এককালের সাড়া জাগানো নায়িকা অলিভিয়া এখন কোথায়

অলিভিয়াসাপ্তাহিক বিচিত্রা/ বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র’র ফেসবুক পেজ থেকে

রুনা লায়লার গাওয়া ‘চঞ্চলা হাওয়ারে’ যাঁরা শুনেছেন, তাঁরাই ভেসেছেন মুগ্ধতায়। উপমহাদেশীয় এই সংগীত তারকার দরদভরা কণ্ঠের এ গান পর্দায় যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের চোখ আটকে ছিল নায়িকা অলিভিয়ায়। তাঁর আবেদনময় রূপে মুগ্ধ হন দর্শকেরা। ‘দ্য রেইন’ ছবির সেই আলোচিত নায়িকা এখন একেবারেই লোকচক্ষুর আড়ালে। তাঁকে এখন আর কোথাও দেখা যায় না। তিন দশকের মতো সময় ধরে অন্তরালে আছেন অলিভিয়া।

আরও পড়ুন

যে চলচ্চিত্র অলিভিয়াকে মানুষের মনের কোণে জায়গা করে দিয়েছিল, সেই অলিভিয়া ছবিকে বিদায় জানিয়েছেন নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট কোনো আড্ডায়ও দেখা যায় না তাঁকে। তবে জ্যেষ্ঠ শিল্পী ও কলাকুশলীদের আড্ডায় থাকে তাঁর নাম। এই যেমন কেমন আছেন, কী করছেন এখন অলিভিয়া? তবে কেউই জানেন না যে কী করছেন তিনি। হঠাৎ হঠাৎ তাঁর সঙ্গে দেখা হয়, অগ্রজ ও সমসাময়িক কয়েকজন নায়িকার। তবে তা চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট কোনো আড্ডায় নয়। তাঁদের কারও সঙ্গে কখনো পার্কে হাঁটতে গিয়ে দেখা, আবার কারও সঙ্গে পারলারে। দেখার পর কথা হয়, এরপর আবার যাঁর যাঁর মতো করে তাঁরা চলে যান। অলিভিয়ার সঙ্গে যাঁদের কথা হয়, তাঁদের ভাষ্যে, এই নায়িকা নিজের মতো করে থাকতে চান। তাই কেউ আড়ালে থাকার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্নও করেন না।

দুই বছর আগে অলিভিয়ার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ববিতার। এই নায়িকার সঙ্গে চার-পাঁচটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করা হয়েছে বলে জানান ববিতা। অলিভিয়া প্রসঙ্গে ববিতা বলেন, ‘আমি ঢাকার বনানীর একটি পারলারে যেতাম। সেখানেই বছর দুই-তিনেক আগে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত ওটাই শেষ দেখা। আমাকে দেখে সালাম করেছিলেন। জড়িয়ে ধরেছিলেন। কিছু সময় কথা হয়। কিন্তু কোথায় থাকেন, সে বিষয়ে কিছুই জানতে চাইনি। ব্যক্তিগত বিষয়ে তিনিও কথা বলতে চাননি। আমার যত দূর মনে পড়ে, শফি ভাইয়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নেন। সবার থেকে আলাদা হয়ে যান।’

চলচ্চিত্রের দৃশ্যে
সংগৃহীত

কথায় কথায় অলিভিয়া সম্পর্কে ববিতা আরও বলেন, ‘সুন্দরী আর ভালো অভিনয়শিল্পীর পাশাপাশি অলিভিয়াকে সত্যিকার অর্থে একজন ভালো মেয়ে মনে হয়েছিল। আমারও তাঁকে খুব ভালো লাগত। জহির (রায়হান) ভাইয়ের “লেট দেয়ার বি লাইট” ছবিটি আমার করার কথা ছিল। একসময় যখন ভাবলাম, ছবিটি করব না, তখন জহির ভাই অলিভিয়ার সঙ্গে কথা বললেন। ছবি তুললেন। এরপর হঠাৎ শুনি, অলিভিয়া নয়, আমিই ছবিটি করছি। এর বাইরেও আমরা একসঙ্গে কয়েকটা ছবিতে কাজ করেছি।’

অলিভিয়াসহ একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে নানা মজার সময়ও কাটত বলে জানান ববিতা। তিনি বলেন, ‘অলিভিয়া ভূতের ভয় পেতেন। জমিদারবাড়িতে শুটিং করলে রাতে আমরা বাইরে বের হলেও তিনি বের হতেন না। সকালে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, “আমার না ভূতের ভয় আছে।” আমাকে খুব সম্মান করতেন। আরেকটা বিষয়, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে বললে খুব খুশি হতেন। বলতেন, “এই, কী খাবেন? মিষ্টি খাবেন?” তবে এটাও ঠিক, অলিভিয়া খুবই সুন্দরী ছিলেন।’

আরও পড়ুন

কয়েক বছর আগে ঢাকার বারিধারার একটি পার্কে হঠাৎ অলিভিয়ার সঙ্গে দেখা হয় বরেণ্য অভিনয়শিল্পী শবনমের। সেই অভিজ্ঞতা এভাবেই বর্ণনা করলেন তিনি, ‘কয়েক বছর আগে আমার সঙ্গে রাজধানীর বারিধারা পার্কে দেখা হয়েছিল। তখন কথা হয়। এরপর তাঁর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। যখন অলিভিয়ার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তখন পার্কে হাঁটতে এসেছিলেন। তার পর থেকে আমি এখনো নিয়মিত পার্কে হাঁটলেও তাঁর দেখা আর পাইনি কোনো দিন।’

অলিভিয়া
ইউটিউব থেকে

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, পরিচালক সমিতির কেউও কোনো খোঁজখবর জানেন না অলিভিয়ার। কেউ বলেন, ঢাকার বনানীতে আছেন; কেউ বলেন, গুলশানের কোথাও থাকেন তিনি। তবে অলিভিয়ার ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার

যোগাযোগ করা হলেও কল ধরে কথা বলেননি। একটা সময় পর কল কেটে দেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, অলিভিয়া নিজের মতো করে থাকতে চান। নিজের জীবন নিয়ে এখন আর কারও সামনে আসতে চান না। তাই সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন।

১৯৭২ সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা এস এম শফির ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’ সিনেমায় প্রথম অভিনয় করেন অলিভিয়া। এর আগে তিনি জহির রায়হানের ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ ছবিতে অভিনয় করার প্রস্তাব পেয়েছিলেন। কিন্তু ছবিটিতে শেষ পর্যন্ত অভিনয় করেন ববিতা।

১৯৭৬ সালে বাংলাদেশি নায়িকাদের মধ্যে উত্তমকুমারের সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন অলিভিয়া। ‘বহ্নিশিখা’ নামের সেই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ছবিতে সুপ্রিয়া দেবীর চেয়ে অলিভিয়ার চরিত্রের গুরুত্ব ছিল বেশি। গল্পে তাঁকে গোয়েন্দা চরিত্রের উত্তমকুমারের অনুগত কর্মী চরিত্রে দেখা যায়। উত্তমকুমারের সঙ্গে অলিভিয়ার অভিনয় ছিল অনবদ্য। ববিতার পর কলকাতায় অলিভিয়াই দ্বিতীয় অভিনেত্রী ছিলেন তখন। একই বছরে লাক্সের বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করেন। তবে অলিভিয়া নিজেকে আলোচনায় আনেন ‘দ্য রেইন’ ছবি দিয়ে। এরপর ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম।

অলিভিয়ার জন্ম ১৯৫৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের করাচিতে। দেশভাগের পর অলিভিয়ার পরিবার পশ্চিম পাকিস্তান ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশে) চলে আসে। ওই সময় পরিবারটি ঢাকার মগবাজারে ইস্পাহানি কলোনির গলিতে বসবাস করত। খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী এই পরিবারের আদি নিবাস ছিল ভারতের গোয়ায়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, অলিভিয়া হোটেল পূর্বাণীতে রিসিপশনিস্ট হিসেবে কাজ করতেন। তাঁরা ছিলেন তিন ভাই ও চার বোন। এক বোন বাংলাদেশ বিমানের এয়ারহোস্টেস ছিলেন। আরেক বোন কলকাতায় থাকতেন। বাবা বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকার রিডিং সেকশনে কাজ করতেন। ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করা অলিভিয়া মাত্র ১৪ বছর বয়সে মডেলিং শুরু করেন। তখন একাধিক বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। তিনি ৫৩টি ছবিতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্র নির্মাতা এস এম শফিকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের রক্ষণশীল বৈশিষ্ট্যের বাইরে প্রথম অভিনয় করেছিলেন অলিভিয়া। নায়ক ওয়াসিমের সঙ্গে তাঁর জুটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। তাঁর অভিনীত শেষ চলচ্চিত্র ‘দুশমনি’। মুক্তি না পাওয়া চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে ‘মেলট্রেন’, ‘প্রেম তুই সর্বনাশী’।

অলিভিয়া অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে ‘মাসুদ রানা’, ‘দ্য রেইন’, ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’, ‘বহ্নিশিখা’, ‘যাদুর বাঁশি’, ‘পাগলা রাজা’, ‘বাহাদুর’, ‘শাহজাদী’, ‘গুলবাহার’, ‘বেদ্বীন’, ‘শ্রীমতি ৪২০’, ‘চন্দ্রলেখা’, ‘টক্কর’, ‘হিম্মতওয়ালী’, ‘ডার্লিং’, ‘রাস্তার রাজা’, ‘বন্ধু’, ‘লাল মেমসাহেব’, ‘তকদিরের খেলা’, ‘সতীনাথ কন্যা’, ‘ভাইবোন’, ‘নাগ নাগিনী’, ‘জংলি রাণী’, ‘জামানা’, জীবন সংগীত’, ‘শপথ নিলাম’, ‘টাকার খেলা’, ‘দূর থেকে বলছি’, ‘সেয়ানা’, ‘তীর ভাঙা ঢেউ’, ‘শাপমুক্তি’, ‘একালের নায়ক’, ‘কুয়াশা’, ‘আগুনের আলো’, ‘কালা খুন’, ‘আগুন পানি’, ‘দুশমনি’ ইত্যাদি।