‘হুমায়ূন স্যারের চোখে জল, আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন...’

অভিনেতা ডা. এজাজের লেখা স্মৃতিচারণা গ্রন্থ ‘হুমায়ূন স্যারের চোখে জল’-এ। সেখানেই রয়েছে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবির শুটিংয়ের গল্পকোলাজ

হুমায়ূন আহমেদ ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমা তৈরির সময়ের একটি ঘটনার জন্য চোখের জল ফেলেছিলেন। কিন্তু কেন? কী এমন ঘটেছিল যে তাঁর চোখ বৃষ্টির ফোঁটার মতো জলধারায় ভেসে গিয়েছিল? ঘটনাটির অবতারণা করার আগে কিছু কথা বলে নেওয়ার আবশ্যকতা আছে।
‘আনন্দকে তীব্র করার জন্য কষ্টের প্রয়োজন আছে। তাই না?... ডাক্তার সাহেব, তুমি আমার জন্য দুফোঁটা চোখের জল ফেলেছ, তার প্রতিদানে আমি “জনম জনম কাঁদিব”।’ হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘তেতুঁল বনে জোছনা’-এর একেবারে শেষ অংশে রয়েছে এই কথাগুলো। বলা ভালো, সচেতনভাবেই এমন উদ্ধৃতি মনে করা প্রয়োজন। কারণ, সৃষ্টিশীল মানুষের ক্ষেত্রে চোখের জল প্রায়ই নির্বাক ভাষায় আত্মপ্রকাশ করে। তাঁদের অনুভূতি তুচ্ছ কারণেও গভীর হয়ে ওঠে, তাঁদের মনের কষ্ট সহজে চেপে রাখা যায় না। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন এমনই একজন শিল্পী, যাঁর ভেতরে ছিল শিশুসম কোমলতা আর গভীর আবেগে গড়া এক অভিমানী হৃদয়।

তাঁর আত্মজীবনীমূলক লেখা ও বিভিন্ন স্মৃতিচারণা পাঠ করলে অনায়াসেই বোঝা যায়, হুমায়ূন ছিলেন স্বপ্নবান, দৃঢ়চেতা এবং একই সঙ্গে প্রচণ্ড সংবেদনশীল। জীবনে তিনি যা করেছেন, করেছেন একেবারে ঝোঁকের মাথায়। রসায়নে ডক্টরেট সম্পন্ন করে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একাডেমিক ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে শুধু গল্প বলার নেশায় তিনি পা রেখেছিলেন লেখালেখিতে।

লেখালেখির পর নাটক, নাটকের পর সিনেমা—একটি মানুষের মধ্যে এতগুলো সৃজনশীল জগতের গভীর মিশেল সচরাচর দেখা যায় না। অথচ এই মানুষটিই ছিলেন ভীষণ সহজ, ভীষণ মানবিক।

লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ
ফাইল ছবি

১৯ জুলাই, হুমায়ূন আহমেদের চলে যাওয়ার দিন। এই দিনে তাঁকে স্মরণ করা মানে কেবল একজন লেখককে স্মরণ করা নয়, বরং একজন অভিমানী শিল্পীর আত্মার গভীরতায় ডুব দেওয়া; তাঁর অশ্রু, ভালোবাসা, স্বপ্ন ও কষ্টকে ছুঁয়ে দেখা। আর এমনই এক কষ্টঘন, হৃদয়বিদারক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ও বন্ধু অভিনেতা ডা. এজাজের লেখা স্মৃতিচারণা গ্রন্থ ‘হুমায়ূন স্যারের চোখে জল’-এ। সেখানেই রয়েছে সেই বিখ্যাত কান্নার গল্প, যা ঘটেছিল ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবির শুটিংয়ের সময়।
সিনেমাটি নির্মাণকাজের সময় হুমায়ূন আহমেদ শুটিং স্পটের সব দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলেন ডা. এজাজকে। শিল্পীদের আনাগোনা, থাকা-খাওয়া, শুটিং স্পটের পরিবেশ, সময়মতো খাদ্যসরবরাহ, পরিচালকের নির্দেশনা অনুসারে স্থান নির্বাচন—সব দায়িত্বই তাঁকে দিয়ে নিখুঁতভাবে সামলানো হচ্ছিল। হুমায়ূন সব সময়ই নিজের চারপাশের মানুষদের ওপর নির্ভর করতেন, কিন্তু সেই নির্ভরতার ভেতরেই থাকত তাঁর অভ্যন্তরীণ কঠোর শিল্পসংবেদন। এতটুকু বিচ্যুতিও তাঁর অসহ্য ছিল।
একদিন খাবার পরিবেশন চলাকালে এক অভিনেতা হঠাৎ বলে বসেন, খাবারে এত তেল যে খেয়ে তাঁর পেট খারাপ হয়ে গেছে। হুমায়ূন আহমেদ তখন পাশেই ছিলেন। কথাটা কানে যেতেই সঙ্গে সঙ্গে চটে যান। বাবুর্চিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তরকারিতে এত তেল কেন?’ বাবুর্চির সোজাসাপটা উত্তর, ‘স্যার, মাছটা নদীর বড় পাঙাশ। তেল তো হবেই।’ কিন্তু সেই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হননি হুমায়ূন আহমেদ। রাগ গিয়ে পড়ল দায়িত্বে থাকা ডা. এজাজের ওপর। কিছু বলার আগেই প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলেন, ‘সব দায়িত্ব কাউকে বুঝিয়ে দিয়ে এখান থেকে চলে যান।’

ডা. এজাজ হতভম্ব হয়ে যান। হুমায়ূনের সঙ্গে এত দিনের কাজের সম্পর্ক, ঘনিষ্ঠতা—সবকিছু মুহূর্তেই যেন মুছে গেল! তিনি কোনো প্রতিবাদ না করে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে একরকম অপমানিত হয়ে চলে যান। এ ঘটনার রেশ কাটতে কাটতে গিয়ে হাজির হন হুমায়ূনের সহকারী পরিচালক অভিনেত্রী শামীমা নাজনীনের কাছে। নিজের অভিমান, কষ্ট আর ব্যাখ্যা তুলে ধরে বলেন, ‘স্যার বুঝতে পারছেন না, শিল্পীর পেট খারাপ হওয়ার পেছনে খাবারের দায় কম, তার আগে সে নিজেই নানা রকম জাঙ্কফুড খেয়ে এসেছে। আর কেউ তো অভিযোগ করেনি। অথচ এই সামান্য বিষয়েই আমি হয়েছি অপদস্থ।’ শামীমা সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘আপনি বাসায় যান, আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলব।’
এ ঘটনার কিছুদিন পর হুমায়ূন আহমেদ একটি টেলিফিল্মে অভিনয়ের জন্য ডা. এজাজকে ডাকেন। এজাজের তখনো সন্দেহ, তিনি কি অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে গেছেন? সুযোগ দেওয়া হবে তো? শামীমার সঙ্গে আবারও যোগাযোগ করেন এবং তাঁর মাধ্যমেই নিশ্চিত হন, তাঁকে অভিনয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। শুরু হয় তিন দিনের শুটিং। প্রথম দুই দিন হুমায়ূন আহমেদ কোনো কথা বলেন না তাঁর সঙ্গে। সবকিছুই নির্বিকারভাবে চলতে থাকে। কিন্তু তৃতীয় দিন হঠাৎ তিনি সবাইকে সামনে ডেকে পাঠান।

শ্রাবণ মেঘের দিন
‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন মাত্রা যোগ করা একটি উল্লেখযোগ্য সিনেমা। ২০০০ সালের ৩১ মার্চ বিটিভিতে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার এবং একই দিনে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়া এই ছবি সাতটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। হুমায়ূন আহমেদের রচিত ও পরিচালিত এ সিনেমার গল্প গড়ে উঠেছে মতি নামে এক গ্রামীণ গায়ক ও কুসুম নামের তরুণীকে কেন্দ্র করে। ছবিটি ভাটির সংস্কৃতি, গ্রাম্যজীবন ও মানুষের আবেগকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলে। ময়মনসিংহের লোককবি উকিল মুন্সীর গান যেমন ‘সোয়াচান পাখি’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘পূবালী বাতাস’, ‘মানুষ ধরো মানুষ ভজো’ ও ‘ওগো ভাবীজান’ ছবিতে প্রাণ সঞ্চার করেছে। গানগুলোয় কণ্ঠ দেন বারী সিদ্দিকী, যিনি রাতারাতি তারকা খ্যাতি পান। সুবীর নন্দীর গাওয়া ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ গানটি দেশজুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। অভিনয়ে জাহিদ হাসান (মতি মিয়া), মেহের আফরোজ শাওন (কুসুম), মাহফুজ আহমেদ (সুরুজ) অসাধারণ পারফরম্যান্স দেন। সালেহ আহমেদ, আনোয়ারা, ডা. এজাজ, শামীমা নাজনীন, গোলাম মুস্তাফা, মুক্তিসহ অনেকে শক্তিশালী অভিনয় উপহার দেন। চলচ্চিত্রটি বাণিজ্যিক সফলতার পাশাপাশি শিল্পসম্মত হিসেবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জগতে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। হুমায়ূন আহমেদের নির্দেশনায় ছবির সংলাপ ও আঞ্চলিক সংস্কৃতির মিশ্রণ চলচ্চিত্রকে অনন্য রূপ দিয়েছে, যা মধ্যবিত্ত দর্শককে আবারও প্রেক্ষাগৃহে টানে।
‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

ডা. এজাজের মনে তখন দুশ্চিন্তা, তাঁকে কিছু বলবেন না তো? অপমান করবেন না তো আবার? কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ তাঁর দিকে তাকিয়ে এক গাঢ় কণ্ঠে যা বলেন, তা একদিকে যেমন হৃদয়স্পর্শী, তেমনি আত্মিক সম্পর্কের এক জ্বলন্ত প্রমাণ।

তিনি বললেন, ‘দেখো ডাক্তার, তোমাকে আমি এত স্নেহ করি, তুমি সেটা এত দিনেও বুঝনি। এত বড় নির্বোধ তুমি! আমি তোমাকে বেশি বকা দিই, কারণ আমি মনে করি, তোমার ওপরেই আমার অধিকার সবচেয়ে বেশি। একজন শিল্পী যখন সেদিন বলল, আমার ইউনিটের খাবার খেয়ে তার পেট খারাপ হয়েছে, এটা আমাকে দারুণ কষ্ট দিয়েছিল। রাগে তোমার ওপর মেজাজ ঠান্ডা করেছিলাম। তুমি বুঝলে না? আমি বলেছিলাম, দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চলে যেতে, আর তুমি সত্যি সত্যি চলে গেলে? কী চিনলে তুমি আমাকে, ডাক্তার?’

হুমায়ূন আহমেদ উঠে দাঁড়িয়ে ডা. এজাজকে বুকে টেনে নেন। তাঁর মাথায় ঝরে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা জল। ডা. এজাজ পরে লিখেছেন, ‘আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি, আমার চুল ভিজে যাচ্ছে কেন! ভাবলাম বৃষ্টি নামল কি না। তারপর বুঝলাম, হুমায়ূন স্যারের চোখে জল। তিনি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন।’

এ বক্তব্যের একেকটি শব্দ যেন গলে পড়ছিল এজাজের বুকে। তিনি তখনো কিছু বলতে পারেননি। কিন্তু মুখ তুলে তাকাতেই দেখেন, হুমায়ূন আহমেদের চোখে জল। না, সে জল কেবল অভিমানের ছিল না। তাতে মিশে ছিল এক বন্ধুকে হারিয়ে ফেলার ভয়, নিজের আবেগের সীমারেখা টপকে যাওয়া একজন মানুষের অনুশোচনা, স্নেহ ও অপরিসীম ভালোবাসার প্রকাশ।

হুমায়ূন আহমেদ উঠে দাঁড়িয়ে ডা. এজাজকে বুকে টেনে নেন। তাঁর মাথায় ঝরে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা জল। ডা. এজাজ পরে লিখেছেন, ‘আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি, আমার চুল ভিজে যাচ্ছে কেন! ভাবলাম বৃষ্টি নামল কি না। তারপর বুঝলাম, হুমায়ূন স্যারের চোখে জল। তিনি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন।’

অভিনেতা ডা. এজাজের লেখা স্মৃতিচারণা গ্রন্থ ‘হুমায়ূন স্যারের চোখে জল’-এ। সেখানেই রয়েছে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবির শুটিংয়ের গল্প
কোলাজ

এই কান্না কেবল একজন ব্যক্তিগত বন্ধুর জন্য নয়, এই কান্না ছিল এক শিল্পীর মনের ভেতরে জমে থাকা অভিমান, যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। যিনি নিজের সৃষ্টি নিয়ে এতটাই নিবেদিত ছিলেন যে ইউনিটের একটি খাবার–সংক্রান্ত মন্তব্যকেও অপমান হিসেবে নিয়েছিলেন এবং যখন বুঝলেন, ভুল–বোঝাবুঝিতে তিনি নিজের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সঙ্গীকে আঘাত করেছেন, তখন আর আবেগ থামিয়ে রাখতে পারেননি।
হুমায়ূন আহমেদ এমনই ছিলেন। সৃষ্টিশীলতায় আপসহীন, সংবেদনশীলতায় অসাধারণ। তিনি কখনো জনপ্রিয়তার কাছে মাথানত করেননি, কখনো নাটকের গল্প পাল্টাননি দর্শকের দাবিতে, কখনো শিল্পকে পেছনে সরিয়ে দেননি প্রতিষ্ঠানের নিয়মের কাছে। আর ঠিক তেমনি, নিজের মানুষদের নিয়ে ছিলেন ভীষণ আন্তরিক, যত্নশীল, ভালোবাসায় ভরপুর।
আজ তাঁর মৃত্যুদিবসে যখন আমরা তাঁকে স্মরণ করি, তখন এই একটি ছোট্ট ঘটনার মধ্য দিয়েই যেন ফিরে দেখা যায় হুমায়ূন আহমেদের পুরো জীবনদর্শন। যেখানে স্নেহ আছে, জেদ আছে, কষ্ট আছে, আর আছে এমন এক কান্না, যা শ্রাবণের মেঘের মতো নিঃশব্দে নামে, হৃদয়ের মাটি ভিজিয়ে রেখে যায় এক চিরকালীন অভিজ্ঞান।