আর সৌরভ ছড়াবে না কালাইয়ের ‘হাসনাহেনা’
আশির দশকে প্রতিদিন চার শোর পরও দর্শকদের চাপে মর্নিং শো চালাতে হয়েছিল ‘হাসনাহেনা’ সিনেমা হলে। দর্শকেরা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় জৌলুশ হারায় দেড় দশক আগেই। ১৯৮১ সালে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলা সদরে প্রতিষ্ঠিত প্রেক্ষাগৃহটি টানা ২৭ বছর ধরে রুপালি পর্দায় বিনোদনের সৌরভ ছড়ায়। এরপর সিনেমা হল ব্যবসায় দর্শকখরায় কুলাতে না পেরে দুই যুগের পথচলায় ইতি টানে ২০০৮ সালে। তখনই চিরতরে আলো নিভে যায় হাসনাহেনার পর্দায়। এরপর সিনেমা হলটির রুপালি পর্দায় আর আলো জ্বলে ওঠেনি। চলচ্চিত্র প্রদর্শন ব্যবসায় সুদিনের অপেক্ষায় দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল সিনেমা হলটি। তবে শেষ রক্ষা হয়নি।
হাসনাহেনা সিনেমা হল ভেঙে সম্পত্তি বিক্রি শুরু করেছে মালিক কর্তৃপক্ষ। হল ভেঙে ফেলে সেখানে প্লট আকারে জায়গা বিক্রি চলছে। কিছু জায়গা কিনেছেন স্থানীয় দুই ব্যবসায়ী। তাঁদের একজন কালাই সদরের জুয়েলারি ব্যবসায়ী খন্দকার মাহমুদুর রহমান বলেন, হাসনাহেনা সিনেমা হলের কিছু অংশ কিনেছেন তাঁরা। সেখানে বিপণিবিতান নির্মাণের পরিকল্পনা আছে।
জানা গেছে, হাসনাহেনায় শেষ আঘাত পড়েছে গত পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে। ৪১ বছর ধরে যেখানটায় হাসনাহেনা দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে এখন সিনেমা হলের স্মৃতিচিহ্ন নেই। আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে প্রক্ষেপণযন্ত্র ও আসবাব। ভেঙে ফেলা হয়েছে সিনেমা হলের স্থাপনাও। সিনেমা হল ভেঙে ফাঁকা জায়গা টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।
গৌরবের দুই যুগ
সিনেমা হলের মালিক ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাসনাহেনার যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮১ সালে। তৎকালীন একটি ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাজমুস সাকিব ও তাঁর ছোট ভাই উপজেলা যুবসংঘের সাবেক সভাপতি মোখতাছুর রাফে খসরু কালাই সদরে বগুড়া-জয়পুরহাট সিঅ্যান্ডবি সড়কের পাশে ২০ শতাংশ জায়গার ওপর হাসনাহেনা সিনেমা হল চালু করেন। পাশেই ১০ শতাংশ জায়গায় ছিল তাঁদের আবাসিক ভবন। এই হলে প্রথম প্রদর্শিত হয় আলমগীর কুমকুম পরিচালিত রাজ্জাক-ববিতা অভিনীত ছায়াছবি ‘রাজবন্দী’। প্রথম দিনেই ৪৫০ আসন দর্শকের ভিড়ে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। ছিল হাউসফুল। ২০০৫ সাল পর্যন্ত জমজমাট দর্শক ছিল এই হলে। এরপর টানা দর্শকখরা চলে। এ অবস্থায় কয়েক বছর ধরেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সিনেমা হলের ব্যবসা। ২০০৮ সালে মান্না-চম্পা অভিনীত এবং মনতাজুর রহমান আকবর পরিচালিত ‘বাবার আদেশ’ প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে ২৭ বছরের পথচলায় ইতি টানে সিনেমা হলটি।
হাসনাহেনা সিনেমা হল চালুর পর থেকেই প্রক্ষেপণযন্ত্র পরিচালনায় প্রথমে অপারেটরের সহকারী এবং পরে প্রধান অপারেটরের চাকরি করতেন শহিদুল ইসলাম। সিনেমা হলে দর্শক কমে যাওয়ায় পেশাতে অনিশ্চয়তা নেমে এলে তিনি চাকরি ছেড়ে কালাই পৌরসভায় ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে যোগ দেন।
শহিদুল ইসলাম পুরোনো স্মৃতির দরজা খুলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। বলেন, শুরু থেকেই এই সিনেমা হলে জমজমাট দর্শক ছিল। ৪৫০ আসনের এই সিনেমা হল বেশির ভাগ সময় ছিল হাউসফুল। আশির দশকে দর্শকের চাপ সামলাতে দুপুর, বৈকালিক, সান্ধ্য ও রাত্রিকালীন শো ছাড়াও মর্নিং শো চালাতে হয়েছে। ছবি দেখার জন্য লম্বা লাইন দিয়ে একসময় টিকিট কাটতে হতো। সেই সময়ে ৮ থেকে ১০ জনের একটি দল কালোবাজারে টিকিট বিক্রি করত। পাঁচ টাকায় টিকিট কিনে দশ টাকায় বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন দলটির সদস্যরা। ওই সময় কালোবাজারে টিকিট বিক্রি সিনেমা হলগুলোর সামনে স্বাভাবিক দৃশ্যই ছিল। বুকিংয়ের অর্থ, নানা কর পরিশোধ করেও প্রেক্ষাগৃহের মালিকের হাতে বেশ লাভ থাকত।
জানা গেছে, দর্শকখরায় সিনেমা হল ব্যবসায় দুর্দিন নেমে এলে প্রথমে প্রদর্শন বন্ধ হয়ে যায়। আরও পরে হলটির মালিক নাজমুস সাকিব মারা গেলে হাসনাহেনার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত পড়ে। সিনেমা হলটির বর্তমান মালিক নাজমুস সাকিবের সহধর্মিণী হাসনাহেনা এবং তাঁর পাঁচ মেয়ে শিমু, শেফু, শম্পা, শিপন ও সেতু এটি ভেঙে প্লট আকারে জায়গা বিক্রির উদ্যোগ নেন।
সিনেমা হলটির সাবেক ব্যবস্থাপক কালাই মোল্লাপাড়ার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘শুরুতে হলের সামনে প্রসাধনীর ব্যবসা দিয়েছিলাম। পরে ব্যবস্থাপকের চাকরি নিই। হল ব্যবসায় দর্শকখরার শুরু ২০০৫ সালে। এরপর সিনেমা হলে দর্শকবিমুখ হওয়ায় অন্য সময় ছবি বুকিংয়ের অর্থও ঘরে ওঠেনি। শেষের দিকে বিদ্যুৎ বিল, হলের স্টাফদের বেতনও পরিশোধ করা যাচ্ছিল না ছবি চালানোর টাকায়। বাধ্য হয়ে সিনেমা হল বন্ধ ঘোষণা করা হয়।’
বাহাদুর মিয়া, যিনি একসময় হাসনাহেনা সিনেমা হলের ক্যানভাসার ছিলেন, তিনি রিকশা, ভ্যান বা ঘোড়ার গাড়ির দুপাশে টাঙানো ‘চলিতেছে’ লেখা ছবির পোস্টার সেঁটে, প্রচার মাইক নিয়ে চষে বেড়াতেন গোটা এলাকা। সিনেমাহল বন্ধের পর পেশা ছেড়ে এখন রংমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। ৪৫ বছর বয়সী বাহাদুর মিয়া বলেন, ‘শুরুর দিকে হলে গেটম্যান পদে চাকরি করতাম। পরে ছবির প্রচারকাজ শুরু করি। সিনেমা হলে দর্শকের অন্য রকম ঢল ছিল।’
যে কারণে ভাঙা পড়ল
নাজমুস সাকিবের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারসূত্রে হাসনাহেনার মালিকানা যায় স্ত্রী এবং পাঁচ মেয়ের হাতে। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা মেয়েদের বসবাস ঢাকায়। একদিকে সিনেমা হলের ব্যবসায় দুর্দিন, অন্যদিকে ব্যবসা ও সম্পদ দেখভাল করার লোকের অভাব—দুই সংকটে সিনেমা হল ভেঙে সম্পত্তি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন নাজমুস সাকিবের স্ত্রী-মেয়েরা।
নাজমুস সাকিবের মেয়ে ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংগীতশিল্পী নিশাত ইমতিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘শৈশবে বেড়ে ওঠা পৈতৃক বাসা এবং পারিবারিক ঐতিহ্যের সিনেমা হলটাকে ঘিরে শৈশবের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে ছিল। পৈতৃক স্মৃতিচিহ্ন মুছে যাক, সেটা আমরাও চাইনি। পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রাখতে আমরাও চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের কোনো ভাই না থাকায় পৈতৃক সম্পদ ও পারিবারিক ব্যবসা দেখভাল করার মতো কেউ ছিল না। সিনেমা হল ব্যবসায় দুর্দিনের কারণে এক যুগের বেশি সময় ধরে সেটি বন্ধ ছিল। সুদিনের কোনো আশাও ছিল না। বাধ্য হয়ে পৈতৃক বাসা এবং পারিবারিক সিনেমা হলটা ভেঙে জায়গা বিক্রি করে দিতে হচ্ছে।’