এফডিসি থেকেই গায়েব করে ফেলা হয় সেই চিত্রনাট্য

ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে বা এর ইতিহাস নিয়ে হাতে গোনা দুই থেকে তিনটির বেশি চলচ্চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় নাকোলাজ ছবি

সে এক অন্য রকম সময়। বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষার যৌক্তিক দাবিতে গুলি চলেছিল ১৯৫২ সালে, ২১ ফেব্রুয়ারিতে। সেদিন থেকে বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসও বাঁক নিয়েছিল এক অনুপ্রেরণাময় ভবিষ্যতের দিকে। রাজনীতি আর সংস্কৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে তৈরি করল স্বাধিকার আন্দোলনের ঋজু পথ। আর সেই পথ ধরেই একসময় বাঙালি পৌঁছে গেল একাত্তরে। শুরু থেকে একুশের চেতনায় প্রবহমান হয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সে সময় গান, নৃত্য, নৃত্যনাট্য বা নাটক, সিনেমা—শিল্পের নানা শাখায় সে ধারার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এ আন্দোলন বাঙালি সংস্কৃতিকে যেমন পুষ্ট করেছে, তেমনি রাজনীতি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনে বাঙালি এগিয়েছে একাত্তরের দিকে।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে, প্রায় ৭০ বছরের সেই গৌরবের ইতিহাস। কিন্তু সেসবের খুব কমই উঠে এসেছে সেলুলয়েডের পর্দায়। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে বা এর ইতিহাস নিয়ে হাতে গোনা দুই থেকে তিনটির বেশি চলচ্চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। যার প্রথমটি ‘জীবন থেকে নেয়া’। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ছবিটি বানিয়েছিলেন জহির রায়হান। যে ছবি শুধু কালজয়ী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, স্বাধীনতাসংগ্রামেও ব্যাপক অবদান রেখেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৩৫ বছর পর ভাষা আন্দোলন ঘিরে দ্বিতীয় ছবিটি নির্মিত হয়।

শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত ‘বাঙলা’ মুক্তি পায় ২০০৬ সালে। মাঝের চার দশকে ভাষাকে উপজীব্য করে একটি সিনেমাও নির্মিত হয়নি দেশে। এরপর আবার দীর্ঘ বিরতি। ২০১৯ সালে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যানারে তৌকীর আহমেদ নির্মাণ করেন ‘ফাগুন হাওয়ায়’।

‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে প্রভাতফেরীর দৃশ্য। ছবি: ইউটিউব থেকে

জানা গেছে, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামে একটি ছবি নির্মাণের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। সে ১৯৭০ সালের দিকের কথা। সিনেমার কাহিনি অনুসারে চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর চিত্রনাট্যও নির্মাণ করেন। তা এফডিসিতে জমা দেওয়ার পর পুরোটা ভেস্তে দেয় পাকিস্তান সরকার। পরবর্তী সময়ে জহির রায়হানের স্ত্রী সুচন্দা চলচ্চিত্রটি নির্মাণের উদ্যোগ নিলেও সেই চিত্রনাট্য আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, এফডিসি থেকেই গায়েব করে ফেলা হয় সেই চিত্রনাট্য।

আমজাদ হোসেন

আরেক বরেণ্য চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন ‘শহীদ আসাদ’ নামে একটি ছবি নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কুমিল্লার এক জনসভায় মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে নিয়ে ছবিটির মহরত হয়েছিল। কিন্তু পরে আর কাজ এগোয়নি। কারণ একটাই, তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অনুমতি না পাওয়া। ‘শহীদ আসাদ’–এর পরিকল্পনা থামিয়ে আমজাদ হোসেন ব্যস্ত হয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণে।

বেশ কিছুদিন আগে চলচ্চিত্র গবেষক ও লেখক অনুপম হায়াতের কাছে ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে কেন চলচ্চিত্র নির্মিত হওয়া উচিত, জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেছিলেন, ‘শুধু চলচ্চিত্র কেন, ভাষা আন্দোলন নিয়ে গান, গল্প, নাটক, উপন্যাস, অঙ্কন—সংস্কৃতির প্রতিটি শাখায় সবকিছুই হওয়া উচিত। ভাষা আন্দোলন আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। এ জন্যই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি এসেছে। এটা একটা আণবিক শক্তি, যার চূড়ান্ত বিস্ফোরণ হলো মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু যাঁরা বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন, তাঁরা আজ নেই। আর এখন যাঁরা আছেন, তাঁরা কেবল লাভ, লোভ আর খ্যাতির পেছনে ছুটছেন।’

ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কেন অনাগ্রহ? চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করার মতো প্রযোজক পাওয়া যায় না। সব প্রযোজকই লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত চান। কিন্তু এ ধরনের বিষয় নিয়ে নির্মিত ছবি বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে দর্শক পায় না বললেই চলে। সে ক্ষেত্রে সরকার অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু তেমন কিছু এখনো দৃশ্যমান নয়। এ কারণে দেশ, দেশের মানুষ ও নতুন প্রজন্মের জন্য তেমন কোনো ছবি হচ্ছে না। যেখানে ভাষা আন্দোলনের গল্প তুলে ধরা হবে।

এবার অল্প কথায় জেনে নিই ভাষাকে উপজীব্য করে নির্মিত তিনটি চলচ্চিত্রের কথা।

জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০)
পরিচালক: জহির রায়হান

অভিনয়ে: রাজ্জাক, সুচন্দা, রোজী সামাদ, খান আতা, রওশন জামিল, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।

জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির গল্প ছিল যেন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এক সাংস্কৃতিক মুখবন্ধ। ছবি: সংগৃহীত

এই চলচ্চিত্রে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’, ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে’ প্রভৃতি গান ব্যবহৃত হয়েছে এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে ধারণ করা হয়েছে। এই সিনেমা বাংলার মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের আগে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। বড় বোনের চরিত্রে রওশন জামিলকে অত্যাচারী, শাসক হিসেবে দেখানোর মধ্য দিয়ে মূলত পশ্চিম পাকিস্তানকেই রূপক অর্থে দেখানো হয়। ‘পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চলচ্চিত্র’—এ অভিযোগে চলচ্চিত্রটির শুটিংয়ের সময় জহির রায়হানকে ক্যান্টনমেন্টে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু পরে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী।

বাঙলা (২০০৬)
পরিচালনা: শহীদুল আলম খোকন
অভিনয়ে: শাবনূর, হুমায়ুন ফরীদি, মাহফুজ আহমেদ প্রমুখ।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র একজন বোবা স্ত্রী। কেবল ভাষার মিছিলই সেই নারীকে চঞ্চল, কৌতূহলী করে তোলে। বাংলায় চিৎকার করতে বলে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান একসময় সেই নারীকে স্পষ্টভাবে প্রথমবারের মতো ‘বাংলা’ শব্দটি উচ্চারণ করায়।

তখনই তার মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসে, সে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সেই রক্ত শহীদ আসাদের নাকি সেই বোবা বউয়ের—সিনেমা শেষে এ প্রশ্ন দর্শকের মনে গেঁথে যায়।

এমনিতে বর্তমানে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের বাজার মন্দা। সেখানে মাতৃভাষা কিংবা ভাষা আন্দোলন নিয়ে সিনেমা—ভাবনার জন্য প্রথমেই উৎসাহের হাত প্রসারিত করতে হবে সরকারকে। অনেকে মনে করছেন, চলচ্চিত্রে অনুদান নির্বাচনে ভাষা নিয়ে চলচ্চিত্রের পাণ্ডুলিপির বিষয়ে বিশেষ বিবেচনা করা উচিত।
শাবনুর। ছবি: প্রথম আলো

ফাগুন হাওয়ায় (২০১৯)
পরিচালনা: তৌকীর আহমেদ
অভিনয়ে: আবুল হায়াত, আফরোজা বানু, ফারুক হোসেন, তিশা, সিয়াম, সাজু খাদেম, আজাদ সেতু, বলিউড অভিনেতা যশপাল শর্মা প্রমুখ।

টিটো রহমানের বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা গল্প ‘বউ কথা কও’ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্রটি। এটি ৪৪তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ ৩টি বিভাগে পুরস্কৃত হয়। তবে এটাকে সম্পূর্ণ ভাষা আন্দোলন নিয়ে নির্মিত বলা যাবে না। ১৯৫২ সালের মফস্বলের একটি গল্প নিয়ে নির্মিত, যেখানে ভাষা আন্দোলনের রেশও রয়েছে। ছবিতে এক মফস্বল শহরে ভাষা আন্দোলনের সময় মানুষের ভাবনা, আন্দোলন আর চেতনাকে রূপক অর্থে তুলে ধরা হয়েছে।

এ ধরনের ঐতিহাসিক গল্পকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। এ জন্য বিস্তর গবেষণা দরকার। প্রচুর অর্থলগ্নির বিষয় আছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ জরুরি।
‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবির দৃশ্য

শুধু পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নয়, ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তুলনামূলক কম হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের ওপর নির্মিত অল্প কিছু প্রামাণ্যচিত্রের মধ্যে রয়েছে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কারপ্রাপ্ত রফিক উদ্দিন আহমেদ পরিচালিত ‘হৃদয়ে একুশ’, শবনম ফেরদৌসী নির্মিত ‘ভাষা জয়িতা’, রোকেয়া প্রাচীর ‘বায়ান্নর মিছিল’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, এ ধরনের ঐতিহাসিক গল্পকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। এ জন্য বিস্তর গবেষণা দরকার। প্রচুর অর্থলগ্নির বিষয় আছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ জরুরি। এমনিতে বর্তমানে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের বাজার মন্দা। সেখানে মাতৃভাষা কিংবা ভাষা আন্দোলন নিয়ে সিনেমা—ভাবনার জন্য প্রথমেই উৎসাহের হাত প্রসারিত করতে হবে সরকারকে। অনেকে মনে করছেন, চলচ্চিত্রে অনুদান নির্বাচনে ভাষা নিয়ে চলচ্চিত্রের পাণ্ডুলিপির বিষয়ে বিশেষ বিবেচনা করা উচিত।