যে কারণে এ টি এম শামসুজ্জামানের মন ভালো নেই

এ টি এম শামসুজ্জামান। ছবি: প্রথম আলো

গুণী অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামানের মন ভালো নেই। প্রায় দুই বছর ধরে তিনি সূত্রাপুরের নিজের বাড়িতেই আছেন। দীর্ঘদিন তিনি অভিনয় থেকে থেকে দূরে থাকায় মন ভালো নেই। তাঁর শেষ ইচ্ছে ছিল একটি ছবি বানাবেন, কিন্তু ছবি বানানোর মতো টাকাও নেই তাঁর কাছে। অভিনেত্রী মৌসুমী দেখা করে তাঁর কাছে চিত্রনাট্য চেয়েছিলেন। এরপর তিনিও আর কোনো খোঁজখবর নেননি। কাছের মানুষেরা অনেকেই কোনো উপলক্ষ ছাড়া তেমন একটা খোঁজ নেন না এই তারকার।

২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের শক্তিশালী অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান। তখন দেড় মাসের বেশি সময় হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পরে বাসায় ফেরেন তিনি। তারপর থেকে বাসায়ই তিনি বিশ্রামে আছেন। এই সময়ে দীর্ঘদিন তিনি শুটিংয়ে অংশ নেননি। এই অভিনেতার স্ত্রী রুনি জামান জানান, সবার প্রিয় এই অভিনেতা এখন শারীরিকভাবে আগের চেয়ে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। নিজেই এখন অভিনয়ের কথা বলেন। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি বলছেন, তিনি আবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে চান। রুনি জামান বলেন, ‘৫০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি নিয়মিত অভিনয় করেন। আগে কখনো অভিনয় থেকে এত দীর্ঘ বিরতি নেননি। অভিনয়ের মানুষ তিনি, অভিনয় ছাড়া থাকতে পারেন না। এফডিসি, লাইট, ক্যামেরার সঙ্গ এবং সহশিল্পীদের ছাড়া তাঁর ভালো লাগে না। এখন আবারও অভিনয় করার কথা বলেন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আর কয়টা দিন দেখব, তারপরে আমার সিদ্ধান্ত নিব।’

এ টি এম শামসুজ্জামান। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

এ টি এম শামসুজ্জামানের শেষ ইচ্ছা—একটি চলচ্চিত্র তৈরি। তাঁর এই ইচ্ছা পূরণে দরকার ২ কোটি টাকা। এই টাকা তাঁর কাছে নেই। দীর্ঘদিন ধরে তিনি অপেক্ষা করেছেন এই আশায়, কোনো একজন প্রযোজক হয়তো তাঁকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসবেন। জানা গেল, তাঁর শেষ ছবির গল্পও ঠিক করে রেখেছেন। কিন্তু তিনি দুশ্চিন্তায় আছেন। আদতে তাঁর এই গল্প রুপালি পর্দায় চিত্রায়িত করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে। তাঁর বয়সও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। শারীরিকভাবেও তিনি দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন। এই অভিনেতার স্ত্রী রুনি জামান কথা বলার সময় পাশ থেকে প্রশ্ন করলেন এ টি এম শামসুজ্জামান। তিনি জানতে চাইলেন, কে ফোন করেছেন? তাঁর স্ত্রী জানালেন ‘প্রথম আলো’ থেকে। বেশ কয়েকবার বলার পরে তিনি বুঝতে পারলেন এটি। রুনি জামান তাঁকে বলেন, ‘তোমার শেষ ছবি বানানো নিয়ে কথা বলছি।’ শুনে এ টি এম শামসুজ্জামান মন খারাপ করেন। রুনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনি ছবি বানানোর ঘোরেই থাকেন সব সময়। কেউ ছবির কথা জিজ্ঞাসা করলেই তাঁর খারাপ লাগে। ছবিটা বানানো তাঁর স্বপ্ন। এখনো আশা ছাড়েননি। তিনি প্রতিদিনই বলেন, মনের মতো ছবি বানিয়ে মরব।’

এ টি এম শামসুজ্জামান
ছবি:সংগৃহীত

গত অক্টোবর মাসে এ টি এম শামসুজ্জামানের সূত্রাপুরের বাসায় তাঁকে দেখতে ছুটে যান ওমর সানী-মৌসুমী দম্পতি। বেশ কিছু সময় তাঁরা একসঙ্গে কাটান। ফিরে এসে ওমর সানী ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। তিনি সেখানে লেখেন, ‘তাঁর এত আদর, ভালোবাসা, স্নেহ ভোলার মতো নয়। মৌসুমী তাঁর কাছে আবদার করল একটি চিত্রনাট্যের। মৌসুমীর অনেক দিনের শখ, তাঁর স্ক্রিপ্টে ছবি বানাবে। তিনি শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন।’
সেই সময় এ টি এম জানিয়েছিলেন তিনি লিখতে পারেন না। তাঁর কাছে ভালো গল্প আছে। তিনি তাদের বলেছিলেন, লেখার জন্য শুধু একজন লোক পাঠালেই তিনি চিত্রনাট্য করে দিতে পারবেন। তিনি এখনো চিত্রনাট্য লেখার আশায় আছেন। ওমর সানী ও মৌসুমী কাউকে পাঠালে তিনি লেখার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। রুনি জামান জানান, মৌসুমীর জন্য চিত্রনাট্য লেখার কথা ছিল। পরে তাঁরা আর খোঁজ নেননি। সেই কথা মাঝেমধ্যেই তিনি বলেন। তাঁরা লোক পাঠালে তিনি মৌসুমীর জন্য অবশ্যই লিখবেন। তাদের খুবই স্নেহ করেন তিনি।

এ টি এম শামসুজ্জামান। ছবি: সংগৃহীত

দেড় বছরের বেশি সময় ধরে তিনি টানা বাসায় আছেন। ঘর থেকেও খুব একটা বের হন না। বই পড়া, টিভি দেখা ও স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করে সময় কাটান। আগে ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই নিয়মিত খবর নিলেও এখন কোনো উপলক্ষ ছাড়া কেউ তেমন একটা আসেন না। এমনটাই জানালেন রুনি জামান।

তিনি আরও জানান, এফডিসির অনেকের সম্পর্কে প্রায়ই বলেন এই অভিনেতা। তাঁদের সবার নম্বর না থাকায় যোগাযোগ করা হয় না। মাঝেমধ্যে তাঁর ইচ্ছা করে এফডিসি ঘুরে আসার। তাঁর প্রিয় সহকর্মীরা অনেকেই মারা যাচ্ছেন। এতে তাঁর মনটা বড্ড ভারী হয়ে ওঠে। রুনি জামান বলেন, ‘এফডিসির শিল্পী সমিতি (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি) তাঁর (এ টি এম শামসুজ্জামান) নিজে হাতে গড়া। আমার পাঠানো কাবাব আর মাংস দিয়ে শিল্পী সমিতির যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই শিল্পীদের আগের মতো কাজ নেই, ছবি হচ্ছে না, অনেকেই কষ্টে আছেন। এগুলো দেখে তাঁর খারাপ লাগে। অনেকেই আগে নিয়মিত দেখা করতে আসতেন। এখন তাঁর জন্মদিন, ঈদ বা কোনো উপলক্ষ ছাড়া তেমন খবর নেয় না কেউ। এ জন্যও তিনি মাঝেমধ্যে আফসোস করেন।’ আগে অনেকেই তাঁর মৃত্যু নিয়ে বানোয়াট খবর প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি বেশ কিছু পোর্টাল তাঁর অসুস্থতা নিয়েও মিথ্যা খবর প্রকাশ করায় মনঃক্ষুণ্ন এই এই অভিনেতা।

এ টি এম শামসুজ্জামান। ছবি: সংগৃহীত

এ টি এম শামসুজ্জামান বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা, পরিচালক, কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ লেখক। অভিনয়ের জন্য কয়েকবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। শিল্পকলায় অবদানের জন্য ২০১৫ সালে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক। ১৯৬১ সালে পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর ‘বিষকন্যা’ চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে তাঁর চলচ্চিত্রে ক্যারিয়ার শুরু হয়। এ পর্যন্ত শতাধিক চিত্রনাট্য ও কাহিনি লিখেছেন। প্রথম দিকে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্রজীবন শুরু করেন তিনি।

নোয়াখালীর দৌলতপুরে নানাবাড়িতে এ টি এম শামসুজ্জামান ১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার ভোলাকোটের বড়বাড়ি আর ঢাকায় থাকতেন পুরান ঢাকার দেবেন্দ্র নাথ দাস লেনে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার পোগোজ স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল, রাজশাহীর লোকনাথ হাইস্কুলে। তাঁর বাবা নূরুজ্জামান ছিলেন নামকরা আইনজীবী। তিনি শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। মা নুরুন্নেসা বেগম। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে এ টি এম শামসুজ্জামান সবার বড়।

‘রঙের মানুষ’ নাটকের দৃশ্যে এ টি এম শামসুজ্জামান ও সালাউদ্দিন লাভলু। ছবি: সংগৃহীত