কখনো শাবানার প্রেমিক, কখনো ভাই; ভিলেন থেকে নায়ক জসীম
খলনায়ক হিসেবেই যাত্রা শুরু। তারপর একসময় নায়ক হয়ে জয় করে নিলেন দর্শকের হৃদয়। ঢাকাই চলচ্চিত্রে যিনি একাধারে খলনায়ক ও নায়ক—দুই ভূমিকাতেই সমান উজ্জ্বল, তিনি চিত্রনায়ক জসীম। ১৯৯৮ সালের ৮ অক্টোবর মাত্র ৪৮ বছর বয়সে চলে যান এই কিংবদন্তি অভিনেতা। আজ তাঁর প্রয়াণের ২৭ বছর পূর্ণ হলো। চলচ্চিত্র সমালোচকদের মতে, বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যত দিন থাকবে, তত দিন এই বাংলার মানুষ চিত্রনায়ক জসীমকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। তাঁকে ভুলে যাওয়া কঠিন।
জসীম সাহেবের হাতে ফাইট শিখেছি
অল্পদিনের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের প্রিয় নায়ক হন তিনি। তিনি একমাত্র নায়ক, যিনি একাধারে ধুন্ধুমার অ্যাকশন দৃশ্য করে হাততালি কুড়িয়ে নিতেন, আবার নায়ক হয়ে দর্শকদের আবেগে জড়াতেন। তাঁর নীরব অশ্রুবিয়োগের অভিনয় ঢাকাই ছবির দর্শকের মনে গেঁথে আছে আজও।
মানুষটি গত শতকের সত্তর দশকে বর্তমান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অ্যাকশন ধারার প্রবর্তক। ঢাকাই চলচ্চিত্রে ‘ফাইটিং গ্রুপ’-এর শুরুটা হয়েছিল জসীমের হাত ধরেই। আজকের অনেক ফাইট ডিরেক্টর ও স্টান্টম্যান ছিলেন তাঁর ছাত্র। যাঁরা এখনো চলচ্চিত্রে কাজ করেন, তাঁরা গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘আমরা জসীম সাহেবের হাতে ফাইট শিখেছি।’
ঢাকাই চলচ্চিত্রে ‘ফাইটিং গ্রুপ’-এর শুরুটা হয়েছিল জসীমের হাত ধরেই। আজকের অনেক ফাইট ডিরেক্টর ও স্টান্টম্যান ছিলেন তাঁর ছাত্র। যাঁরা এখনো চলচ্চিত্রে কাজ করেন, তাঁরা গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘আমরা জসীম সাহেবের হাতে ফাইট শিখেছি।’
জসীমের আসল নাম ও চলচ্চিত্রযাত্রা
১৯৫০ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার বক্সনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আসল নাম আবদুল খায়ের জসীম উদ্দিন। ছোটবেলা থেকেই দুঃসাহসী ছিলেন। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেন ২ নম্বর সেক্টরে। যুদ্ধফেরত এই তরুণই পরবর্তীকালে ঢাকাই সিনেমায় আনলেন বীরত্ব, অ্যাকশন ও লড়াইয়ের নতুন ধারাবাহিকতা।
জসীম চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন ১৯৭২ সালে ‘দেবর’ ছবির মাধ্যমে। তবে আলোচনায় আসেন ১৯৭৩ সালে প্রয়াত জহিরুল হকের ‘রংবাজ’ চলচ্চিত্রে খলনায়ক চরিত্রে অভিনয় করে।
১৯৫০ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার বক্সনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আসল নাম আবদুল খায়ের জসীম উদ্দিন। ১৯৯৮ সালের ৮ অক্টোবর মাত্র ৪৮ বছর বয়সে চলে যান এই কিংবদন্তি অভিনেতা।
এ ছবির অ্যাকশন দৃশ্যগুলো করেছিল তাঁর নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা জ্যাম্বস ফাইটিং গ্রুপ। এই ছবির মাধ্যমেই ঢাকাই সিনেমার প্রযোজক-পরিচালকদের নজরে আসেন জসীম। মূল পরিচিতি পান দেওয়ান নজরুল পরিচালিত ‘দোস্ত দুশমন’ ছবিতে অভিনয় করে। এটি ছিল হিন্দি ‘শোলে’ ছবির রিমেক, যেখানে তিনি গব্বর সিংয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। সেই চরিত্রে এমন বাস্তবতা ও ভয় জড়িয়েছিলেন যে দর্শকেরা সিনেমা হলে ঢোকার সময় বলতেন, ‘আজ জসীমের মাইর খেতে যাচ্ছি।’
ভারতীয় অভিনেতা আমজাদ খান পর্যন্ত প্রশংসা করেছিলেন জসীমের অভিনয়ের। একসময় ‘আসামি হাজির’ ছবিতে ওয়াসিমের সঙ্গে তাঁর লড়াই দেখতে দর্শকেরা সিনেমা হলের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়েছিলেন, এমন ঘটনাও ঘটেছিল।
চলচ্চিত্র সাংবাদিকদের বয়ানে জানা যায়, ভারতীয় অভিনেতা আমজাদ খান পর্যন্ত প্রশংসা করেছিলেন জসীমের অভিনয়ের। একসময় ‘আসামি হাজির’ ছবিতে ওয়াসিমের সঙ্গে তাঁর লড়াই দেখতে দর্শকেরা সিনেমা হলের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়েছিলেন, এমন ঘটনাও ঘটেছিল।
খলনায়ক থেকে নায়ক
জসীমের চলচ্চিত্রজীবন যেন দুই অধ্যায়ের গল্প—প্রথমে ভয়ংকর খলনায়ক, পরে নায়ক হিসেবে সাধারণ মানুষের হিরো। কয়েক বছর পর সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘সবুজ সাথী’ সিনেমায় প্রথম নায়ক হিসেবে অভিনয় করেন তিনি। এই ছবির সাফল্যের পর খলনায়ক হিসেবে আর কখনো ফিরে যাননি। পর্দায় শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ‘সবুজ সাথী’-এর পর দর্শকের চোখে জসীম ছিলেন জনগণের প্রতিনিধি। অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার, প্রেমে আন্তরিক এবং লড়াইয়ে সাহসী এক মানুষ। আশির দশকে তিনি হয়ে ওঠেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাকশন হিরো।
শাবানার সঙ্গে জসীমের জুটি ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। তিনি শাবানার সঙ্গে প্রেমিক ও ভাই—দুই চরিত্রেই অভিনয় করেছেন এবং দুটি চরিত্রেই সমান সাড়া পেয়েছেন।
শাবানার সঙ্গে বিশেষ রসায়ন
শাবানার সঙ্গে জসীমের জুটি ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। এক আশ্চর্য কাকতালীয় বিষয় হলো, তিনি শাবানার সঙ্গে প্রেমিক ও ভাই—দুই চরিত্রেই অভিনয় করেছেন এবং দুটি চরিত্রেই সমান সাড়া পেয়েছেন।
‘ভাইবোন’, ‘মেয়েরাও মানুষ’, ‘পরিবার’, ‘বুকের ধন’—এই ছবিগুলোয় তিনি ছিলেন পারিবারিক নায়ক; আবার ‘লালু মাস্তান’, ‘বারুদ’, ‘নবাবজাদা’য় তিনি ছিলেন অ্যাকশন হিরো। রোজিনার সঙ্গেও তাঁর অনবদ্য জুটি দর্শকহৃদয়ে স্থান করে নেয়। আশির দশকে শাবানা ও রোজিনার বিপরীতে তাঁর অধিকাংশ ছবিই ছিল ব্যবসাসফল।
রোজিনার সঙ্গেও তাঁর অনবদ্য জুটি দর্শকহৃদয়ে স্থান করে নেয়। আশির দশকে শাবানা ও রোজিনার বিপরীতে তাঁর অধিকাংশ ছবিই ছিল ব্যবসাসফল।
এখনো ইউটিউব, রিলসে জসীম
এখনো ইউটিউব কিংবা ফেসবুক রিলসে জসীমের অভিনয়, নাচ, মারপিটের দৃশ্যের ভিডিও খোঁজেন দর্শক। তরুণেরা তাঁর সংলাপ অনুকরণ করেন, সামাজিক মাধ্যমে ট্রল তৈরি হয় তাঁকে ঘিরে। এমনকি বিজ্ঞাপনেও তাঁর সাদৃশ্য মডেল দেখা যায়। ফেসবুকে প্রায় জসীমের ছবিসহ নানা সংলাপ দিয়ে কার্ড দেখা যায়। তাঁকে নিয়ে মিম দেখা যায়।
জনপ্রিয় ছবির তালিকা
জসীমের প্রায় দুই শতাধিক ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘তুফান’, ‘জবাব’, ‘নাগ-নাগিনী’, ‘বদলা’, ‘বারুদ’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, ‘লালু মাস্তান’, ‘নবাবজাদা’, ‘অভিযান’, ‘কালিয়া’, ‘বাংলার নায়ক’, ‘গরিবের ওস্তাদ’, ‘রাজা বাবু’, ‘স্বামী কেন আসামী’, ‘মেয়েরাও মানুষ’, ‘বুকের ধন’ ইত্যাদি। এই ছবিগুলোর অধিকাংশেই ছিল সামাজিক বার্তা-দরিদ্রের সংগ্রাম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই, মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা, প্রেমে ত্যাগ—যা তাঁকে কেবল পর্দার নায়ক নয়, বাস্তব জীবনেরও প্রতীক করে তোলে।
‘রংবাজ’ ছবির অ্যাকশন দৃশ্যগুলো করেছিল তাঁর নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা জ্যাম্বস ফাইটিং গ্রুপ। এই ছবির মাধ্যমেই ঢাকাই সিনেমার প্রযোজক-পরিচালকদের নজরে আসেন জসীম। মূল পরিচিতি পান দেওয়ান নজরুল পরিচালিত ‘দোস্ত দুশমন’ ছবিতে অভিনয় করে।
বাস্তব জীবনের নায়ক
জসীম শুধু সিনেমার পর্দার নায়ক ছিলেন না, বাস্তব জীবনেও ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে তাঁর সাহসিকতার গল্প শোনানো হতো পরবর্তী প্রজন্মকে। ভিলেনের চরিত্রে অভিনয়ের সময় শুটিংয়ের ফাঁকে তিনি তরুণ সহকর্মীদের বলতেন, ‘দেশের জন্য গুলি খেয়েছি, এখন দর্শকের ভালোবাসার জন্য মার খাচ্ছি।’ তাঁর জীবনের এই বাস্তব বীরত্বই হয়তো তাঁকে সিনেমায় এত বিশ্বাসযোগ্য করেছে। দর্শকের চোখে তাঁর লড়াই, সংলাপ, আবেগ—সবকিছুই ছিল বাস্তবের সম্প্রসারণ ।
জসীমের সন্তানেরা কে কোথায়
জসীমের প্রথম স্ত্রী ছিলেন জনপ্রিয় নায়িকা সুচরিতা। পরে তিনি ঢাকার প্রথম সবাক ছবির নায়িকা পূর্ণিমা সেনগুপ্তার মেয়ে নাসরিনকে বিয়ে করেন। তাঁদের তিন ছেলে—এ কে রাহুল, এ কে সামী ও এ কে রাতুল । তিনজনই সংগীতের জগতে যুক্ত ছিলেন, অভিনয়ে কেউ আসেননি। বাবার মতো তাঁরা শিল্পের ভুবনে থেকেছেন, তবে ভিন্নপথে—সংগীতে। রাহুল গিটার বাজান ‘ট্রেনরেক’ ও ‘পরাহো’ ব্যান্ডে, সামী ও রাতুল যুক্ত ছিলেন ‘ওনড’ ব্যান্ডে। দুঃখজনকভাবে, রাতুল গত জুলাইয়ে মারা যান এবং বাবার কবরের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন।
সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘সবুজ সাথী’ সিনেমায় প্রথম নায়ক হিসেবে অভিনয় করেন তিনি। এই ছবির সাফল্যের পর খলনায়ক হিসেবে আর কখনো ফিরে যাননি। পর্দায় শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
স্মরণে জসীম
১৯৯৮ সালের ৮ অক্টোবর হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে চলে যান জসীম। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত হয়েছিল পুরো চলচ্চিত্রপাড়া। আজও সেই দিন এলে চলচ্চিত্র অঙ্গনে তাঁকে স্মরণ করা হয় গভীর শ্রদ্ধায়। জসীম প্রমাণ করেছিলেন, একজন খলনায়কও হতে পারেন নায়ক, যদি তাঁর হৃদয়ে থাকে সাহস, ন্যায়বোধ ও মানবতার আলো। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তিনি শুধু একজন অভিনেতা নন, তিনি এক যুগের প্রতীক, যেখানে খলনায়কের হাত থেকে ন্যায়ের পতাকা কেড়ে নিয়ে উঠে আসে এক সত্যিকারের নায়ক! চিত্রনায়ক জসীম ঢাকাই চলচ্চিত্রের সেই প্রথম অ্যাকশন হিরো, যিনি বীরত্ব, ভালোবাসা আর মানবিকতার মিশেলে হয়ে উঠেছিলেন জনপ্রিয় মুখ।