পরিচালকের স্ত্রীর গয়না বন্ধক দিতে হয়েছিল

১৯৮০ সালের ১৯ ডিসেম্বর মুক্তি পাওয়া ছবি ‘ঘুড্ডিছবি: কোলাজ

‘ঘুড্ডি’ মোহাব্বত আলী আর ঘুড্ডির গল্প হলেও এটি ঠিক প্রেমের ছবি নয়। মোহাব্বত মুক্তিযোদ্ধা। বেকার, অথচ বেকারত্ব তার প্রাণচাঞ্চল্যকে দমাতে পারেনি। অন্যদিকে ঘুড্ডি প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হওয়া মেয়ে, যে নিজেকে বন্দী হিসেবেই দেখতে পায় আর মোহাব্বতের ক্রমাগত মিথ্যা কথায় বিশ্বাস করে। বিপরীতমুখী এই দুই চরিত্রের প্রেমের ভেতরে ঢুকে পরিচালক তুলে ধরেন মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের একটি খণ্ডচিত্র।
১৯৮০ সালের ১৯ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে উত্তর-আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে মুক্তি পাওয়া ছবি ‘ঘুড্ডি’। সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকীর পরিচালনায় ছবিটির উদ্ভাবনী ও জটিল চলচ্চিত্র-কৌশল সেই সময় আলোচিত হয়েছিল, জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ছবিতে আবহসংগীতের দারুণ ব্যবহারও প্রশংসিত হয়। গতানুগতিক ছবির কাঠামো মেনে এ চলচ্চিত্রে রূপকের মাধ্যমে শক্তিশালী রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল। আজ ছবিটির ৪০ বছর পূর্ণ হয়েছে।

আজ ছবিটির ৪০ বছর পূর্ণ হয়েছে

‘এমন অভিনয়শিল্পী কি আর পাওয়া যাবে?’ ‘ঘুড্ডি’র অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শুরুতেই এমন মন্তব্য করেন পরিচালক সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী। এই ছবিতে অভিনয় করেছেন মুক্তিযোদ্ধা ও অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ।

নামভূমিকায় সুবর্ণা মুস্তাফা। ঘুড্ডিরূপী সুবর্ণাকে জীবন-নাটাইয়ে বাঁধতে গিয়েই এগিয়ে চলে আসাদের জীবন ও চলচ্চিত্রের মূল গল্প। ছবিতে আরও আছেন সৈয়দ হাসান ইমাম, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, তারিক আনাম খান, নায়লা আজাদ নূপুর প্রমুখ। ছবিতে মাঝির চরিত্রে গোলাম মুস্তাফা আর ঘুড্ডির বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুর চরিত্রে সংগীতশিল্পী হ্যাপী আখান্দ্ অভিনয় করেছেন। পর্দায় হ্যাপীকে গান গাইতেও দেখা যায়। লাকী আর হ্যাপী আখান্দের বিখ্যাত ‘আবার এল যে সন্ধ্যা’ গানটি এই ছবির।

ঘুড্ডির বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুর চরিত্রে সংগীতশিল্পী হ্যাপী আখান্দ্ অভিনয় করেছেন
ছবি:সংগৃহীত

ছবিটি মুক্তি দিতে বেশ সমস্যায় পড়েছিলেন পরিচালক। কেননা, বাণিজ্যিক ছবির বাজারে এ ছবির শিল্পীরা ছিলেন অপরিচিত। এ কারণে হলমালিকেরা নিতে চাননি ছবিটি। অথচ ছবিটি বানাতে গিয়ে সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকীর স্ত্রী গয়না বন্ধক দিয়েছিলেন তাঁতীবাজারের এক দোকানে। তবে এ নিয়ে মোটেও আক্ষেপ নেই পরিচালকের। তিনি বলেন, ‘মনের আনন্দে ছবিটি বানিয়েছিলাম। শিল্পীরা কেউ পারিশ্রমিক নেননি। কিছু সিনেমা হলে চললেও আমাদের অনভিজ্ঞতার কারণে ঠিকমতো টাকাও আসেনি। তবে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। যদিও একদল যেমন পিঠ চাপড়েছে, আরেক দল ফেলেও দিয়েছে “ঘুড্ডি”।’

এই ছবির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক এর সংলাপ। চলচ্চিত্র সমালোচকেরা অনেকে বলে থাকেন, সোনাকান্দা দুর্গে ও কক্সবাজারে আসাদ ও ঘুড্ডির মোহাচ্ছন্ন সংলাপ বিনিময় বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম সেরা সংলাপ। সে বছর ‘ঘুড্ডি’ সংলাপ, সম্পাদনা ও চিত্রগ্রহণে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।

র ‘ঘুড্ডি’ সংলাপ, সম্পাদনা ও চিত্রগ্রহণে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়
ছবি:সংগৃহীত

ছবিটিতে পরিচালকের ক্যামেরায় বারবার উঠে আসে ঢাকার রাস্তাঘাট, সরু গলি, বুয়েট ক্যাম্পাস, রেস্তোরাঁ, সিনেমা হল, পাঁচ তারকা হোটেল, সাভারের স্মৃতিসৌধ, পানামনগর, নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা দুর্গ, বুড়িগঙ্গা নদী। আফজাল হোসেন ছবির পোস্টার ডিজাইন করেছিলেন। চিত্র সমালোচকদের মতে, চাকচিক্য আর বিনোদনসর্বস্ব অগভীর চলচ্চিত্রের প্রতি পরিচালকের সমালোচনা আর বিরোধিতা ‘ঘুড্ডি’তে উঠে আসে বারবার। কখনো কখনো গতানুগতিক রোমান্টিক গল্পের আবহ লক্ষ করা গেলেও কিছু নির্দিষ্ট কৌশল ও বক্তব্য ব্যবহারের মধ্য দিয়ে পরিচালক শুধুই বিনোদন জোগানো চলচ্চিত্র থেকে ‘ঘুড্ডি’র ভিন্নতা প্রমাণিত হয়। আবার অনেকের মতে, গান ও আবহসংগীতের ব্যবহার, সাহসী সমালোচনা আর রাজনৈতিক বক্তব্য ছবিটিকে প্রথাবিরোধী এবং প্রতিবাদী করে তুলেছে।

পরিচালকের প্রতিবাদ প্রকাশিত হয়েছে একদিকে বাণিজ্যিক ছবির গতানুগতিকতা আর অগভীরতার প্রতি, অন্যদিকে সমাজে টিকে থাকা রাজনৈতিক সমস্যার বিরুদ্ধে। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য ‘ঘুড্ডি’ সফল একটি রাজনৈতিক সিনেমা হিসেবেও।

সুবর্ণা মুস্তাফা ও পরিচালক
ছবি:সংগৃহীত

গতকাল শুক্রবার ঘুড্ডি, অর্থাৎ সুবর্ণা মুস্তাফাকে ৪০ বছর পূর্তির বিষয়টি মনে করিয়ে দিতেই তিনি বলেন, ‘তাই নাকি! “ঘুড্ডি” ছবিটা ৪০ বছর আগে তৈরি হলেও এর আবেদন আজও ফুরিয়ে যায়নি। আবার “এল যে সন্ধ্যা”, “কে বাঁশি বাজায় রে”, “ঘুম ঘুম ঘুম চোখে দেয় চুম” গানগুলো এখনো রিমেক হচ্ছে; পুরোনো তো আর হলো না। এটি একটি মাইলস্টোন সিনেমা। ট্রেন্ডসেটার সিনেমা। আমার সব সময় মনে হয়, “ঘুড্ডি” সময়ের আগের ছবি। ছবিটি দেখলে ওই সময়ের ঢাকা, ওই সময়কার জীবন দেখতে পাই। এই ছবিতে অতিরঞ্জিত কিছুই নেই। তখনকার তরুণ-তরুণীরা এমনই ছিল।’

‘ঘুড্ডি’ ছবির আগে রাইসুল ইসলাম আসাদ অভিনয় করেছিলেন ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবিতে। ৪০ বছর আগে মুক্তি পাওয়া এই ছবির প্রসঙ্গ উঠতেই আসাদ জানান, এই ছবিতে তাঁর অভিনয়ের কথাই ছিল না। তিনি ছিলেন ছবির পরিচালক সালাউদ্দিন জাকীর সহকারী। প্রথম আলোর সঙ্গে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যার আলাপে রাইসুল ইসলাম আসাদ বলেন, ‘আমি ছিলাম ছয় কি সাত নম্বর অ্যাসিস্ট্যান্ট। ইউনিটের সঙ্গে গেছি শুটিং করতে। শুটিং করার কথা ছিল ধানমন্ডিতে, সেই শুটিংয়ের গাড়ি চলে গেল নারায়ণগঞ্জে। সেখান থেকে শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে সোনাকান্দা বন্দরে গিয়ে পরিচালক বললেন, “তুমি আর সুবর্ণা এখান থেকে হেঁটে চলে যাও! ” এটাই হচ্ছে ছবির প্রথম শট। আমি বললাম, মানে কী!’

‘ঘুড্ডি’কে তৎকালীন গতানুগতিক ঢাকাই ছবি থেকে ব্যতিক্রমী সফল আয়োজন বলে মনে করেন চলচ্চিত্র সমালোচকেরা
ছবি:সংগৃহীত

‘ঘুড্ডি’ ছবিতে ঢাকা শহরের সমসাময়িক পরিবেশ যতটা সরাসরি এবং বাস্তবসম্মতভাবে উঠে এসেছে, সেই সময়ে নির্মিত অন্য কোনো ছবিতে রাজধানী ঢাকা এমনভাবে আলাদা একটি ‘চরিত্র’ হিসেবে উঠে আসেনি। কাহিনি, নির্মাণপদ্ধতি, রাজনৈতিক বক্তব্য-সবদিক থেকে ‘ঘুড্ডি’কে তৎকালীন গতানুগতিক ঢাকাই ছবি থেকে ব্যতিক্রমী সফল আয়োজন বলে মনে করেন চলচ্চিত্র সমালোচকেরা।