রঙিলা শিল্পীদের বিবর্ণ জীবন

চরম আর্থিক সংকটে পড়ে রূপসজ্জাশিল্পীদের অনেকেই পেশা পরিবর্তন করছেন।কোলাজ : আমিনুল ইসলাম

‘চক্ষুলজ্জায় কারও কাছে হাত পাততে পারি না। সাহায্য চাইতে আত্মসম্মানেও লাগে। জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি। পরিবার আছে, ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে। কাজ করেই তাদের মুখে খাবার তুলে দিতে চাই। কিন্তু করোনায় সিনেমা বানানোই তো কমে গেছে, তার সঙ্গে কমে গেছে আমাদের কাজ,’ দুঃখ করে বলছিলেন শামসুল ইসলাম। চার দশক কত তারকার মুখকেই না সুন্দর করেছেন এই রূপসজ্জাশিল্পী! করোনায় তাঁর মতো অনেক রূপসজ্জাশিল্পীর অবস্থাই এখন শোচনীয়। বেশির ভাগ রঙিলা শিল্পীর জীবন এখন বিবর্ণ, পরিবার নিয়ে তাঁরা পার করছেন সংকটময় দিন।

পূজা চেরীকে সাজিয়ে দিচ্ছেন রূপসজ্জাশিল্পী মনির
ছবি : সংগৃহীত

তাঁদের কেউ  ববিতা, শাবানা, কবরী, রাজ্জাক, ফারুক, আলমগীর, উজ্জল, ওয়াসিম, রোজিনা, সুচরিতাকে সাজিয়েছেন। কেউ চম্পা, দিতি, সালমান শাহ, শাবনূর, মৌসুমী, পপি বা পূর্ণিমাকে। কেউ কেউ সাজান শাকিব খান, অপু বিশ্বাস, মাহিয়া মাহি, পরীমনি, বুবলী, ইমন, নিরব, সিয়াম, রোশান আর পূজাদের। কেউই ভাবেননি, জীবনে কখনো এমন দিন আসবে, কাজ থাকবে না, বাড়িভাড়া দিতে পারবেন না! তাঁদের কাউকে কাউকে চলে যেতে হয়েছে গ্রামে। এমন সংকটেও কারও কাছে সাহায্য চাইতে পারেননি তাঁরা। দর্শকের ভালোবাসার নায়ক-নায়িকাকে যাঁরা সাজিয়েছেন এতকাল, তাঁদের জীবন এমন বিবর্ণ হবে—কেই–বা ভেবেছিল!

রূপসজ্জাশিল্পী ইমরান সাজিয়ে দিচ্ছেন চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহিকে
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকায় রূপসজ্জাশিল্পীদের একটা সংগঠন আছে, বাংলাদেশ ফিল্ম মেকআপ আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন। তাদের হিসাব বলছে, চলচ্চিত্রে কাজ করেন ৬২ জন রূপসজ্জাশিল্পী। সহকারীর হিসাব ধরলে এ সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। গত বছর করোনার প্রকোপ বাড়লে শুরু হয় লকডাউন। বন্ধ হয়ে যায় সিনেমার শুটিং, প্রেক্ষাগৃহ। বিপাকে পড়েন চলচ্চিত্রের স্বল্প আয়ের শিল্পী-কলাকুশলীরা। কেননা তাঁদের বেশির ভাগেরই অবস্থা অনেকটা দিন আনি দিন খাই। হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পী সচ্ছল, বাকিদের অবস্থা শোচনীয়। যাঁদের কিছু সঞ্চয় ছিল, ১৫ মাসে তা–ও শেষ। সংগঠনটির সভাপতি শামসুল ইসলাম জানান, ৯০ শতাংশ রূপসজ্জাশিল্পীর হাতে কাজ নেই। অভিনয়শিল্পীদের অনেকে ব্যক্তিগতভাবে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।

রূপসজ্জাশিল্পী শামসুল ইসলাম চুলের সাজ ঠিক করছেন চিত্রনায়িকা পরীমনির
ছবি: সংগৃহীত

কেউ কেউ আবার পেশা বদলেছেন, কেউবা বদলের সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলেছেন। ৪০ বছর ধরে এ পেশায় আছেন, এখন অন্য কিছু তাঁরা কীভাবে ভাবতে পারেন? বাংলাদেশ ফিল্ম মেকআপ আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী বাবুল এ পেশায় আছেন ৪০ বছর। গেরিলা ও মৃত্তিকা মায়ার জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন দুবার। পেশাগত জীবনে শ খানেক চলচ্চিত্র, কয়েক শ নাটক ও টেলিছবির শিল্পীকে সাজিয়েছেন তিনি। বাবুল বলেন, ‘করোনার আগে মাসে ১০-১২ দিন, এমনকি ১৫ দিনও কাজ করতাম। এখন করি সর্বোচ্চ চার-পাঁচ দিন। আয় কমেছে, খরচ তো আর কমেনি। বাসাভাড়া দিতে হিমশিম খেতে হয়। আমার বাড়িওয়ালা অবশ্য মেনে নেন। কিন্তু অনেকে ফোন করে জানায়, ঠিকমতো তারা খেতেও পারছে না।’

অভিনয়শিল্পী তারিক আনাম খানকে মেকআপ দিচ্ছেন জ্যেষ্ঠ রূপসজ্জাশিল্পী মোহাম্মদ আলী বাবুল
ছবি: সংগৃহীত

আয় কমে যাওয়ায় ঢাকা ছেড়ে পরিবার নিয়ে কয়েক মাস গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরে ছিলেন সেলিম মোহাম্মদ। কাজের ডাক পেলে ঢাকায় আসতেন। ৩৭ বছরের কর্মজীবনে রাজ্জাক থেকে অপু বিশ্বাস—অনেক শিল্পীকেই সাজিয়েছেন তিনি। সেলিম বলেন, ‘সংসার খরচ মাসে ৩৫–৪০ হাজার। করোনার আগে আয় হতো ৭০–৮০ হাজার। এখন ২০ হাজার টাকা আয় করতেও কষ্ট হচ্ছে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিল্পী জানালেন, তাঁরা গ্রামে নতুন কাজ করছেন।

প্রেম প্রীতির বন্ধন ছবিতে অপু বিশ্বাসকে সাজিয়ে দিচ্ছেন রূপসজ্জাশিল্পী সেলিম মোহাম্মদ
ছবি : সংগৃহীত

চলচ্চিত্রে ১৭ বছর কাজ করছেন সবুজ খান। শাকিব খানের সঙ্গে কাজ করেন তিনি। তাঁর তত্ত্বাবধানে কাজ করেন আরও ১৩ রূপসজ্জাশিল্পী। করোনার প্রথম ধাক্কায় সবাই বেকার ছিলেন। চার মাসের বেশি বাসায় বসে ছিলেন। সিনেমার কাজ ছিল না বলে বিয়ের কনে সাজানোর কাজও করতে হয়েছে তাঁকে।

সম্প্রতি টুকটাক কাজ শুরু হয়েছে। আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছেন তাঁরা, হয়তো শিগগিরই আসবে আগের মতো কর্মমুখর দিন।

‘অন্তরাত্মা’ সিনেমার শুটিংয়ে শাকিব খানকে সাজিয়ে দিচ্ছেন রূপসজ্জাশিল্পী সবুজ
ছবি : সংগৃহীত