুহাশের সব কাজের অন্যতম অনুপ্রেরণা সত্যজিৎ রায়। সর্বশেষ নুহাশ বলেন, 'বাংলা কালচারকে মিক্স করে ভৌতিক গল্পের নতুন একটা ভাষা সৃষ্টি করতে চাই।'

‘নিশির ডাক’ এর পোস্টার
ছবি: সংগৃহীত

প্রথমে থ্রিলার, পরে মিউজিক ভিডিও নির্মাণের পর সবাই ধরে নিয়েছিল, নুহাশ হয়তো থ্রিলার বা মিউজিক ভিডিওতেই বন্দী থাকবেন। কমেডি নির্মাণ করে এই ধারণা বদলে দিলেন নুহাশ। আর এখন ভৌতিক গল্প নির্মাণের পর নুহাশকে কেউ কোনো আলাদা ধারার মধ্যে বন্দী করতে পারবে না। নুহাশ নিজেও কোনো নির্দিষ্ট ধারার নির্মাতা হতে চান না। সত্য কাহিনি অবলম্বনে শিগগির শুরু করতে যাচ্ছেন ভিন্ন জনরার ‘মুভিং বাংলাদেশ’। এ ছাড়া ভৌতিক গল্প নিয়েও সিনেমা নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন।