‘বরবাদ’ থেকে ‘উৎসব’, বছরের আলোচিত ১০ সিনেমা কোনগুলো

২০২৫ সালে বাংলা সিনেমা মুক্তি পেয়েছে ৪৬টি। এর মধ্যে দুই ঈদের মুক্তি পাওয়াগুলোই যা একটু বাণিজ্যিক সফলতা পেয়েছে। অন্য সময়ে মুক্তি পাওয়া কয়েকটি সিনেমা প্রশংসিত হলেও বাণিজ্যের বিচারে ২০২৫ সাল ছিল ঢাকাই সিনেমার জন্য আরও একটি মন্দা বছর। বাণিজ্যিক সাফল্য, শিল্পমান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দর্শকের আগ্রহ বিবেচনায় জেনে নেওয়া যাক চলতি বছরের আলোচিত ১০ সিনেমার কথা। এই তালিকা কোনো র‍্যাঙ্কিং নয়, ছবির ক্রম করা হয়েছে মুক্তির তারিখ অনুযায়ী।

২০২৫ সালে আলোচিত ১০ সিনেমা কোনগুলো। কোলাজ

‘বলী: দ্য রেসলার’
একজন তরুণ, তিনবারের চ্যাম্পিয়ন বলী খেলোয়াড়কে চ্যালেঞ্জ করেছেন একজন বয়স্ক লোক—এটাই গল্প। কিন্তু ‘বলী’ আসলে স্রেফ এই শক্তি আর কৌশলের খেলার চেয়ে বেশি কিছু। প্রথম সিনেমাটি বানানোর সময় নির্মাতা ইকবাল হোসাইন চৌধুরীকে সবচেয়ে বেশি তাড়িত করেছে সমুদ্র ও তাঁর শিকড়ের যোগসূত্র। চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমুদ্রঘেঁষা মানুষের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে থাকা বলীখেলাকে কেন্দ্র করে এগিয়েছে সিনেমার গল্প।

‘বলী’ সিনেমার দৃশ্য
ছবি : পরিচালকের সৌজন্যে

২৮তম বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের নিউ কারেন্টস বিভাগে পুরস্কার জেতে সিনেমাটি। ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন নাসির উদ্দিন খান। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন প্রিয়াম অর্চি, ইতমাম, এনজেল নূর। সিনেমাটিকে মনে রাখতে হবে এর গল্প বলার ধরনের জন্য। বুসানে পুরস্কার জেতার পর নিউ কারেন্টস বিভাগের জুরিরা বলেছিলেন, ছবিটি যেন দুর্দান্ত এক সিঙ্গেল রাউন্ড ম্যাচ, যেখানে জাদুকরিভাবে গল্প বলা হয়েছে।

হাইলাইটস
১. তালিকার পাঁচটি সিনেমাই নির্মাতার প্রথম সিনেমা।
২. ১০ সিনেমার মধ্যে ৩টিই নারীপ্রধান সিনেমা।
৩. ‘বরবাদ’-এর মতো অ্যাকশন, ‘এশা মার্ডার’-এর মতো থ্রিলার, ‘দাগি’র মতো ড্রামা, ‘সাবা’র মতো নারীপ্রধান সিনেমা যেমন আছে, তেমনই আছে ‘দেলুপি’র মতো আঞ্চলিক গল্পের সিনেমাও।

‘বরবাদ’
নির্মাণে দক্ষিণ ভারতীয় ও হিন্দি সিনেমার প্রভাব স্পষ্ট। তবু শাকিব খানের উপস্থিতি আর গল্পে আবেগ ছুঁয়ে যাওয়ায় দর্শককে আকৃষ্ট করে মেহেদি হাসানের প্রথম সিনেমাটি। সিনেমাটির অন্যতম দিক ছিল সহিংস অ্যাকশন, যেখানে পাওয়া গেছে নতুন এক শাকিবকে। লুক থেকে অ্যাকশন—এ সিনেমায় দর্শককে চমকে দিয়েছেন তিনি। উন্মাদ প্রেম, সহিংসতা আর প্রতিশোধের গল্প।

অ্যাকশন দৃশ্যে শাকিবের সহিংসতা দেখে গায়ে যেমন কাঁটা দেয়, তেমনি তাঁর পাগল করা ভালোবাসা চমকাতে বাধ্য করেছিল। সিনেমার প্রথম দিকে শাকিব খান শুধু তাঁর এক্সপ্রেশন আর লুক দিয়েই টেনে নিয়ে গেছেন গল্পটা। আর গল্পের পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পর্দায় হয়ে উঠেছেন আরও বেপরোয়া, খ্যাপাটে।

‘বরবাদ’ ছবির দৃশ্যে শাকিব খান ও ইধিকা পাল
ছবি : প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সৌজন্যে

ছবিতে নায়িকা চরিত্রে ইধিকা পালও ভালো অভিনয় করেছেন। সঙ্গে ইন্তেখাব দিনার, যীশু সেনগুপ্ত, মিশা সওদাগর, স্যাম ভট্টাচার্যের মতো পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতার জন্য ছবিটি হয়েছে উঠেছে উপভোগ্য। চলতি বছর বাণিজ্যিকভাবে সফল সিনেমার একটি এটি।

‘জংলি’
শিশুসন্তানের সঙ্গে মা-বাবার সম্পর্ক নিয়ে ঢাকাই সিনেমায় সাম্প্রতিক সময়ে খুব একটা কাজ হয়নি। হলে মা-বাবার সঙ্গে সিনেমা দেখতে আসা সন্তানদের কথা বেশির ভাগ নির্মাতাই ভাবেননি। এ চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন এম রহিম। সিনেমায় অভিনেতা হিসেবে নিজেকে নতুন করে চিনিয়েছেন সিয়াম আহমেদ, তাঁর মেয়ের চরিত্রে নৈঋতা হাসিন রৌদ্রময়ীও চমকে দিয়েছেন।

‘জংলি’ সিনেমার পোস্টার থেকে
ছবি : ফেসবুক থেকে নেওয়া

সিনেমার গল্প খারাপ ছিল না; কিন্তু চিত্রনাট্যের খামতি আর পরিচালনার দুর্বলতার জন্য সেটা পর্দায় পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। তারপরও পর্দায় ব্যাড প্যারেন্টিং, শিশুদের জন্য গুড টাচ, ব্যাড ট্যাচের মতো বিষয়গুলো দেখানোর জন্য ‘জংলি’ টিমের বিশেষ ধন্যবাদ পাওনা। মুক্তির পর পারিবারিক দর্শকদের ব্যাপক আগ্রহ ছিল সিনেমাটি নিয়ে।

আরও পড়ুন

‘দাগি’
মফস্‌সল শহরের চেনা সব চরিত্র, জমাটি চিত্রনাট্য, দুর্দান্ত নির্মাণ, মনে রাখার মতো সংলাপ আর বিশ্বাস্য অভিনয় মিলিয়ে ‘দাগি’ বছরের অন্যতম সেরা বাংলা সিনেমা। আফরান নিশো ও শিহাব শাহীনের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা কাজ বললেও বাড়াবাড়ি হবে না।

‘দাগি’ সিনেমায় আফরান নিশো। প্রযোজনা সংস্থার সৌজন্যে।

নিখাদ দেশি গল্প, দেশীয় আমেজে নির্মিত ড্রামা ঘরানার ঢাকাই সিনেমা ইদানীং খুব একটা দেখা যায় না। বড় শহরের স্কাইলাইন থেকে বেরিয়ে মফস্‌সলের পটভূমিতে বিশ্বাসযোগ্য গল্পও তেমন হয় না। তাই এ সিনেমার জন্য নির্মাতার বড় ধন্যবাদ পাওনা। একজন দাগি আসামির জেল–পরবর্তী জীবন দেখাতে চেয়েছেন তিনি, পেরেছেনও। পারিবারিক যৌন হয়রানি, জেন-জি, জেন–আলফার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরতা, সীমান্তবর্তী জেলা শহরে বেকার তরুণদের চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ার টোপও তুলে এনেছেন নির্মাতা। কিছু দুর্বলতা থাকলেও নিশোর সঙ্গে তমা মির্জা, সুনেরাহ্‌ বিনতে কামাল, শহীদুজ্জামান সেলিম আর রাশেদ মামুন অপুর অভিনয় মনে দাগ কাটে।

‘তাণ্ডব’
শাকিব খান সিনেমার নায়ক। তবে এটা শাকিবের একার সিনেমা নয়; বরং মূল নায়ক গল্প। ঢাকাই ছবির সবচেয়ে বড় তারকা, সঙ্গে একঝাঁক দক্ষ অভিনয়শিল্পীকে সঙ্গে নিয়ে বাণিজ্যিক সিনেমার মোড়কে শক্তিশালী রাজনৈতিক বার্তা দিতে চেয়েছেন নির্মাতা রায়হান রাফী।

‘তাণ্ডব’–এ শাকিব খান। চরকির সৌজন্যে

এ ছবিতে নির্মাতা রাষ্ট্রীয় মদদে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম নিয়ে কড়া বার্তা দিতে চেয়েছেন। সেটা তিনি দিতে পেরেছেন স্বাধীনের গল্প বলেই, এ জন্য আলাদা করে লেকচার দিতে হয়নি। পুরো সিনেমায় উঠে এসেছে সাদাপোশাকে সাধারণ মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়া, আটক না দেখিয়েই রাষ্ট্রীয় বাহিনীর খুন, দুর্নীতিসহ নানা প্রসঙ্গ। চলতি বছর মুক্তি পাওয়া রাজনৈতিক কনটেন্টগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে পরিণত নির্মাণ। শাকিবের সঙ্গে পর্দায় সাবিলা নূর, জয়া আহসান, আফজাল হোসেন, শহীদুজ্জামান সেলিম, গাজী রাকায়াতের মতো অভিনয়শিল্পীদের উপস্থিতি যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা।

আরও পড়ুন

‘উৎসব’
পুরোনো পাড়ার চেনা প্রতিবেশী, চাচাতো-মামাতো ভাইবোনদের খুনসুটি, মফস্‌সল মফস্‌সল গন্ধ, হারিয়ে যাওয়া ট্রেনের সঙ্গে জীবনের বাঁকবদল—সব মিলিয়ে ‘উৎসব’ যেন ফেলে আসা সময়ের গল্প। একটা ভুল, আক্ষেপ আর প্রায়শ্চিত্তের জার্নি। চলতি বছর মুক্তি পাওয়া তানিম নূরের সিনেমাটি যেন নির্মাতা তানিম নূরের ফোনকল, ‘হ্যালো, নাইনটিজ।’

‘উৎসব’ সিনেমার পোস্টার। চরকির সৌজন্যে

চার্লস ডিকেন্সের ‘আ ক্রিসমাস ক্যারল’ অবলম্বনে নির্মিত হলেও ঢাকার মোহাম্মদপুরের পটভূমিতে নির্মিত সিনেমাটির সব অর্থেই ‘দেশি’। থ্রিলার, অ্যাকশন আর সহিংসতার বাইরে পারিবারিক আবেগ নিয়ে ঈদের সিনেমা বানানোর জন্য আলাদা ধন্যবাদ পাবেন তানিম নূর। সিনেমার সবচেয়ে বড় শক্তি সারল্য। সব চরিত্রকেই মনে হয় পাশের বাড়ির খুব চেনা কেউ।

প্রধান চরিত্রে জাহিদ হাসান, সঙ্গে তারিক আনাম খান, আফসানা মিমি, জয়া আহসান, অপি করিম, চঞ্চল চৌধুরী, ইন্তেখাব দিনার, সুনেরাহ্‌ বিনতে কামাল, সৌম্য জ্যোতি, সাদিয়া আয়মানের অভিনয় মিলিয়ে চলতি বছরের অন্যতম আলোচিত সিনেমা এটি। সমালোচকদের প্রশংসা যেমন পেয়েছে, তেমনই ব্যবসাও করেছে। ঢাকাই সিনেমার ক্ষেত্রে চলতি বছর এ সমীকরণ কম সিনেমাই মেলাতে পেরেছে।

‘এশা মার্ডার: কর্মফল’
খুনের ঘটনার তদন্ত নিয়ে সিনেমা নতুন নয়। তবে এ সিনেমায় গল্প যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, নিঃসন্দেহে তা ঢাকাই সিনেমায় মার্ডার-মিস্ট্রি ঘরানার উদাহরণ হয়ে থাকবে। সিনেমায় বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাশব্যাকে কয়েকটি টুকরা টুকরা গল্প দেখানো হয়েছে। এ গল্পগুলো থেকে ভিন্ন ভিন্ন দুটি অতীতের ইঙ্গিত পান দর্শক। কিন্তু রহস্যের এ জট খুলতে অপেক্ষা করে থাকতে হয় শেষ দৃশ্য পর্যন্ত। সিনেমাটি দিয়ে বড় পর্দায় দারুণভাবে ফিরেছেন আজমেরী হক বাঁধন।

‘এশা মার্ডার: কর্মফল’–এর পোস্টার থেকে। ফেসবুক থেেক

ছবিতে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা লিনার নন–গ্ল্যামারাস চরিত্রটি বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। তাড়া করে বেড়ানো অতীত, কর্মক্ষেত্রে একের পর এক প্রতিকূলতা, বসের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, বিশ্বাসভঙ্গ এবং শেষ দিকে হ্যান্ড টু হ্যান্ড অ্যাকশন—সবটাই তিনি ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বাংলা সিনেমায় নায়ক পুলিশ মানেই সে সব পারে; কিন্তু এ সিনেমায় লিনার অসহায়ত্ব মাঝেমধ্যেই ফুটে ওঠে।

ঘটনার ভয়াবহতা দেখে তাঁর বমি পায়, অতীত ট্রমা আর জটিল রহস্যের চক্করে পড়ে মাঝেমধ্যেই তিনি ভেঙে পড়েন। এমন জটিল চরিত্রে উতরে গেছেন বাঁধন। সানী সানোয়ারের ছবিতে আরও ছিলেন পূজা ক্রুজ, নিবিড় আদনান, শরীফ সিরাজ, শতাব্দী ওয়াদুদ, ফারুক আহমেদ, সুষমা সরকার, হাসনাত রিপন। খল চরিত্রে সৈয়দ এজাজ আহমেদের অভিনয় বছরের অন্যতম বড় চমক।

‘বাড়ির নাম শাহানা’ সিনেমায় দীপা চরিত্রে অভিনয় করেছেন আনান সিদ্দিকা
ছবি : প্রযোজনা সংস্থার সৌজন্যে

‘বাড়ির নাম শাহানা’
দেশে নারীদের গল্প নিয়ে সিনেমা হয় কম। আর নারী নির্মাতার বানানো নারীর গল্প তো বিরল ঘটনা। নিজের আর আশপাশের মানুষের জীবনের সত্য ঘটনা অবলম্বনে এবার সেই গল্পই পর্দায় তুলে এনেছেন লীসা গাজী। সিনেমার প্রধান অভিনেত্রী আনান সিদ্দিকার সঙ্গে যৌথভাবে চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন নির্মাতা। সিনেমার মূল সুর নারীর লড়াই। পাশাপাশি উঠে এসেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, ধর্মান্ধতার মতো বিষয়।

কিন্তু এগুলোর কিছুই লেকচারের মতো শোনায়নি, নারীবাদের ক্লাসও নেননি নির্মাতা; বরং ডাকাবুকো চরিত্র দীপার (আনান সিদ্দিকা) মাধ্যমে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

মোটাদাগে বিষয়বস্তু শুনে যতটা গুরুগম্ভীর মনে হয়, ‘বাড়ির নাম শাহানা’ মোটেও তেমন বিষণ্ন কোনো সিনেমা না; বরং উদ্‌যাপনের গল্প। নন-লিনিয়ার (অ-সরলরৈখিক) ভঙ্গিতে গল্প বলেছেন লীসা গাজী।

গল্প শুরু হয় বিয়ে দিয়ে, পরে বর্তমানে ফিরে আসে। মাঝখানে আবার দেখানো হয় লন্ডনের ছোট্ট এক উপশহরে দীপার প্রবাস সংসার। ছোট–বড় নানা ঘটনা আর চরিত্র দিয়ে দীপার পুরো যাত্রাটা দেখিয়েছেন নির্মাতা। ছোটখাটো দু-একটা অসংগতি থাকলেও ‘বাড়ির নাম শাহানা’ দেশের সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। একান্তই এক নারীর দৃষ্টিতে তার চরিত্র, সংগ্রাম, মানসিকতার এমন রূপায়ণ খুব কম সিনেমাতেই দেখা যায়। ছবিটি বাংলাদেশ থেকে অস্কার মনোনয়নও পেয়েছিল। পরে অবশ্য একাডেমির সংক্ষিপ্ত তালিকায় জায়গা পায়নি।

‘সাবা’ সিনেমায় মেহজাবীন চৌধুরী। ছবি: নির্মাতার সৌজন্যে

সাবা
এই শহরের সব মানুষেরই একটা গল্প থাকে। তবে সেই গল্পগুলো বাস্তবসম্মতভাবে খুব কমই পর্দায় উঠে আসে। দর্শক নিজেকে একাত্ম করতে পারেন—এমন গল্পের সিনেমা হাতে গোনা। এ ধারায় ব্যতিক্রম ‘সাবা’। মা আর মেয়ের গল্প নিয়ে সিনেমা; তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া, ঘটতে থাকা টুকরা টুকরা সময়ের গল্প। মায়ের অসুস্থতা আর পারিপার্শ্বিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে একা এক তরুণীর সংগ্রামের গল্প হলেও ‘সাবা’ দমবন্ধ বিষণ্নতার ছবি নয়।

মা ও মেয়ের খুনসুটি দেখতে গিয়ে দর্শক হেসে উঠেছেন বারবার। ছোট ছোট প্রতিটি কাজ থেকেও কীভাবে আনন্দ খুঁজে নিতে হয়, নির্মাতা যেন সেটাই দেখাতে চেয়েছেন।

রাজনৈতিক সিনেমা নয়, তবে পরোক্ষভাবে ঠিকই নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন নির্মাতা। সংবাদ পাঠিকার ভয়েসওভারে ফাঁপা উন্নয়ন, দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য, আর্থিক অনিশ্চয়তায় তরুণদের বিদেশে পাড়ি দেওয়ার প্রবণতা, কোভিড-পরবর্তী বেকারত্ব যেমন এসেছে, তেমনি দেখা গেছে বাড়িতে বাড়িতে পানির সংকট। এসেছে চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতা।

প্রধান দুই চরিত্রে মেহজাবীন চৌধুরী আর রোকেয়া প্রাচীর দুর্দান্ত অভিনয়; বরকত হোসেনের হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরার জাদু মিলিয়ে প্রথম সিনেমাতেই নিজের ছাপ রেখেছেন নির্মাতা মাকসুদ হোসাইন।

‘দেলুপি’
যাত্রাপালার মহড়া চলছিল গ্রামের একটি বাড়িতে। মথুরার মহারাজা উগ্রসেনের রাজ্যে মহা দুর্বিপাক। তাঁর ছেলে যুবরাজ কংসের অত্যাচারে দেশবাসী বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে যাত্রাপালার এক অভিনেতার মুঠোফোন বেজে ওঠে। খবর আসে প্রধানমন্ত্রী ‘সাবিনা’ পালিয়ে গেছেন। খুলনার দেলুটি ইউনিয়নের পটভূতিতে নির্মিত এমন গল্পের সিনেমা দিয়ে আসলে পুরো বাংলাদেশকেই ধরেছেন নির্মাতা মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম।

‘দেলুপি’র দৃশ্য
ছবি: প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সৌজন্যে

তাঁর নির্মাণশৈলীর মূল শক্তি—পরিমিতি, স্থিরতা ও কঠিন বাস্তবতার নীরব বয়ান। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো বিস্তৃত বিষয় তিনি তুলে ধরেছেন বিন্দুমাত্র অতিনাটকীয়তা ছাড়া। সংযত ক্যামেরা, বাস্তবিক সংলাপ আর নীরবতার ভেতর লুকিয়ে থাকা টান টান উত্তেজনা—সব মিলিয়ে গল্পে তৈরি হয়েছে ঘন বাস্তবতা। ৫ আগস্ট-পরবর্তী দেশের ঘটনাপ্রবাহ এখানে যেন ছোট এক প্রতিচ্ছবি—ক্ষমতার বদল, বন্যা, দখলদারি, শ্রেণিসংঘাত থেকে প্রেম ও সন্দেহ—সবই একই ফ্রেমে সমান্তরালে প্রবাহিত।

তাওকীর বরাবরই স্থানীয় পটভূমিতে অপেশাদার অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করতে অভ্যস্ত। আলোচিত দুই সিরিজ ‘শাটিকাপ’ আর ‘সিনপাট’-এর পর নিজের প্রথম সিনেমাতেও সেটা সফলভাবে করতে পেয়েছেন তিনি। চিরনজিৎ বিশ্বাস, অদিতি রায়, রুদ্র রায়, মো. জাকির হোসেনের অভিনয়ে ‘দেলুপি’ তাই হয়েছে দেশি গন্ধমাখা, চলতি বছরের অন্যতম সেরা সিনেমা।