সাধন রায়কে নিয়ে দুর্লভ চলচ্চিত্র ‘গোধূলি’ ফিল্ম আর্কাইভে

পুরস্কার ছবির শুটিং এ সাধন রায় সহ অন্যান্য কলাকুশলী। ছবি: সংগৃহীত

আশির দশকের শেষ দিকে চিত্রগ্রাহক সাধন রায়কে নিয়ে জীবনীভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘গোধূলি’ নির্মিত হয়। তাঁর জীবনসংগ্রাম নিয়ে নির্মিত ৩২ মিনিট ১৫ সেকেন্ডের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন নির্মাতা পি এ কাজল। ১৯৯১ সালে এটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে সংরক্ষিত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের চলচ্চিত্র কর্মকর্তা ফখরুল আলম ছবিটি সংগ্রহ করেন পি এ কাজলের ভাগনি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা প্রিয়াঙ্কা আচার্যের কাছ থেকে।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, টেলিফোন অফিস ধ্বংস, সশস্ত্র পুলিশ লাইন দখল, ব্রিটিশ প্রশাসন অচল করা ও ব্রিটিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় ব্রিটিশ পুলিশ সাধন রায়কে গ্রেপ্তার করেছিল।

চাচা ক্ষীরোদ চন্দ্র চট্টগ্রামের এমএলএ থাকায় জামিনে ছাড়িয়ে এনে তাঁকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। সেখানে ২০ টাকা বেতনে ফিল্ম করপোরেশন অব ইন্ডিয়ায় পরিচালক রণজিৎ সেনের ‘আশা’ ছবির মাধ্যমে বিপ্লবী সাধন রায়ের ক্যামেরায় প্রথম হাতেখড়ি।

সাধন রায়
ছবি: সংগৃহীত

১৯৪০ সালে প্রমথেশ বড়ুয়ার সহকারী ক্যামেরাম্যান হিসেবে ‘শাপমুক্তি’, ‘শেষ উত্তর’, ‘জবাব’, ‘মায়ের প্রাণ’, ‘উত্তরায়ণ’ ছবিতে কাজ করেন। এ ছাড়া সুশীল মজুমদার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অগ্রদূতসহ উল্লেখযোগ্য পরিচালকের ছবিতে কাজ করেন। প্রমথেশ বড়ুয়ার ইউনিটের বাইরেও সুশীল মজুমদারের ‘রিক্তা’, ‘তটিনীর বিচার’, ‘প্রতিশোধ’, ‘হাসপাতাল’ ছবিতে কাজ করেন। ১৯৫২ সালে ঢাকায় কো-অপারেটিভ ফিল্ম মেকারসের এক সংগঠকের অনুরোধে ‘আপ্যায়ন’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্রের কাজে ঢাকায় এসে কাজ না হওয়ায় কলকাতায় ফিরে যান।

১৯৫৭ সালে ইপিএফডিসি প্রতিষ্ঠা হলে পুনরায় ঢাকা এসে লন্ডনের ফটোগ্রাফার ওয়াল্টার ল্যাসালির সহযোগী ফটোগ্রাফার হিসেবে এ জে কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ ছবির কাজ শুরু করেন।

১৯৪১ সালে শেষ উত্তর ছবির মহরতে চিত্রগ্রাহক সাধন রায়, প্রমথেশ বড়ুয়া ও অন্যান্য শিল্পী কলাকুশলী
ছবি: সংগৃহীত

এরপর ‘যে নদী মরুপথে’, ‘তোমার আমার’, ‘বিষকন্যা’, ‘গোধূলির প্রেম’, ‘সাত রং’, ‘পুনম কি রাত’, ‘নায়িকা’, ‘ইয়ে ভি এক কাহিনি’, ‘জলছবি’, ‘রাজা এল শহরে’, ‘অপরাজেয়’, ‘জিনা ভি মুশকিল’, ‘জংলি ফুল’, ‘পরশমণি’, ‘অপরিচিতা’, ‘আলোর পিপাসা’, ‘অন্তরঙ্গ’সহ বেশ কিছু ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের আগপর্যন্ত কাজ করেন।

স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আগরতলায় জহির রায়হানের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। বড় মেয়ের বাড়িতে থেকে জহির রায়হানের সঙ্গে তথ্যচিত্র ধারণের কাজে লেগে যান। স্বাধীনতার পরে দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি ‘রক্তাক্ত বাংলা’য় কাজ করেন। তারপর ‘এতিম’, ‘নদের চাঁদ’, ‘কে তুমি’, ‘যন্তর–মন্তর’, ‘দূর থেকে কাছে’, ‘পুরস্কার’, ‘মীমাংসা’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘উজান–ভাটি’, ‘বসুন্ধরা’, ‘তরুলতা’, ‘সাহেব’, ‘জীবন এল ফিরে’, ‘শুভরাত্রি’, ‘আমি কার’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘শুভদা’, ‘রঙিন রূপবান’সহ শতাধিক ছবিতে কাজ করেন। প্রিয় বন্ধু ফজলে হোসেনের সঙ্গে হোসেন অ্যান্ড রায় নামে যুগ্মভাবে কাজ করেন ‘দ্য রেইন’, ‘আদালত’, ‘বেদ্বীন’, ‘হাসি’, ‘রাজা–বাদশা’, ‘স্মৃতি তুমি বেদনা’, ‘কঙ্কর’, ‘অভিযোগ’, ‘ডার্লিং’, ‘বড় মা’, ‘লাল মেম সাহেব’ ছবিতে কাজ করেন।

নিজের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৬ সালে ‘শুভদা’ ছবিতে শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস, পরিচালক সমিতি, সিকোয়েন্স, হীরালাল সেন স্মৃতি সংসদ, সিডাব থেকে পুরস্কার পান।

প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে চিএগ্রাহক সাধন রায়।
ছবি: সংগৃহীত

জীবনের শেষ দিকে এসে সাধন রায় একাকী জীবন কাটাতেন শাঁখারীবাজারের ভাড়া করা একটি বাড়িতে। ১৯৮৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি প্রয়াত হন। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের চলচ্চিত্র কর্মকর্তা ফখরুল আলম জানান, পরিচালক চাষী নজরুল ইসলামকে পুত্রের মতো স্নেহ করতেন বলে সাধন রায়ের মৃত্যুর পরে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী চাষী নজরুল ইসলাম শেষকৃত্য সম্পাদন করেন। ফখরুল আলম বলেন, ‘সাধন রায়ের দেহাবসান হলেও এ দেশের চলচ্চিত্রের মানুষ তাঁকে মনে রাখবে কালের পর কাল, শতাব্দীর পর শতাব্দী। সাধন রায়কে নিয়ে ফিল্ম আর্কাইভে সংরক্ষিত “গোধূলি” স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি চলচ্চিত্রকর্মীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।’

পরিচালক পি এ কাজল
ছবি: সংগৃহীত

ফখরুল আলম জানান, ‘গোধূলি’ চলচ্চিত্রটিতে নামভূমিকায় কাজ করেছেন সাধন রায়, কেশব চট্টোপাধ্যায়, চাষী নজরুল ইসলাম, রওশন জামিলসহ প্রয়াত অনেক শিল্পী ও কলাকুশলী।