রওশন জামিল এখনো প্রাসঙ্গিক

ফেসবুক

পঞ্চাশের দশকে মেয়েদের সংস্কৃতিচর্চার কথা ভাবতেই পারত না পরিবার। সামাজিক নানা বাধা তো ছিলই। সেসব ভেঙে পর্দায় এসেছিলেন রওশন জামিল। দেশে প্রথম যাঁরা নাচ শুরু করেছিলেন, রওশন জামিল তাঁদের অন্যতম। পরে শুরু করেন টেলিভিশন নাটকে অভিনয়। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে সফল এই অভিনেত্রী নারীদের সচেতন করতে এগিয়ে এসেছেন। আজ এই অভিনেত্রীর জন্মদিন। ১৯৩১ সালের এই দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

শৈশব থেকেই নাচ–গান ভালোবাসতেন রওশন জামিল। ঘর থেকেই শুরু করেছিলেন তিনি। পরে নাচ দিয়েই শুরু হয় তাঁর চর্চা। গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় শুরু করেন তিনি। পরে যুক্ত হন চলচ্চিত্রে। নিয়মিত শুটিং করতে গিয়ে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা বাড়তে থাকে বলে অভিনয় শিখতে থাকেন। একপর্যায়ে বুঝে নেন, এটাই তাঁর নিজের জায়গা। তবে নাচটাও চালিয়ে যান।

রওশন জামিল জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেওয়া’ ছবিতে অভিনয় করেন ১৯৭০ সালে। এই সিনেমা তাঁকে দেয় বিপুল পরিচিতি। তারপর এ অঙ্গনে বাড়তে থাকে তাঁর গুরুত্ব। পরে তিনি ঋত্বিক কুমার ঘটক, শেখ নিয়ামত আলী, আমজাদ হোসেনের মতো নির্মাতাদের ছবিতেও অভিনয় করেন।

শৈশব থেকেই নাচ–গান ভালোবাসতেন রওশন জামিল
ছবি: সংগৃহীত

রওশন জামিলের দুই ছেলে এবং তিন মেয়ে। সম্প্রতি বড় ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছেন। সেখানে আছেন তাঁর আরও এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে চাকরি করেন, মেয়ে নাচের স্কুলের শিক্ষক। দুই মেয়ে থাকেন ঢাকায়। ছোট মেয়ে কঙ্কা জামিল সম্প্রতি বাংলাদেশ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং সেন্টার (বিপিএটিসি) থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে জানান, জন্মদিন নিয়ে তাঁর মায়ের তেমন আগ্রহ কখনোই ছিল না। শৈশবে তাঁরা ভাই–বোনেরা মিলে চাঁদা তুলে মায়ের জন্য উপহার কিনতেন। যত দিন মা বেঁচে ছিলেন, তত দিন তাঁরা চেষ্টা করতেন মায়ের সঙ্গে দিনটি কাটাতে। মায়ের পছন্দের উপহার দিতেন। এখন তাঁরা ছাড়া অন্য কেউ তাঁদের মাকে সেভাবে স্মরণ করেন না বলে একটু কষ্টও পান তাঁরা। তিনি বলেন, ‘চলচ্চিত্রের মানুষেরা মাকে হয়তো ভুল গেছেন। সেভাবে কখনো স্মরণ করতে দেখিনি। ভক্তরা মাকে এখনো মনে রেখেছেন, স্মরণ করে—এটাই শান্তি দেয়।’ তিনি আরও জানালেন, করোনার কারণে এ দুই বছর মায়ের জন্মদিনে তেমন কিছু করা হয়নি। তবে ঘরোয়াভাবে মাকে স্মরণ করেছেন তাঁরা।

রওশন জামিলের চরিত্রগুলো ছিল সমাজের চেনা
ছবি: সংগৃহীত

রওশন জামিলের চরিত্রগুলো ছিল সমাজের চেনা। বাঙালি পরিবারের ‘কুটিল’ চরিত্রেই তাঁকে দেখা যেত। পাশাপাশি ইতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করেও দর্শকদের ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি অভিনয় করেছেন প্রায় ৩০০ ছবিতে। ‘নয়নমণি’ ও ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’ ছবি দুটিতে অভিনয়ের জন্য পার্শ্বচরিত্রের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এ ছাড়া তিনি পেয়েছেন একুশে পদক, বাচসাসসহ নানা পুরস্কার। শেষ জীবনে ভালো একটি চরিত্রের জন্য খুব আফসোস ছিল তাঁর। অবশ্য তিনি আবারও নাচের চর্চা শুরু করেন। কঙ্কা জামিল জানান, শুটিং না থাকলেও তাঁদের মা সংস্কৃতিচর্চায় ডুবে থাকতেন। মায়ের কারণেই একটি সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠেছেন তাঁরা।

একটি সিনেমার দৃশ্যে রওশন জামিল ও রোজি আফসারি
ছবি: সংগৃহীত

রওশন জামিলের পরিবারের সদস্যরা এখনো সেই আবহ ধরে রেখেছেন। মেয়েরা বাড়িতে নাচ–গান করেন। নাতি–নাতনিরা তবলা বাজাতে পারেন। কঙ্কা করেন গান। তিনি বলেন, ‘আম্মার জন্য আমরা এখনো বিভিন্ন জায়গায় অনেক সম্মান পাই। তিনি অনেক সাহসী ছিলেন। নারী জাগরণের অন্যতম দিশারি ছিলেন মা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, একজন ভালো মানুষ হওয়ার জন্য সংস্কৃতিচর্চা কতটা জরুরি। তরুণ বয়সে মা অন্যদের বাড়িতে গিয়ে নারীশিক্ষা ও তাঁদের সাংস্কৃতিকভাবে সচেতন হতে বলতেন। এ কারণে অনেক সময় বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁকে। তারপরও মা চাইতেন, নারীরা এগিয়ে যাক। এ কারণে নারী অধিকারকর্মীরা মাকে সম্মান করতেন। এগুলো এখনো আমাদের উৎসাহিত করে।’

চলচ্চিত্রে তাঁর করা খল চরিত্রগুলোর ধারা এখনো বহমান। তাঁর অভিনয় এতটাই বাস্তব ছিল যে, বিভিন্ন সময় রাস্তাঘাটে দর্শকেরা তাঁর ওপর চড়াও হতেন। পরে তাঁদের বুঝিয়ে রক্ষা পেতেন যে তিনি তো পরিচালকের কথামতো অভিনয় করতেন! বাস্তব জীবনে রওশন জামিল ছিলেন মিশুক ও সাদামনের মানুষ। তিনি হাসিমুখে সবার সঙ্গে মিশতেন। এই অভিনেত্রীর উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’, ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’, ‘নয়নমণি’, ‘জননী’, ‘মাটির ঘর’সহ অনেক সিনেমা। রওশন জামিল ২০০২ সালের ১৪ মে মারা যান। চার দশকের ক্যারিয়ারে এখনো তিনি সিনেমাপ্রেমীদের কাছে অমর হয়ে আছেন।

জীবন থেকে নেয়া ছবিতে অভিনয় করেছেন খান আতাউর রহমান ও রওশন জামিল
ছবি: সংগৃহীত