মানুষের জেদ, তাড়না ও প্রতিবাদের ভাষা দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন ফারুক

চিত্রনায়ক ফারুক
ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

অভিনয় দিয়ে তিনি কাঁদিয়েছেন দর্শকদের। কখনো আবার ভাসিয়েছেন আনন্দে। রাজনীতিবিদ হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছেন। পাঁচ দশকের অভিনয়জীবনে তাঁর শেষজীবনটা ছিল কষ্টের। তবে সেই কষ্ট বুঝতে দিতেন না কাউকে। হাসি-আনন্দে মেতে থাকতেন। জীবনের শেষ কয়েক বছর শারীরিক অসুস্থতা তাঁকে ভালোই কাবু করেছিল। চিকিৎসার ব্যয়ভার মেটাতে বিক্রি করেছিলেন জায়গা-সম্পত্তিও। চলচ্চিত্র বিশ্লেষকদের মতে, তিনি ছিলেন অসাধারণ একজন শিল্পী। তাঁর মতো অভিনয়শিল্পী বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া কঠিন। অভিনয়ের প্রতি তাঁর মনোযোগ, অধ্যবসায় সমসাময়িকদের চেয়ে ছিল একেবারেই আলাদা। তিনি বরেণ্য অভিনয়শিল্পী আকবর হোসেন পাঠান ফারুক। গত বছর এই দিনে তিনি মারা যান।

একের পর এক গ্রামীণ পটভূমির সিনেমায় অভিনয় করে দর্শকের ‘মিয়াভাই’ হয়ে উঠেছিলেন ফারুক। ১৯৭১ সালে এইচ আকবরের ‘জলছবি’ সিনেমা দিয়েই চলচ্চিত্রে তাঁর অভিষেক। অভিষেক হলেও ১৯৭৫ সালে এসে সবার নজরে আসেন ফারুক। খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘সুজন সখী’ সিনেমায় সুজন চরিত্রে অভিনয় করে পরিচিতি পান তিনি। এই সিনেমায় তাঁর বিপরীতে সখী চরিত্রে অভিনয় করেন কবরী। গ্রামীণ পটভূমির গল্পে নির্মিত এ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্রামীণ তরুণ সুজনের ভূমিকায় ফারুকের নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। পরের বছর ফারুককে নিয়ে আমজাদ হোসেন ‘নয়নমনি’ নির্মাণ করেন। এই সিনেমায় নয়ন নামে এক গ্রাম্য যুবকের চরিত্রে অভিনয় করেন, জায়গা করে নেন  দর্শকদের হৃদয়ে। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় শহীদুল্লা কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে আবদুল্লাহ আল মামুনের সিনেমা ‘সারেং বৌ’। সিনেমায় কদম সারেং চরিত্রে জীবনঘনিষ্ঠ অভিনয়ের জন্য ক্ল্যাসিক অভিনেতা হিসেবে গণ্য হন।

চিত্রনায়ক ফারুক
ছবি: ফেসবুক

চলচ্চিত্র অঙ্গনে নায়ক ফারুক কিংবা মিয়াভাই নামে পরিচিত হলেও তাঁর আসল নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু। ‘ফারুক’ নামটি মূলত ছিল চলচ্চিত্র অঙ্গনের। অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান, পরিচালক এইচ আকবর ও ফারুক নামে এক বন্ধু মিলে তাঁকে এই নাম দিয়েছিলেন। সেই থেকে ‘ফারুক’ নামেই পরিচিতি পান। চলচ্চিত্রের নায়কদের নাম ছোট হয়, এটা ছিল নামবদলের একটি কারণ। তবে আসল কারণও ছিল অন্য। সেটা অভিনেতা নিজেই জানিয়েছিলেন ২০১৬ সালে বিবিসি বাংলায় দেওয়া এক অডিও সাক্ষাৎকারে। কারণটা শোনা যাক তাঁর ভাষ্যেই, ‘ছয় দফা আন্দোলনের পর আমি ওয়ান্টেড ছিলাম, যে কারণে নাম দিয়ে দিল ফারুক। ওরা বলল, এই নামে তোমাকে প্রথমে কেউ ধরবে না। দ্বিতীয়ত, চলচ্চিত্রের নামগুলো ছোট হলে ভালো হয়, সুন্দর হয়—যেমন রাজ্জাক, উজ্জ্বল, ফারুক, আলমগীর, শাবানা—নাম ছোট হলে ক্যাচি হয়।’

চিত্রনায়ক ফারুক
ছবি : প্রথম আলো

ফারুক ছিলেন অনন্য ও অসাধারণ। কীভাবে তিনি অনন্য, তার কিছুটা ধারণা দিয়েছিলেন চলচ্চিত্রের শিক্ষক মতিন রহমান। তিনি ফারুককে নিয়ে বলেছিলেন, ‘ফারুক গ্রামীণ মানুষের স্বভাবগত জেদ, তাড়না ও প্রতিবাদের ভাষা দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। তাঁর অভিনয়ের সহজাত ভঙ্গি অন্য শিল্পীদের মধ্যে পাওয়া যায়নি কিংবা তাঁরা সেই ধরনের চরিত্র করেননি। যার কারণে সবার কাছে “মিয়াভাই” নামে পরিচিতি পেয়েছেন।’ ফারুককে নিয়ে ‘মিয়া ভাই’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম। মতিন রহমান বলছেন, ‘“মিয়াভাই” নামটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বড় ভাইকে ভাই কিংবা মিয়াভাই ডাকি। কিন্তু পরিবারের সদস্য না হলেও ফারুককে “মিয়াভাই” ডাকছি কেন? কারণ, তাঁর আচরণ ভাইয়ের মতো। চরিত্রকে আপন ভাবতেন, নিজের ভঙ্গিতে চরিত্র ধারণ করতেন। এটাই ছিল ফারুকের স্বকীয়তা।’

ফারুক অভিনীত সেরা চলচ্চিত্রগুলো নির্মিত হয়েছে সত্তর ও আশির দশকে। তখন গ্রামীণ পটভূমির কোনো গল্পভাবনায় এলেই পরিচালকেরা ফারুককে চাইতেন। ফারুককে নিয়ে ‘লাল কাজল’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেছেন মতিন রহমান। ফারুককে নেওয়ার কারণ কী? নির্মাতা মতিনের ভাষ্যে, ‘শিল্পী নির্বাচনের সময় পরিচালকেরা শিল্পীর আচরণ, বৈশিষ্ট্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। গ্রামীণ চরিত্র ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন ফারুক, সেই কারণে এ ধরনের চরিত্রে তাঁকে ভাবা হতো।’

চলচ্চিত্রের পাশাপাশি রাজনীতিতেও সমানভাবে সক্রিয় ছিলেন ফারুক। ১১তম সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকটি অঙ্গসংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ছিলেন ফারুক। নায়ক ফারুক প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ১৯৭৫ সালে। নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত বিখ্যাত ‘লাঠিয়াল’ সিনেমায় অভিনয় করার কারণে শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্র ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ২০১৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন তিনি।

২০২৩ সালের আজকের দিনে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ফারুক। তিনি দীর্ঘদিন সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আট বছর ধরে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ২০২১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে সর্বশেষ নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সিঙ্গাপুরে যান তিনি। পরীক্ষায় রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়ে। এর পর থেকেই শারীরিকভাবে অসুস্থতা অনুভব করেন তিনি। সিঙ্গাপুরে নিজের পরিচিত চিকিৎসকের পরামর্শে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। হাসপাতালে ভর্তির কদিন পর তাঁর মস্তিষ্কেও সংক্রমণ ধরা পড়ে। সেখানে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা ব্যর্থ হয়।

ফারুকের জন্ম মানিকগঞ্জের ঘিওরের একটি গ্রামে ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট। বাবা আজগার হোসেন পাঠানের ছিল পাঁচ মেয়ে ও দুই ছেলে। ফারুক ছিলেন ভাইদের মধ্যে সবার ছোট। তবে মানিকগঞ্জে বেশি দিন থাকেননি। তিনি বেড়ে উঠেছেন পুরান ঢাকায়।