‘হারানো দিন’ থেকে ‘আম্মাজান’—শবনমের পূর্ণতার যাত্রা

শবনমছবি: সংগৃহীত
মাত্র ১৫ বছর বয়সে অভিনয় শুরু শবনমের। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান মিলিয়ে টানা চার দশকের অভিনয়জীবন তাঁর। ২৬ বছর ধরে অভিনয়ে নেই তিনি। এরপরও চলচ্চিত্রের বিভিন্ন আড্ডায় প্রাসঙ্গিক। আজ তাঁর জন্মদিন। শবনমকে নিয়ে লিখেছেন মনজুর কাদের

‘হারানো দিন’ সিনেমা দিয়েই শবনম সাড়া ফেলেন। এ সিনেমার ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি, ইরান-তুরান পার হয়ে আজ তোমার দেশে এসেছি’ গানটি আজও যেন দর্শকের মুখে মুখে। গানটিতে পর্দায় ঠোঁট মিলিয়েছিলেন শবনম। অভিষেক সিনেমাই সুপারহিট। এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া। মুস্তাফিজ পরিচালিত সিনেমাটি ১৯৬১ সালে মুক্তি পায়।

ষাট থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত বাংলাদেশ আর পাকিস্তান মিলিয়ে প্রায় ১৮৫টি সিনেমায় অভিনয় করেন শবনম। তিনিই একমাত্র অভিনেত্রী, যিনি পাকিস্তানি সিনেমার সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘নিগার অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন মোট ১৬ বার। তাঁর এ রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারেনি। এক বছর আগে পাকিস্তান সরকার দেশটির তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার সিতারা-ই-ইমতিয়াজ দেন শবনমকে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও পাকিস্তান মিলিয়ে বহু সম্মাননায় সমৃদ্ধ হয় তাঁর অর্জনের ঝুলি।

বরেণ্য অভিনয়শিল্পী শবনমের আসল নাম ঝর্ণা বসাক। ১৯৪৬ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকার নবাবপুরে জন্ম। পরিচালক এহতেশামের ‘চান্দা’ সিনেমায় ১৯৬২ সালে অভিনয় করেন তিনি। এই নির্মাতা ‘হারানো দিন’ সিনেমায় তাঁকে শবনম নামটি দেন। ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকেন শবনম।

সত্তর দশকের শুরুতে শবনম পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করেন। ১৯৮৮ সালে শবনম ঢাকা ও লাহোরের সিনেমায় একসঙ্গে অভিনয় করতে থাকেন। নব্বই দশকের শেষভাগে ঢাকায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সর্বশেষ তিনি অভিনয় করেন ‘আম্মাজান’ সিনেমায়। এ সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করে সব বয়সী দর্শকের কাছে ‘আম্মাজান’ হিসেবে নতুন করে পরিচিতি পান।

শবনম বলেন, ‘ভাগ্য আমার এতটাই ভালো, আমার অভিনীত প্রথম ও শেষ সিনেমা ছিল আমার ক্যারিয়ারের সেরা ও হিট সিনেমা।’

শবনম
ছবি: সংগৃহীত

এখন যেমন

‘এ দেশ তোমার আমার’, ‘হারানো দিন’, ‘আমার সংসার’, ‘কখনো আসেনি’, ‘চোর’, ‘জোয়ার ভাটা’, ‘জুলি’, ‘নবারুণ’, ‘নাচঘর’, ‘নাচের পুতুল’, ‘সন্ধি’, ‘রাজধানীর বুকে’, ‘সহধর্মিণী’, ‘আম্মাজান’সহ বাংলা–উর্দু মিলিয়ে ১৮৫টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন শবনম। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কারণে একমাত্র ছেলে রনি ঘোষকে ততটা সময় দিতে পারেনি। এ নিয়ে মা শবনমের যত আফসোস।

গতকাল শনিবার দুপুরে আলাপকালে তেমনটাই জানালেন—অভিনয় বন্ধ করে দেওয়ার পর পরিবার আর ছেলেকেই সময় দিচ্ছেন। এই সময়টা তাঁর জন্য বেশ উপভোগ্যও।

শবনম বললেন, ‘এখনকার সময়টা আমার ভালো লাগে। ছেলের সঙ্গে থাকি, তাই বেশ উপভোগ করি। মা-ছেলে দুজনে বাইরে বেড়াতে যাই। ঢাকার রাস্তায় ঘুরি। মন চাইলে কোনো রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ি। পছন্দের খাবার খেয়ে ঘরে ফিরি। এই যে ঘোরাঘুরি, এটা মজা লাগে—যেটা অনেক বছর করা হয়নি। ছেলে আমার ছোটবেলা থেকে লন্ডনে পড়াশোনা করেছে। ছবির শুটিংয়ে ব্যস্ত আমি ছেলেকে সময় দিতে পারতাম না। মাঝেমধ্যে যখন লন্ডন যেতাম, ১৫ দিন কিংবা ১ মাস থেকে আসতাম। আবার ছেলের যখন ছুটি হতো, সে–ও আসত। এই যা। তাই গত ২৬ বছর মা–ছেলের দারুণ সময় কাটছে।’

শবনম
ছবি : চ্যানেল আইয়ের সৌজন্যে

শবনম জানালেন, বয়স তো হয়েছে। চাইলেও যখন–তখন দূরে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। ঢাকার বিভিন্ন জায়গা এবং আশপাশে ঘোরাঘুরি করেন। দেশের মধ্যে দূরে কোথাও ঘোরাঘুরির ক্ষেত্রে সমুদ্রটা বেশি টানে এই অভিনয়শিল্পীকে। জানালেন, তাঁর সময়ে বেশির ভাগ সিনেমার শুটিংয়ে কক্সবাজার যাওয়া হতো। শুটিংয়ে যেতে যেতে সমুদ্রের প্রেমে পড়ে যান তিনি।

বর্তমানে ঢাকায় নিজের বাসাতেই থাকেন শবনম। বই পড়া, গান শোনা, সিনেমা দেখা ও ঘরের কাজকর্ম করেই এখন সময় কাটান। তিনি বলেন, ‘এখনো নিয়মিত বাজারে যাই, আমিই বাজার করি। বাজারে যাওয়ামাত্রই সবাই বলে, ওই যে আম্মাজান আসছেন, রূপনগরের রাজকন্যা আসছেন। খুব ভালো লাগে আমার। শিল্পীজীবনের বড় পাওয়া এটা।’

শবনম
ছবি: সংগৃহীত

সোনালি সময়ের পুরোনো বন্ধু

শবনমের অভিনয়জীবনের সোনালি সময় কোথায় কেটেছে? চোখ বন্ধ করে যে কেউ বলবে, পাকিস্তানে। নাদিমের সঙ্গে জুটি হয়ে ৫০টির বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। শবনম–নাদিম পাকিস্তানি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ব্যবসাসফল ও আলোচিত এক জুটি। সেখানে কাজ করতে গিয়ে, সমসাময়িক শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক তৈরি হয়। এখনো তাঁদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। অভিনয় ছাড়ার পর মাঝেমধ্যে দেশটিতে যেতেন, বেশ কিছুদিন বেড়িয়ে আসতেন, দেখা করতেন সেই সময়ের সহকর্মীদের সঙ্গে। তবে বাংলাদেশে থাকলেও ফোনে যোগাযোগ হয় অনেকের সঙ্গে। শনিবার দুপুরে কথা প্রসঙ্গে শবনম জানালেন, শুক্রবারও কথা হলো জেবার (পাকিস্তানি নায়িকা) সঙ্গে। আঞ্জুমানের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। নাদিমের সঙ্গেও আলাপ হয় মাঝেমধ্যে। আমি ফোন করি, তারা করে। আমাদের সবার মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে।’ পাকিস্তান ছাড়া বাংলাদেশের শিল্পীদের সঙ্গে কাজ হয়েছে। অনেকে এখন আর জীবিত নেই। যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের মধ্যে রুনা লায়লা, পারভেজ সাহেবের (মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা) সঙ্গে কথাবার্তা মাঝেমধ্যে হয়।

রূপনগরের রাজকন্যা

‘হারানো দিন’ সিনেমায় ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি, ইরান-তুরান পার হয়ে আজ তোমার দেশে এসেছি’ গানটিতে দেখা যায় শবনমকে। এর পর থেকে তাঁকে সবাই ‘রূপনগরের রাজকন্যা’ বলেই ডাকে। এই ডাকটা তাঁকে অন্যরকম ভালো লাগায় ভরিয়ে দেয়। গতকাল শনিবার দুপুরে এ নিয়ে তাৎক্ষণিক একটি ঘটনার কথা বললেন এভাবে, পাকিস্তানে আমি তখন তুমুল ব্যস্ত। একটা সময় ঢাকায় আসি। প্রথম যখন বাংলাদেশে এলাম, বিমাবন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তা তাকাচ্ছিলেন। আমি সিঁড়ি দিয়ে নামছি। আমার চেয়ে বয়সে বড় হবে, এগিয়ে এসে বললেন, আপনি রূপনগরের রাজকন্যা না? আপনার লাগেজ দেখা লাগবে না।’

১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর শবনম বিয়ে করেন খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক রবীণ ঘোষকে। ২০১৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মারা যান তিনি। তাঁদের একমাত্র পুত্র রনি ঘোষ। বারিধারা ডিপ্লোম্যাট জোনে মা-ছেলের সংসার। বাড়ির বেশির ভাগ কাজ এখনো নিজ হাতে সামলান শবনম। জানালেন, বাজারসদাই নিজ হাতে করেন। নিজে বাজারে যান। খাবারের ক্ষেত্রে মাছ বেশি প্রিয় বলে জানালেন শবনম। বললেন, ‘আমি ভেতো বাঙালি। ছোট মাছ বেশি ভালো লাগে। বড় মাছের মধ্যে ইলিশ পছন্দ। মাংস খুব কম খাই। মাঝেমধ্যে ছেলের জন্য রান্না করি। আবার ছেলেও আমার জন্য রান্না করে। ছেলের আবার বাঙালি খাবার কম পছন্দ।’

গত শতকের ষাটের দশকের ছবিতে চিত্রনায়িকা শবনম
ছবি: সংগৃহীত

পূর্ণতার অভিনয়জীবন

নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেন। তবে বাংলাদেশের আসার পরও পরবর্তী ১০ বছর বিভিন্ন সময় শবনমের একাধিক সিনেমা উর্দু ভাষায় মুক্তি পেয়েছে। শেষ ছবি ‘আম্মাজান’ সুপারহিট ব্যবসা করে। অভিনয়জীবন নিয়ে কোনো অপূর্ণতা নেই বলে জানালেন বরেণ্য এই শিল্পী। বললেন, ‘একজীবনে এত ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছি, মানুষের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পেয়েছি—যা যে কারও জন্য সৌভাগ্যের। একজীবনে এমন ভালোবাসা অতুলনীয়। এখনো বাইরে বের হলে টের পাই।’

‘শবনম: রূপনগরের রাজকন্যা’ অনুষ্ঠানে শবনম ও সাংবাদিক আবদুর রহমান
ছবি : চ্যানেল আইয়ের সৌজন্যে

আজকের আয়োজন

৮০তম জন্মদিনে ছোট পর্দার দর্শকদের সামনে আসছেন তিনি। সাংবাদিক আবদুর রহমানের উপস্থাপনা ও পরিচালনায় চ্যানেল আইয়ে ‘শবনম: রূপনগরের রাজকন্যা’ শিরোনামের বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে আজ রাত ৮টা ২৫ মিনিটে। এতে জীবনের নানা অজানা গল্প শোনাবেন নায়িকা।