নাটকীয়ভাবে পুরস্কার পেল ‘বালুর নগরীতে’

পুরস্কার গ্রহনের পরে মোস্তফা মন্‌ওয়ার ও সহ– প্রযোজক মাহজাবীন খানের সঙ্গে পরিচালক মেহেদী হাসান। ছবি: উৎসবের অফিশিয়াল সাইট থেকে

মেহেদী হাসানদের একটা বিড়াল ছিল। সেই বিড়ালের লিটার বক্সের জন্য বালু সংগ্রহ করতে যেতেন তাঁর স্ত্রী মাহজাবীন খান। মোটরসাইকেলে করে বালু সংগ্রহের সময় নারী হওয়ার কারণে রাস্তায় তাঁকে বুলিংয়ের শিকার হতে হতো। প্রায়ই অদ্ভুত সব ঘটনার মুখোমুখি হতেন মাহজাবীন। স্ত্রীর কাছ থেকে সেই ঘটনাগুলো শুনে একটা চিত্রনাট্য লেখার পরিকল্পনা করেন মেহেদী। এসবই ২০১৬ সালের ঘটনা। আট বছর ধরে লেগে থাকা সেই সিনেমাই ‘বালুর নগরী’তে। কার্লোভি ভেরি চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়েছে। সে উৎসবেরই প্রক্সিমা প্রতিযোগিতা শাখায় ছবিটি জিতে নিয়েছে ‘গ্র্যান্ড প্রিক্স’ পুরস্কার। পুরস্কারের অর্থমূল্য ১৫ হাজার ডলার। ১২ জুলাই উৎসবের সমাপনী দিনে ঘোষণা করা হয় এ পুরস্কার।

পুরস্কার কারা পাচ্ছেন, তার কিছুটা আঁচ অনেক সময় আগেভাগেই দিয়ে থাকেন আয়োজকেরা। সিনেমাটি কোনো পুরস্কার পাচ্ছে কি না, এতে বোঝা যায়। কিন্তু মেহেদীদের সিনেমাটি নিয়ে উৎসবের শেষ দিনেও তেমন কোনো কথা আয়োজকেরা বলছিলেন না। এতে মেহেদী হাসান ও তাঁর দল ধরেই নেয়, কোনো পুরস্কার তারা পাচ্ছে না। সিনেমার প্রধান অভিনেত্রী ভিক্টোরিয়া চাকমাও তাই ঢাকায় চলে আসেন।

সিনেমার পোস্টার

পরিচালক মেহেদী হাসান, তাঁর স্ত্রী প্রযোজক মাহজাবীন খান ও অভিনেতা মোস্তফা মন্ওয়ারও সমাপনীর আগেই উৎসব থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান প্রাগে। উৎসবস্থল থেকে দেড় ঘণ্টার পথ। সেখানে ঘোরাঘুরি শেষে স্ত্রীকে নিয়ে স্কটল্যান্ডে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন পরিচালক, মন্ওয়ারও চেক প্রজাতন্ত্র ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় হঠাৎ আয়োজকদের ফোন। দ্রুত তাঁদের উৎসবে চলে আসতে বলা হলো। হাতে তেমন সময় নেই। আয়োজকেরা তাঁদের লোকেশনে গাড়ি পাঠিয়ে দেন। তখন তাঁরা নিশ্চিত হয়ে যান, কোনো একটি পুরস্কার পাচ্ছেন। কিন্তু তাই বলে ‘গ্র্যান্ড প্রিক্স’ পাবেন, এটা ভাবেননি মেহেদীরা।

পুরস্কার গ্রহণের সময় চেক কেতায় নেচে শুভকামনা জানানো হয় এই পরিচালককে। পুরস্কার হাতে মেহেদী বলেন, ‘এটা আমার জন্য অনেক বড় একটি প্রাপ্তি। আয়োজকসহ এর সঙ্গে যুক্ত সবাইকে ধন্যবাদ। এত সুন্দর একটি আয়োজনে আমাদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ধন্যবাদ। বিশেষ করে স্মরণ করছি উৎসবের প্রয়াত সভাপতি জিরি বারতোস্কার কথা, তাঁর জন্য ভালোবাসা ও সম্মান। আমার টিমের সদস্যদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।’

মোস্তফা মন্ওয়ার মেসেঞ্জারে প্রাগ থেকে জানান, ‘সিনেমাটির পেছনে অনেক বড় একটা সময় আমাদের দিতে হয়েছে। এই অর্জনে আমাদের পরিশ্রম সার্থক মনে হচ্ছে।’ কোন ঘটনাগুলোর কথা মনে পড়ছে—জানতে চাইলে এই অভিনেতা বলেন, ‘শুটিংয়ের আগে ছয় মাস আমরা সিনেমাটি নিয়ে কাটিয়েছি। বাসায়, লোকেশনে গিয়ে নিয়মিত আড্ডা দিয়েছি। কখনো রিহার্সাল করতাম। সিনেমাটির গল্প মাথায় নিয়ে ঘুরতাম।’

পরিচালক মেহেদী হাসান। ছবি: ফেসবুক থেকে

সিনেমায় হাসান চরিত্রে মন্ওয়ারকে দেখা যাবে। তিনি বালুর প্ল্যান্টে কাজ করেন। সেখান থেকে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস চুরি করে বাড়িতেই কাচ তৈরির চেষ্টা করতে থাকেন হাসান। তাঁর স্বপ্ন, একদিন তিনি কাচের ফ্যাক্টরির মালিক হবেন, যা শেষ পর্যন্ত তাঁকে ধ্বংসাত্মক, উদ্ভট পরিকল্পনার দিকে নিয়ে যায়।

সিনেমায় মূল চরিত্র এমার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ভিক্টোরিয়া চাকমা। তাঁকে ঘিরেই গল্প। বিড়ালের লিটার বক্সের জন্য শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে স্কুটারে বালু সংগ্রহ করেন এমা। ‎ বালু সংগ্রহ করতে গিয়ে একদিন একটি আঙুল খুঁজে পান এমা। রহস্যজনকভাবে সামনে আসেন হাসান। দুটি চরিত্র নিয়েই এগিয়ে যায় গল্প। সিনেমাটি দিয়ে প্রথমবারের মতো অভিনয়ের নাম লেখালেন ভিক্টোরিয়া। অভিনয় না জানাকেই কাজে লাগিয়েছেন পরিচালক। চরিত্রটিকে ঠিকঠাক ফুটিয়ে তুলতে ভিক্টোরিয়াকে তিন-চার মাস রিহার্সাল করতে হয়েছে।

‘বালুর নগরীতে’ সিনেমাটি প্রক্সিমা প্রতিযোগিতা শাখায় ‘গ্র্যান্ড প্রিক্স’ পুরস্কার পেয়েছে। ছবি: উৎসবের অফিশিয়াল সাইট থেকে

সিনেমাটির প্রিমিয়ারে প্রশ্নোত্তর পর্বে ভিক্টোরিয়া বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মেয়ে। অভিনয়ের ব্যাপারে পরিবার থেকে তেমন সাপোর্ট ছিল না। শুধু মা চাইতেন অভিনয় করি। যে কারণে আজ সিনেমাটি নিয়ে এ উৎসবে আমি আসতে পেরেছি।’

বালু উত্তোলন, নদী ভরাট, জলবায়ু পরিবর্তনসহ সাম্প্রতিক সময়ের নানা চিত্র গল্পের মধ্যে পাওয়া যাবে। সিনেমাটির শুটিং হয়েছে ১৭ দিন। চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছেন ফ্রান্সের ম্যাথিউ গোম্বিনি। সিনেমার প্রযোজক রুবাইয়াত হোসেন নিজেও পরিচালক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৭ সালে সিনেমাটি নিয়ে আমাদের জার্নি শুরু। দীর্ঘদিন সিনেমাটি নিয়ে আমরা কাজ করেছি। এই প্রাপ্তি আমাদের কাছে অনেক বড় অর্জন হয়ে থাকবে।’ সিনেমার আরেক প্রযোজক আদনান আহমেদ।

চেক প্রজাতন্ত্রের ৫৯তম এ উৎসব ৪ জুলাই শুরু হয়ে শেষ হয় ১২ জুলাই। উৎসবের প্রধান অফিশিয়াল বিভাগ ক্রিস্টাল গ্লোব। এ শাখায় পুরস্কার পেয়েছে চেক প্রজাতন্ত্রের সিনেমা বেটার গো ম্যাড ইন দ্য ওয়াইল্ড। এটির পরিচালক মিরো রেমো। উৎসবের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ প্রক্সিমা কম্পিটিশন। এ বিভাগে সেরা হয়েছে বাংলাদেশের ‘বালুর নগরীতে।’

আরও পড়ুন