শিল্পীর মন বুঝতে পারতেন আমজাদ হোসেন

বরেণ্য পরিচালক আমজাদ হোসেনের ছবিতে অভিনয় করেছেন ফারুক, ববিতা, ফেরদৌস ও মৌসুমীকোলাজ–আমিনুল ইসলাম

মানিকগঞ্জের নদীতীরবর্তী এক গ্রামে গোলাপী এখন ট্রেনে সিনেমার শুটিং। সেখানে সারা দিন অপেক্ষায় ববিতা। অন্য শিল্পীরা শুটিংয়ে অংশগ্রহণ করলেও ববিতার ডাক আসে না। যখন ডাক আসে, তখন রাত দুইটা। কনকনে শীতের মধ্যে ওই রাতে আনন্দচিত্তেই সংলাপ দিতে দাঁড়িয়েছিলেন ববিতা। কারণ, ছবির পরিচালক আমজাদ হোসেন।

দেশের বাইরের একটি চলচ্চিত্র উৎসবে আমজাদ হোসেনের সঙ্গে ববিতা
ছবি– ববিতার সৌজন্যে

বরেণ্য এই পরিচালক মারা গেছেন আজকের এই দিনে, ২০১৮ সালে। অসাধারণ সব চলচ্চিত্র উপহার দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে করে গেছেন সমৃদ্ধ। মৃত্যুদিনে আমজাদ হোসেন উঠে এলেন তাঁর তৈরি চরিত্র নয়ন, মনি, গোলাপীদের স্মৃতিচারণায়। কথা বললেন ফারুক, ববিতা, মৌসুমী ও ফেরদৌস।
নায়ক ফারুকের দৃষ্টিতে পরিচালক হিসেবে আমজাদ হোসেন সেরা। তিনি জানান, তিনি মাটি ও মানুষের কথা বলতেন তাঁর ছবিতে। ছিলেন রাজনীতি সচেতন। আর এ বিষয়গুলো তাঁর চলচ্চিত্রে উঠে আসত সুনিপুণভাবে।

আকবর হোসেন পাঠান ফারুক
সংগৃহীত

‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘নয়নমনি’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, ‘বড় বাড়ির মেয়ে’ ছবির কথা তুলে ববিতা বলেন, ‘আমজাদ হোসেন বাংলাদেশে একজনই। তাঁর অনেক ছবিতে অভিনয় করেছি। তাঁর অনেক ছবি মাইলস্টোন হয়ে আছে। গ্রামবাংলাকে তিনি ছবির মাধ্যমে সবার কাছে তুলে ধরেছেন।’
আমজাদ হোসেনের কাজের ধারা ববিতার ভাষায় ‘অদ্ভুত সুন্দর’। তাঁর ছবিতে যে শিল্পীরা কাজ করতেন, সবাই বেশ তৃপ্তি পেতেন। তিনি বলেন, ‘এমন হতো, একটি দৃশ্যের শুটিং হবে। সকাল থেকে বসে আছি। সন্ধ্যায় তিনি তা ধারণ করলেন। আমরা মোটেও বিরক্ত হতাম না। তবে কোনো কিছু তিনি চাপিয়েও দিতেন না।’

ববিতা
ছবি – প্রথম আলো

ববিতা জানান, শুটিংয়ের আগে খুব একটা তিনি স্ক্রিপ্ট দিতেন না। একটা ধারণা দিয়ে রাখতেন। কখনো শুটিং স্পটেও সংলাপ বদলে যেত। ববিতা বলেন, ‘শুটিং স্পটে বসেও সংলাপ লিখতেন। আমরা চা খাচ্ছি, আড্ডা দিচ্ছি। তাকিয়ে দেখছি, মনোযোগ দিয়ে আমজাদ ভাই লিখছেন।’

‘গোলাপী এখন বিলাতে’ ছবির শুটিংয়ের জন্য আমজাদ হোসেন মৌসুমীকে এক দিনের শুটিংয়ের কথা বলে নিয়ে গিয়েছিলেন কমলাপুর রেলস্টেশনে। সেই ট্রেন গাজীপুর হয়ে কখন ময়মনসিংহ চলে যায় টের পাননি মৌসুমী। শুটিং করতে লেগে গিয়েছিল চার দিন। আমজাদ হোসেনের পরিচালনায় আদরের সন্তান ও গোলাপী এখন বিলাতে ছবিতে অভিনয় করেছেন মৌসুমী।

মৌসুমী
প্রথম আলো।

তিনি বলেন, ‘আমজাদ হোসেন আমাদের চেয়ে অনেক বড়। ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ হয়নি। এরপরও বন্ধুত্বসুলভ ব্যবহার করতেন। কাজের ক্ষেত্রে দূরদর্শিতা তাঁর লেখার মতোই ছিল। একবার গোলাপী এখন বিলাতে ছবির শুটিং করার সিদ্ধান্ত হয় কমলাপুর রেলস্টেশনে। আমি স্টেশনে না গিয়ে কীভাবে কাজটি করা যায়, সে চিন্তা করছিলাম। কিন্তু আমজাদ ভাই এমনভাবে বলেন যে আর না করতে পারিনি। তবে মোটেও জোর করেননি। ধমকও দিতেন না। শিল্পীর মন বুঝতে পারতেন। কমলাপুর রেলস্টেশনে মেইল ট্রেনে আমাদের শুটিং শুরু হয়। ক্যামেরাম্যান জেড এইচ মিন্টু ভাই আমার গাড়িটি ময়মনসিংহ নিয়ে আসতে বলেছিলেন। এক দিনের শুটিং চার দিনে শেষ হয়েছিল। এরপরে ঢাকায় ফিরি।’

ফেরদৌস
ছবি – প্রথম আলো

অভিনেতা ফেরদৌস আমজাদ হোসনকে তুলনা করলেন একটি ইনস্টিটিউটের সঙ্গে। ‘প্রাণের মানুষ’, ‘কাল সকালে’ ও ‘গোলাপী এখন বিলাতে’—এই তিন ছবিতে ফেরদৌস অভিনয় করেছিলেন তাঁর পরিচালনায়। ফেরদৌস বলেন, ‘অভিনয়ের অনেক সূক্ষ্ম কাজ তিন বুঝিয়ে দিতেন। যেমন চোখের কাজ, নিশ্বাস নেওয়া, সাইলেন্স এক্সপ্রেশন দেওয়া এবং কথা বলতে বলতে কীভাবে গ্লিসারিন ছাড়াই চোখে পানি আনা যায় ইত্যাদি। এগুলো অভিনয়শিল্পীর ভেতরে ট্রান্সফর্ম করে দিতে পারতেন। কিছুই চাপিয়ে দিতেন না।’
সেই দিনগুলোতে বাংলা চলচ্চিত্র পেয়েছিল চমৎকার সব গান। ফেরদৌস বলেন, ‘সুরকার ও সংগীত পরিচালক আলাউদ্দীন আলীর সঙ্গে আমজাদ হোসেন কী চমৎকারভাবে গান তৈরি করার কাজটি করতেন, তা দেখতাম আর অবাক হতাম।’

আমজাদ হোসেন

বয়সে অনেক বড় হলেও ভীষণ বন্ধুত্বসুলভ ছিলেন আমজাদ হোসেন। ফেরদৌস বলেন, ‘কক্সবাজারে শুটিং করছি। হঠাৎ তিনি বলেন, “জ্যোৎস্না রাতে আজকে সবাই সমুদ্রে ডিনার করব।” সত্যি সত্যি তা–ই করলেন। সেদিন শুটিংয়ের ফাঁকে সমুদ্রের পাড়ে বালির মধ্যে চাদর বিছিয়ে আমরা রাতের খাবার খেয়েছিলাম।’