চলচ্চিত্রই যদি না থাকে, এত সমিতি দিয়ে কী হবে?

সিনেমা ও প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা কমে গেছে—এমন বাস্তবতায়ও চলচ্চিত্রের মানুষেরা সবাই সমিতি, ভোট, আন্দোলনে ব্যস্ত।কোলাজ

সিনেমা নয়, সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়েই এফডিসিতে চলছে যত মাতামাতি। সিনেমা ও প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে, কমেছে এই খাতে বিনিয়োগকারী। এ রকম বাস্তবতায় চলচ্চিত্রের মানুষেরা সবাই যেন সমিতি নিয়ে ব্যস্ত। ফলে সাধারণের কাছে ভাবমূর্তি হারাচ্ছেন তাঁরা। বেশির ভাগের বক্তব্য, চলচ্চিত্রই যদি না থাকে, এত সমিতি দিয়ে কী হবে?সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনের পর বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নির্বাচন ঘিরে তাঁদের মধ্যকার বিভক্তি পৌঁছে গেছে চরম পর্যায়ে। একের বিরুদ্ধে অন্যের অভিযোগ, বিষোদ্‌গারে সাধারণ মানুষ বিরক্ত। ফেসবুক–ইউটিউবে সমিতিগুলোর বিভিন্ন সংবাদের নিচে মন্তব্য পড়লেই সেটা বোঝা যায়। অথচ রাজ্জাক, আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চন, মাহমুদ কলি, রুবেল, মান্না, শাকিব খানসহ অনেকেই শিল্পী সমিতির নেতৃত্বে ছিলেন। তখন কে ছিলেন সভাপতি আর কে সাধারণ সম্পাদক বা সদস্য, তা নিয়ে ভক্তদের কোনো আগ্রহই ছিল না। কারণ, শিল্পীদের কাছে সাধারণ মানুষ চান হৃদয়স্পর্শী সিনেমা।

গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জ্যেষ্ঠ পরিচালক কাজী হায়াৎ প্রথম আলোকে বলেন, ছবি বানাতে কখনোই কোনো সমিতির প্রয়োজন হয় না। ছবি বানাতে দরকার পরিচালক আর ফাইন্যান্সার। সমিতি নিয়ে নানা অস্থিরতায় চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ফাইন্যান্সাররা। যাঁরা কিছু লগ্নি করতে আসবেন, তাঁরা ভাববেন, এ রকম নোংরা পরিবেশে কেন ইনভেস্ট করব? একই সঙ্গে শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজক থেকে শুরু করে কলাকুশলীদের ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।এখন সিনেমার কাজ কমে গেছে বলেই শিল্পীরা সমিতি নিয়ে মেতে থাকেন বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী ও পরিচালক সুচন্দা। তিনি বলেন, 'এফডিসিতে চলচ্চিত্র নির্মিত হবে। এখানে কাজ করেন সৃষ্টিশীল মানুষেরা। তাঁদের কাজ দেখে দেশ-বিদেশের মানুষ দেশীয় কৃষ্টি-কালচার সম্পর্কে জানবেন আর চলচ্চিত্রের মানুষদের শ্রদ্ধা করবেন। কিন্তু এখন হচ্ছে এর বিপরীত। এখানে কেন দলাদলি, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, কাদা–ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটবে। আমি বলব, দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই মাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনার সময় এখনো আছে।' বরেণ্য অভিনেত্রী ববিতার মতে, চলচ্চিত্রের উন্নয়নে যে এফডিসি, সেখানে নেই চলচ্চিত্রের কাজ। এফডিসিতে এত সমিতি, তাতে লাভ কী? চলচ্চিত্রই যদি না থাকে, এত সমিতি দিয়ে কী হবে?

এফডিসিতে সমিতি প্রসঙ্গে চিত্রনায়ক ও প্রযোজক আলমগীরের বক্তব্য হচ্ছে, 'শিল্পীদের কার ছবির সংখ্যা কত বেশি, কে কত বেশি কাজ পাব, সেদিকে নজর না দিয়ে আমরা অন্যদিকে বেশি নজর দিচ্ছি।' সমিতির দুবারের সভাপতি শাকিব খান বলেন, সমিতি দিয়ে চলচ্চিত্রশিল্প টিকে থাকবে না। শিল্পীকে বাঁচতে হলে কিংবা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে টিকিয়ে রাখতে হলে ছবির কাজ নিয়ে ভাবতে হবে। মানসম্মত কাজ দিয়ে দর্শকের মন জয় করতে হবে। চিত্রনায়িকা চম্পা বলেন, 'সবাইকে সিনেমার কাজে মনোযোগী হতে অনুরোধ করব। শিল্পী বাঁচেন তাঁর শিল্পকর্ম দিয়ে।'কাজী হায়াৎ বলেন, 'চলচ্চিত্রে সমিতি কী জন্য, বিশেষ করে শিল্পী সমিতির কাজ কী, শিল্পী হিসেবে আমি আজও সেটা বুঝিনি। কেউ মরলে খাটিয়া ধরতে হবে, কেউ অসুস্থ হলে হাসপাতালে যেতে হবে, এ জন্য তো অনেকেই আছেন। পরীমনি আটক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি সমিতি তার সদস্যপদ কেড়ে নেয়, সেই সমিতি শিল্পীদের জন্য কতটা কার্যকর, সেটাই আমার প্রশ্ন।'

শিল্পী সমিতির নির্বাচন ঘিরে এফডিসিতে তৈরি হয়েছে অস্থিতিশীল পরিবেশ। নির্বাচনে পক্ষপাতের অভিযোগে এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অপসারণের দাবিতে একাধিকবার সমাবেশ করেছে চলচ্চিত্রের ১৭ সংগঠন। পুড়িয়েছে তাঁর কুশপুত্তলিকা। এসব ঘটনায় বিরক্ত ও বিব্রত এই অঙ্গনের অনেকেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে চলচ্চিত্রের একটি পক্ষ বলছে, এফডিসি থেকে যদি সব সমিতির অফিস তুলে দেওয়া যায়, তাহলে এসব মাতামাতি বন্ধ হয়ে যাবে। এফডিসিতে প্রযোজক, পরিচালক ও শিল্পীরা আসবেন শুটিং করতে। যাঁরা কাজ করবেন, কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাঁদের পাসের ব্যবস্থা করবে। কেপিআইভুক্ত একটি এলাকায় কেন এত সমিতি থাকবে, কেন তাদের নির্বাচন এখানে আয়োজন করতে হবে আর কেনই–বা তাদের কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে। সমিতিগুলো তুলে দিলেই এফডিসিতে আগের পরিবেশ ফিরে আসবে, তাতে এই অঙ্গনের কাজের মানুষেরাও নির্বিঘ্নে এখানে কাজ করতে পারবেন।