গল্প যত এগিয়ে যায়, রহস্য তত বাড়ে

‘জ্বীন’ ছবির লুকে পূজা চেরি ও সজল
ছবি: সংগৃহীত

দেশের ভৌতিক ঘরানার সিনেমা তেমন একটা হয় না। সেখানে ব্যতিক্রম ঈদের সিনেমা ‘জ্বীন’। ছবিটি দেখতে গিয়ে বেশ অবাক হতে হলো—বসুন্ধরা সিটির লিফটের সামনে লম্বা লাইন! বিপণিবিতানে আগমনের কত হেতুই তো আছে, তবে জানা গেল সবাই সিনেমা দেখতে এসেছেন। বেশির ভাগ দর্শকই কথা বলছিলেন জ্বীন সিনেমা নিয়ে। স্টার সিনেপ্লেক্সে প্রবেশমুখে সামনাসামনি দুটি হলের প্রবেশপথ। কাকতালীয়ভাবে দুটি হলেই চলছে ভৌতিক সিনেমা—দেশি ‘জ্বীন’-এর মুখোমুখি হলিউডের ‘দ্য পোপস এক্সরসিস্ট’। রাসেল ক্রোর সিনেমা। তারপরও বাংলা সিনেমাটিকেই বেছে নিয়েছেন দর্শক।

নাদের চৌধুরী পরিচালিত ছবিটি নিয়ে যখন এত মানুষের আগ্রহ, প্রশ্ন উঠতেই পারে ‘জ্বীন’ কি ভালো গল্পের ছবি? ভৌতিক গল্পে যে উপকরণ থাকা দরকার, তার প্রায় সবই ছিল সিনেমাটিতে। তা সত্ত্বেও ‘কিন্তু’ রয়ে গেছে। সংক্ষেপে সিনেমাটির গল্প এমন—বিয়ের দুই দিন পরই রাফসান বুঝতে পারে, তার স্ত্রী রাতে অস্বাভাবিক আচরণ করছে। একা ঘুম থেকে উঠে সারা বাড়ি ঘোরে। বুঝতে আর বাকি থাকে না, মনার গায়ে জিন ভর করেছে। ভীতিকর এক পরিবেশ তৈরি হয়। রাফসানের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু বিজয় এখন মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক। রাফসান তাকে ঘটনা খুলে বলে। বিজয় প্রথম দিকে ঘটনাটিকে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে ব্যাখ্যা করে, কিন্তু একদিন তার সামনেই ভৌতিক ঘটনা ঘটতে থাকে। যার ব্যাখ্যা তার কাছেও নেই। ঘটনার পেছনের ঘটনা খুঁজতে গিয়ে একের পর এক রহস্য জট পাকাতে শুরু করে। গল্প যত এগিয়ে যায়, রহস্য তত বাড়ে। দর্শকের আগ্রহের পারদও যেন বাড়তে থাকে। গল্পের প্লট ভালো বলতেই হবে। তবে অভিনয়, নির্মাণ, উপস্থাপনা ও আবহসংগীতে কি উতরাতে পেরেছেন ‘জ্বীন’?

ফ্যাশন আলোকচিত্রী রাফসান চরিত্রে আব্দুন নূর সজলের অভিনয় ভালো ছিল। নাটকের চরিত্রগুলো থেকে তাকে আলাদা করা গেছে। স্ত্রী মনাকে মানসিকভাবে সমর্থন দেওয়া, বাঁচাতে চাওয়ার অভিব্যক্তি পর্দায় ভালোই ফুটিয়ে তুলেছে। স্ত্রীর সঙ্গে খুনসুটি দর্শকদের বিনোদন দিয়েছে। অন্যদিকে মনা চরিত্রে পূজা চেরির অভিনয়ে পরিপক্বতা দেখা গেছে। জিনরূপে তার চাহনি, বাচনভঙ্গি, অভিব্যক্তি ভয়ের আবহ তৈরি করেছে। একটি দৃশ্যে রাফসান দেখে, মনা তার পাশে নেই। ওপরে ঝুলে আছে। মনা সঙ্গে সঙ্গে রাফসানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গলা টিপে হত্যা করতে চায়। পরে একবার বিজয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মনা। জ্বীনরূপী মনা বঁটি হাতে তাকে খুন করতে চায়। মনার অভিনয়, গলার স্বর শুনে ভয়ে সিনেমা হলের সামনের সারির এক নারীকে দেখা গেল বন্ধুর হাত আগলে রাখতে। সিনেমায় এমন বেশ কিছু দৃশ্যে ভয় জাগাবে।

প্রথম আলো অফিসে সজল ও পূজা চেরী
ছবি : খালেদ সরকার

বিজয়ের চরিত্রে মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে মানিয়ে গেছেন জিয়াউল রোশান। শিক্ষক হিসেবে স্মার্টনেস, কথা বলার স্টাইল, ভূত নিয়ে যুক্তি দিয়ে কথা বলার দৃশ্যগুলো ভালো ছিল। পার্শ্বচরিত্রে রাফসানের মা, মনার মা, ফোর-জি চরিত্রের অভিনয়শিল্পীরা ভালো করেছেন। তবে সবার অভিনয়ে আরও গুরুত্ব দিলে ভালো হতো। আরও কিছু অসংগতি আছে—যে বাড়ির একজনের ওপর জিন ভর করেছে, সে বাড়িতে যে আবহ তৈরি হওয়ার কথা, সিনেমায় সেটা নেই। অভিনয় দিয়ে ভীতিকর পরিবেশ আরও শক্তভাবে তৈরি করা যেত। পালিয়ে বিয়ে করার পর যখন পূজার মা তাকে প্রথম দেখতে আসেন, তখন পূজার মধ্যে আবেগের অভিব্যক্তির দরকার ছিল। পূজা ভূত রূপে বাসায় ঘোরে জেনেও বাসার কারও মধ্যে সেই ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়নি। এমনকি এ ব্যাপারটি সজলের মধ্যেও কম ছিল। সজল প্রথম যখন পূজাকে ভূত রূপে দেখে, তার মধ্যেও ভয়ের অভিব্যক্তি কম ছিল।

শিক্ষক চরিত্র করা রোশান হুট করেই একটি গানে চলে আসে, যা খাপছাড়া মনে হয়েছে। এ ছাড়া তার চরিত্রটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে ভণ্ড ওঝার দৃশ্যটির কতটা দরকার ছিল, সেটাও ভাবা দরকার ছিল। তা ছাড়া মনার ওপর যে শৈশব থেকেই জিন ভর করেছে, সেই প্রসঙ্গে মনা কতটা জানে, সেটা পরিষ্কার নয়। দেখে মনে হয়েছে, মনা কিছুই জানে না।

আরও পড়ুন

তারপরও ভৌতিক সিনেমাটি নিয়ে দর্শকদের আগ্রহ দেখা গেছে। এর কারণ হতে পারে ছবিতে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ছিল না। নতুন ঘটনা গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। বিরতির পর সিনেমাটি আরও বেশি রোমাঞ্চ তৈরি করেছে। শেষ দৃশ্যের আগেও সেটা ধরে রেখেছে। মনার ওপর জিনের আচরণে ব্যাখ্যা দিতে পারে না বিজয়, সে দ্বারস্থ হয় তার শিক্ষকের কাছে। তিনিই পরে পুরো গল্পকে টেনেছে। এখানে বেশ চমকও ছিল। কিন্তু শেষ দৃশ্যের গল্পটা আরেকটু পরিমার্জিত করলে ভালো হতো। এখানে বেশ কিছু কর্মকাণ্ড দর্শকের মনে ভয় তৈরি করতে পারেনি। অনেকের কাছে সেটা কমেডিও মনে হয়েছে। কিছু দৃশ্যে বৈদ্যুতিক লাইট জ্বালালে ভূত চলে যায়। কিছু দৃশ্যে লাইট থাকার পরও ভৌতিক কর্মকাণ্ড চলে।

ভৌতিক গল্পের সিনেমায় লাইট, ক্যামেরা ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক নিয়ে আরও সময় দেওয়া দরকার ছিল। জিনের উপস্থিতি যখন টান টান উত্তেজনা তৈরি করতে যাচ্ছে, তখন এক দর্শককে বলতে শোনা গেল—ক্রাইম থ্রিলার সিনেমার মিউজিক হয়ে গেছে। স্রেফ মিউজিক দিয়েও অনেক দৃশ্যে রোমাঞ্চ তৈরি করা যেত। তবে দেশের প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যিক সিনেমা হিসেবে ‘জ্বীন’ দর্শকদের হতাশ করবে না। তবে আন্তর্জাতিক হরর সিনেমার সঙ্গে এটিকে মেলানোর চেষ্টা না করাই ভালো।