‘ফেরেশতে’ হয়ে রইল আক্ষেপের নাম

‘ফেরেশতে’ সিনেমার দৃশ্যে জয়া আহসান, শিমু ও সুমন ফারুকপ্রযোজকের সৌজন্যে

সিনেমার প্রধান দুই চরিত্রের অভিনেত্রীরা পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। সিনেমায় তাঁদের অভিনয়ও মন্দ ছিল না। কিন্তু অভিনয় যত ভালোই হোক, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা দুর্বল হলে তাঁরা আর কী করবেন। বলছিলাম বাংলাদেশ-ইরান যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ‘ফেরেশতে’র কথা। তিন বছর আগে শুটিংয়ের সময় সিনেমাটি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল; ইরানের ফজর চলচ্চিত্র উৎসবে মানবিক বার্তার জন্য সিনেমাটি পুরস্কারও জিতেছিল। অবশেষে গত ১৯ সেপ্টেম্বর দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে মুর্তজা অতাশ জমজমের ‘ফেরেশতে’।

একনজরে
সিনেমা: ‘ফেরেশতে’
ধরন: ড্রামা
পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার: মুর্তজা অতাশ জমজম
চিত্রনাট্য: মুমিত আল-রশিদ
অভিনয়: জয়া আহসান, রিকিতা নন্দিনী শিমু, সুমন ফারুক, শহীদুজ্জামান সেলিম, শাহেদ আলী ও শিশুশিল্পী সাথী

সকালের কারওয়ান বাজারের পরিচিত রূপ দিয়ে শুরু হয় গল্প। আলু-লেবু বিক্রেতার হাঁকডাক, সবজির ট্রাক, মাছের আড়ত, ক্রেতাদের ভিড়, রেলক্রসিং, ছুটে চলা রিকশা আর মানুষ। শেষে মাছ কাটতে থাকা এক নারীর কাছে (রিকিতা নন্দিনী শিমু) গিয়ে স্থির হয় ক্যামেরা। পাশে ছোট্ট শিশু রিতা (সাথী)। তখন সেখানেই আসেন ফেরেশতে (জয়া আহসান)৷ সন্তানকে কেন স্কুলে দেয়নি, তা নিয়ে শিমুর সঙ্গে একচোট ঝগড়া হয়ে যায়। তারপর ছোট্ট রিতাকে হাত-মুখ ধুইয়ে নিজেই স্কুলে নিয়ে যায়। গল্প যত এগোয় বোঝা যায়, রিতা একজন মূক ও বধির শিশু। গার্মেন্টসে কাজ করে ফেরেশতে। তার স্বামী আমজাদ রিকশাচালক (ফারুক সুমন)। তাদের কোনো সন্তান নেই। পাশের বাসার ছোট্ট রিতাকেই তারা আদর করে নিজের মেয়ের মতো। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও গার্মেন্টসে কাজ করে যায় ফেরেশতে। আর স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে টাকা জমায় একটা সিএনজি কেনার জন্য। তাদের এ স্বপ্ন কি পূরণ হয়?

সিনেমায় সমাজের প্রান্তিক মানুষের গল্প দেখানো হয়েছে। তবে চিত্রনাট্য আর নির্মাণ দুর্বলতায় ভালোভাবে ফুটে ওঠেনি। চিত্রনাট্য পুরোপুরি একরৈখিক; পুরোটা সময় বস্তিবাসীর দুঃখগাথা দেখিয়ে গেছেন নির্মাতা। দুঃখ ছাড়া তাদের জীবনে যেন আর কিছু নেই, সেটাও এসেছে খুবই ক্লিশেভাবে। চিত্রনাট্যে অসংখ্য ফাঁকফোকর। যেমন শিমু আর ফেরেশতেদের পরিবার খুব ঘনিষ্ঠ।

‘ফেরেশতে’ সিনেমার দৃশ্যে সুমন ফারুক ও জয়া আহসান
প্রযোজকের সৌজন্যে

শিমুর মেয়েকে নিজের মেয়ে মনে করে ফেরেশতে। কিন্তু কীভাবে তারা এতটা কাছে এল, সে গল্প দেখানো হয়নি।  বাংলাদেশের অন্যতম বড় সাংস্কৃতিক উৎসব পয়লা বৈশাখ দেখানো হলেও তা গল্পের সঙ্গে খাপ খায়নি। মনে হচ্ছিল, বর্ণিল কিছু দেখাতে হবে বলেই দেখানো। ফলে পর্দার চরিত্রের সঙ্গে দর্শক খুব কমই একাত্ম হতে পেরেছেন।

আরও পড়ুন

সিনেমার কয়েকটি জায়গা দেখতে খুব বেমানান লাগে। স্বল্প শিক্ষিত, গার্মেন্টসকর্মী হয়েও ফেরেশতে যেসব সংলাপ বলে কিংবা তার বসের রুমে সে যে বুদ্ধিমত্তা দেখায়, তা ঠিক মানায় না। অন্যদিকে এ সিনেমায় ইরানি ভাষার একটি গান রয়েছে। এখানে গানের সঙ্গে নায়ক-নায়িকার সংযোগ একটু ভালোভাবে দেখানো যেত। কিন্তু কোনো পূর্ব ঘটনা ছাড়াই গানটি যেন হুট করে আইটেম গানের মতো করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

‘ফেরেশতে’ সিনেমার দৃশ্যে জয়া আহসান, শিমু ও সুমন ফারুক
প্রযোজকের সৌজন্যে

তবে পিয়াস মজিদের লেখা বেলাল খান ও মোনা আসকারির ‘প্রেমের হাওয়া একবার যদি গায়ে লাগে রে’ শুনতে মন্দ নয়। দেখতে দেখতে বড্ড দীর্ঘ মনে হয় ‘ফেরেশতে’; অন্তত ১৫-২০ মিনিট চাইলেই কমানো যেত। তৈরি পোশাক কারখানায় যৌন নিপীড়নের অভিযোগ নতুন নয়, তবে এ সিনেমায় সেটা এসেছে একেবারেই ক্লিশেভাবে, দিনদুপুরে সবার সামনে কাজ থেকে ডেকে নিয়ে বস তার কক্ষে নারী শ্রমিককে হয়রানি করবে; এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।

ফেরেশতের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক অভিনয়। সবাই কমবেশি ভালো করেছেন। দুই বস্তিবাসীর চরিত্রে জয়া আহসান আর রিকিতা নন্দিনী শিমু দারুণ। তাদের পোশাক, মেকআপ, চালচলন, সবই বিশ্বাসযোগ্য। ফেরেশতের সঙ্গে তার স্বামীর বোঝাপড়া দেখতে ভালো লাগে। রিকশাচালক আমজাদ চরিত্রে সুমন ফারুক, শিশুশিল্পী সাথী বা পোশাককর্মীর চরিত্রে শাহেদ আলী বা গার্মেন্টসের মালিকের চরিত্রে শহীদুজ্জামান সেলিমও খারাপ নন।

‘ফেরেশতে’ সিনেমার পোস্টার। প্রযোজনা সংস্থার সৌজন্যে

সিনেমার শিশু চরিত্র মূক ও বধির। তার জগৎ বোঝাতে ‘ফেরেশতে’ মাঝেমধ্যেই ‘নির্বাক সিনেমা’ হয়ে গেছে; এটাও বেশ ভালোভাবে কাজ করে। সিনেমাটোগ্রাফিও মন্দ নয়, এতে ঢাকা শহরের প্রান্তিক মানুষের দিনলিপি ভালোভাবেই ধরেছেন চিত্রগ্রাহক বয়রাম ফজলি। কিন্তু দুর্বল চিত্রনাট্য আর নির্মাণের কারণে শেষ পর্যন্ত ফেরেশতে হয়ে রইল এক আক্ষেপের নাম।