প্রযুক্তির জাদুতে ফিরলেন মান্না

মৃত্যুর প্রায় দেড় যুগ পর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সহায়তায় ঢাকাই সিনেমার তারকা মান্নাকে পর্দায় ফেরানো হয়েছে।

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিভিত্তিক সিরিজ ‘ব্ল্যাকস্টোন’–এ খলনায়কের ভূমিকায় প্রয়াত অভিনেতা মান্নাকে হাজির করা হয়েছেছবি: ব্ল্যাকবক্স স্টুডিওর সৌজন্যে

মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে নামলেন তিনি। তাঁর মুখটা চেনা; অবিকল মান্না! মৃত্যুর দেড় যুগ পর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সহায়তায় পর্দায় ফিরলেন ঢাকাই সিনেমার তারকা মান্না।

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিভিত্তিক সিরিজ ‘ব্ল্যাকস্টোন’–এ খলনায়কের ভূমিকায় হাজির করা হয়েছে মান্নাকে। এআইয়ের মাধ্যমে হলিউডি সিনেমায় প্রয়াত তারকাদের হরহামেশা দেখা যায়। তবে ঢাকাই সিনেমা, সিরিজে প্রয়াত তারকাকে ফেরানোর নজির নেই।

চিত্রনায়ক মান্না
ছবি: ফেসবুক

বলা হচ্ছে, এবারই প্রথমবারের মতো ঢালিউডের কোনো প্রয়াত তারকাকে পর্দায় ফেরানো হয়েছে। মান্নাকে উৎসর্গ করে সিরিজটি নির্মাণ করেছেন তরুণ নির্মাতা শাহরিয়ার গালিব।

গতকাল সোমবার রাতে ব্ল্যাকবক্স স্টুডিওর ইউটিউব চ্যানেলে সিরিজের প্রথম পর্ব মুক্তি পেয়েছে। ২২ মিনিটের এই পর্বের শেষভাগে ১০ সেকেন্ডের মতো মান্নার দেখা মিলেছে। এতে গ্রেগঅন নামের এক খলচরিত্রে রয়েছেন তিনি; যিনি এক রহস্যময় পাথরখণ্ডের খোঁজে মহাবিশ্ব থেকে পৃথিবীতে নেমেছেন।

নির্মাতা শাহরিয়ার গালিব গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এআই ব্যবহার করে হলিউড সিনেমায় প্রয়াত শিল্পীদের ফিরিয়ে আনতে দেখি। হলিউডের সিনেমা দেখেই আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। দেশে এটা তেমন দেখিনি।’

সিরিজের গল্পে দেখা যাবে, মহাকাশ থেকে পড়া এক রহস্যময় পাথরখণ্ডের স্পর্শে এক তরুণের জীবন বদলে যায়। সেই পাথরখণ্ডের খোঁজে পৃথিবীতে মান্নার চরিত্রের (গ্রেগঅন) আগমন।

দ্বিতীয় পর্ব মে মাসে আসবে। সিরিজটি প্রযোজনা করেছেন রবিউল করিম। এতে অভিনয় করেছেন মোহাম্মদ রাফি, ইয়াসিন আরাফাত, ভৌমিক সরকার ও শাহরিয়ার কবির। দৃশ্যধারণ হয়েছে চট্টগ্রামে।

এআই ব্যবহার করে হলিউড সিনেমায় প্রয়াত শিল্পীদের ফিরিয়ে আনতে দেখি। হলিউডের সিনেমা দেখেই আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি।
নির্মাতা শাহরিয়ার গালিব
সিরিজের পোস্টার
ছবি: ব্ল্যাকবক্স স্টুডিওর সৌজন্যে
এআই কী
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হলো এমন একটি প্রযুক্তি, যা তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে যন্ত্র বা অ্যাপ্লিকেশনকে মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির আদলে কাজের উপযোগী করে তোলে। এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেকোনো মানুষের মুখাবয়ব, কণ্ঠস্বর প্রায় হুবহু অনুকরণ করা যায়।
সিরিজে গ্রেগঅন নামে এক খলনায়কের চরিত্রে পাওয়া যাবে মান্নাকে
ছবি: ব্ল্যাকবক্স স্টুডিওর সৌজন্যে

যেভাবে পর্দায় ফেরানো হলো মান্নাকে

আরেক প্রয়াত তারকা সালমান শাহও পরিচালকের ভাবনায় ছিলেন, তবে শেষ পর্যন্ত মান্নাকেই বাছলেন তিনি। পরিচালক শাহরিয়ার গালিবের ভাষ্যে, সিরিজটি অ্যাকশনধর্মী হওয়ায় মান্নাকে উপযোগী মনে হয়েছে তাঁর।

মান্নাকে কীভাবে পর্দায় ফেরানো গেল?–এমন প্রশ্নের জবাবে পরিচালক বললেন, ‘মান্নার মতো দেখতে একজন শিল্পীকে নির্বাচন করি, তাঁর চুলের স্টাইলও মান্নার মতো। তাঁকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছি। এরপর সেই ফুটেজে এআই সফটওয়্যারের মাধ্যমে মান্নার মুখায়ব বসানো হয়েছে।’

এতে সময় লেগেছে দুই দিন। এআই প্রযুক্তি খুব ব্যয়বহুল। মান্নার ১০ সেকেন্ডের ক্লিপটি তৈরিতে শুটিং, সম্পাদনাসহ প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

মান্নার পরিবারের অনুমতি না নেওয়ায় ১০ সেকেন্ডের বেশি মান্নাকে পর্দায় রাখতে পারেননি বলে জানান পরিচালক। গালিবের ভাষ্যে, ‘কোনো প্রয়াত তারকাকে উৎসর্গ করে ১০ সেকেন্ডের মতো দৈর্ঘ্যের ক্লিপ রাখা যায়। আমরা এই ক্লিপ থেকে কোনো আয় করছি না।’

মান্নার মতো দেখতে একজন শিল্পীকে নির্বাচন করি, তাঁর চুলের স্টাইলও মান্নার মতো। তাঁকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছি। এরপর সেই ফুটেজে এআই সফটওয়্যারের মাধ্যমে মান্নার মুখায়ব বসানো হয়েছে।
নির্মাতা শাহরিয়ার গালিব
শুটিংয়ের দৃশ্য
ছবি: ব্ল্যাকবক্স স্টুডিওর সৌজন্যে

মান্নার স্ত্রী শেলি মান্না গতকাল প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের সঙ্গে সিরিজটি নিয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল, সিরিজটি দেখার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।

সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব এই বছরও মুক্তির কথা রয়েছে। পরিবারের অনুমতি পেলে আগামী পর্বে আরও বেশি সময় ধরে মান্নার দেখা মিলতে পারে।

ক্যারিয়ারে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থায় ৪৩ বছর বয়সে ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন মান্না।

ক্যারিয়ারে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থায় ৪৩ বছর বয়সে ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন মান্না।

পথ দেখিয়েছে হলিউড

কয়েক দশক আগে থেকেই হলিউডে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু হয়েছে। এআই ব্যবহার করে সিনেমা নির্মাণ, চিত্রনাট্য লেখা, অভিনয়, কণ্ঠাভিনয় থেকে চলচ্চিত্রের প্রায় সব কাজই করা যায়।

এই সময়ে এআইয়ের ব্যবহার আরও বেড়েছে। এআইকে কাজে লাগিয়ে প্রয়াত অভিনয়শিল্পীদের পর্দায় ফেরানো আরও সহজ হয়ে গেছে। প্রয়াত শিল্পীদের অভিব্যক্তি, হাঁটাচলা নিখুঁতভাবে পর্দায় তুলে আনা যায়।

মৃত্যর প্রায় সাত দশক পর হলিউডের অভিনেতা জেমস ডিনকে পর্দায় হাজিরের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ‘স্টার ওয়ারস’ সিরিজের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ক্যারি ফিশারের মৃত্যুর পর তাঁর পুরোনো ফুটেজের সঙ্গে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার করে তাঁকে সিরিজে হাজির করা হয়েছে।

ডিপফেক প্রযুক্তির কারিকুরিতে ‘ইন্ডিয়ানা জোনস’ সিনেমায় ৮০ বছর বয়সী হ্যারিসন ফোর্ডের বয়সও কমিয়ে ফেলা হয়েছিল।

টালিগঞ্জে ‘অতি উত্তম’ সিনেমায় স্বয়ং উত্তম কুমারকে হাজির করেছেন নির্মাতা সৃজিত মুখার্জি।
‘অতি উত্তম’ সিনেমায় উত্তম কুমার
ছবি: ফেসবুক থেকে

হলিউডের দেখানো পথে এআইয়ের মাধ্যমে ‘মহারাজা ডেনিমস’ নামে একটি সিনেমা নির্মিত হয়েছে। এআইয়ের মাধ্যমে ভারতীয় এক সিনেমায় প্রয়াত দুই শিল্পী বাম্বা বাক্য ও শাহুল হামিদের কণ্ঠে গান করেছে সুরকার এ আর রাহমান।

টালিগঞ্জে ‘অতি উত্তম’ সিনেমায় স্বয়ং উত্তম কুমারকে হাজির করেছেন নির্মাতা সৃজিত মুখার্জি।

এআই কতটা সম্ভাবনার?

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র ও টিভি নাটকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার খুব একটা ব্যবহার দেখা না গেলেও বিজ্ঞাপনচিত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের দেখা যায়। নির্মাতা পিপলু খান ইতিমধ্যে বিজ্ঞাপনচিত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু করেছেন।

বিশেষ করে স্বাধীন নির্মাতাদের জন্য এইআই সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তাঁর ভাষ্যে, ‘স্বাধীন নির্মাতাদের জন্য প্রযুক্তি কতটা  উপকার করছে, এটা কেউ বলছে না। মান্নাকে নিয়ে যে ছেলেটা সিরিজ বানাচ্ছে, ওই ছেলেটা স্বাধীন নির্মাতা। আমি এটাকে উৎসাহিত করি।’

স্বাধীন নির্মাতাদের জন্য প্রযুক্তি কতটা  উপকার করছে, এটা কেউ বলছে না। মান্নাকে নিয়ে যে ছেলেটা সিরিজ বানাচ্ছে, ওই ছেলেটা স্বাধীন নির্মাতা। আমি এটাকে উৎসাহিত করি।
পিপলু খান

শাহরিয়ার গালিবও এআইকে সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন। তাঁর ভাষ্যে, নতুন নির্মাতারা এআইয়ে কাজের ব্যাপারে বেশ আগ্রহী ও আশাবাদী। আগামীর নির্মাতারা আরও বেশি এআইয়ে কাজ করবেন।

চলচ্চিত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিয়ে সম্ভাবনার পাশাপাশি উদ্বেগও আছে। অভিনয়শিল্পীদের বিকল্প হিসেবে এআইয়ের ব্যবহার নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচিত হয়েছে। হলিউডের শিল্পী, লেখকেরা আন্দোলনও করেছে।

পিপলু খান বলছেন, ‘নতুন সম্ভাবনা পুরোনোকে চ্যালেঞ্জ করে। নিজের ভিত্তির সংকট একটা বাস্তবতা। এটাকে ভয় পেয়ে লাভ নেই। প্রযুক্তি সময়কে শাসন করে। আমাদের সংকট তৈরি হবে, সংকট থেকে উত্তরণও ঘটবে। একটা জব যাবে, হয়তো তিনটা জব তৈরি হবে।’

আরও পড়ুন