সাধুর চলে যাওয়ার এক বছর

হুমায়ূন সাধুসংগৃহীত
বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে পড়তেন। তাঁর ছিল বাংলা সিনেমা দেখার নেশা। সাধু অপেক্ষায় থাকতেন কবে বাড়ি ফিরবেন ভাইয়া।


হুমায়ূন সাধু চলে গেলেন। ঠিক এই দিনে। এক বছর আগে। একজন তরুণ নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে কেমন করে সংগ্রাম করেন, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন সাধু। শুরুটা হয়েছিল ছবিয়ালের হাত ধরে। নাটক নির্মাণ করলেও সাধুর ইচ্ছা ছিল বড় পর্দার নির্মাতা হওয়া। কিন্তু সে ইচ্ছাটা কেবল ‘ইচ্ছা’ই রয়ে গেল। সাধু মারা গেলেন। হারিয়ে গেলেন একজন স্বপ্নবান নির্মাতা।

হুমায়ূন সাধুরা ৯ ভাইবোন ছিলেন। তার মধ্যে ৭ নম্বরে ছিলেন সাধু। চট্টগ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। শৈশবেই সিনেমার সঙ্গে প্রেম সাধুর। কিন্তু সিনেমা হলে যাওয়ার খুব একটা সুযোগ ছিল না। তবে সিনেমা দেখার ক্ষুধা মেটাতেন বড় ভাইয়ের কাছ থেকে সিনেমা দেখার গল্প শুনে।

সাধু সিনেমা দেখার ক্ষুধা মেটাতেন বড় ভাইয়ের কাছ থেকে সিনেমা দেখার গল্প শুনে।
সংগৃহীত

বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে পড়তেন। তাঁর ছিল বাংলা সিনেমা দেখার নেশা। সাধু অপেক্ষায় থাকতেন কবে বাড়ি ফিরবেন ভাইয়া। বাড়িতে এলে তাঁর কাছ থেকে সিনেমার গল্প শোনাই ছিল সাধুর প্রথম কাজ। এভাবেই ‘ওরা এগারো জন’, ‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’, ‘চাঁদনী’সহ একাধিক ছবির গল্প ভাইয়ের কাছ থেকে শোনেন সাধু। এভাবেই সিনেমার সঙ্গে পরিচয় হয় ছোট্ট সাধুর। শৈশব পেরিয়ে বয়স যত বাড়ে, সাধুর প্রেম তত বাড়ে সিনেমার সঙ্গে।

চট্টগ্রামে সাধুর পরিচয় হয় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ছবির শুটিংয়ে নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে। ঢাকায় এসে একসময় কাজের সুযোগ হয়ে যায় জনপ্রিয় এই নির্মাতার সঙ্গে।

২০০১ সাল। সাধুর পরিবারে একটি বিপর্যয় ঘটে। সাধু চট্টগ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমান ঢাকায়। কিন্তু সাধুকে নিয়ে পরিবারের তেমন কোনো উচ্চাশা ছিল না। তাই সাধু হয়ে পড়েছিলেন একা। ঢাকায় এসে কিছুদিন তাঁকে থাকতে হয় রেলস্টেশনে, বাসস্টেশনে। কী করবেন তখনো বুঝে উঠতে পারছিলেন না সাধু।

তবে মনের মধ্যে সিনেমা নিয়ে যে আলোড়ন, তা সাধুকে তাড়িয়ে বেড়াত সারাক্ষণ। সাধু ধরনা দিতে থাকেন টেলিভিশন নাটকের নির্মাতাদের দ্বারে দ্বারে। চট্টগ্রামে সাধুর পরিচয় হয় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ছবির শুটিংয়ে নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে। ঢাকায় এসে একসময় কাজের সুযোগ হয়ে যায় জনপ্রিয় এই নির্মাতার সঙ্গে। সিনেমার গল্প শোনা সেই সাধু এবার নিজেই নাটকের গল্প বুনতে শুরু করেন।

ছবিয়াল পরিবারের সঙ্গে
সংগৃহীত

সাধুর নামের সঙ্গে তখন যুক্ত হলো ‘সহকারী পরিচালক’ পদবি। ফারুকীর সঙ্গে কাজ করেন, আর নিজের জীবনের নানা ঘটনা টুকে রাখেন কাগজে। একদিন দেখা যাবে এই টুকে রাখা গল্পই ‘ঊনমানুষ’ নামে নাটক হিসেবে তুমুল আলোড়ন তুলবে ছোট পর্দায়। আর সাধু নিজে তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতাকে ছোট পর্দায় নিয়ে আসবেন ‘চিকন পিনের চার্জার’ দিয়ে।

‘তারেক মাসুদের কথাগুলো আমি মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। তিনি বলতেন ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, মেক্সিকোসহ বিশ্ব চলচ্চিত্রের হালচাল। যদিও তাঁর প্রযুক্তি ও নির্মাণপ্রক্রিয়ার অনেক কথাই বুঝতাম না। তারপরও তারেক মাসুদ আমাকে নির্মাণের কথা জিজ্ঞাসা করলে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতাম, “জি ভাই, চলচ্চিত্র বানাতে চাই”।’

সাধুর একটি পরিবার চট্টগ্রামে। আর নতুন পরিবার হলো ঢাকায়—ছবিয়াল নামে। ছবিয়ালে সে সময় সাধুর সঙ্গে বেড়ে ওঠেন একদল তরুণ নির্মাতা। যাঁরা পরবর্তীকালে ছোট পর্দার বড় বড় নির্মাতা হয়ে ফুটে ওঠেন। আলি ফিদা একরাম তোজো, শরাফ আহমেদ জীবন, রেদওয়ান রনি, আশুতোষ সুজন, আশফাক নিপুণ, গোলাম কিবরিয়া ফারুকী, ইফতেখার আহমেদ ফাহমি, মোস্তফা কামাল রাজ, ইশতিয়াক আহমেদ রোমেল, আদনান আল রাজীব—এখন বিজ্ঞাপন ও ছোট পর্দা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এই তরুণ নির্মাতারা। হুমায়ূন সাধু খুব সহজেই এই দলের সঙ্গে মিশে গেলেন। তাঁদের সঙ্গে জমতে থাকে আড্ডা। সেই আড্ডার বিষয় থাকত, নাটক, সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও গান।

হুমায়ূন সাধু
সংগৃহীত

এখানেই সাধুর পরিচয় ঘটে দেশ–বিদেশের বিখ্যাত নির্মাতাদের বিখ্যাত সব ছবির সঙ্গে। কখনো সেই আড্ডায় হুট করেই দেখা মিলত প্রয়াত গুণী পরিচালক তারেক মাসুদের। তারেকের সাহচর্য সাধুকে দিত অন্য রকম প্রেরণা।

চার বছর আগে হুমায়ূন সাধু সেই স্মৃতিচারণা করে বলেছিলেন, ‘তারেক মাসুদের কথাগুলো আমি মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। তিনি বলতেন ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, মেক্সিকোসহ বিশ্ব চলচ্চিত্রের হালচাল। যদিও তাঁর প্রযুক্তি ও নির্মাণপ্রক্রিয়ার অনেক কথাই বুঝতাম না। তারপরও তারেক মাসুদ আমাকে নির্মাণের কথা জিজ্ঞাসা করলে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতাম, “জি ভাই, চলচ্চিত্র বানাতে চাই”।’

সাধু অভিনীত শেষ ছবি ‘বিউটি সার্কাস’ মুক্তির অপেক্ষায়।
জীবনের নানা বাঁকে সাধুকে কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অসাধারণ প্রাণবন্ত একজন মানুষ। মুখে হাসি লেগেই থাকত।

শুধু নির্মাণ নয়, অভিনেতা হিসেবেও নিজেকে মেলে ধরেছিলেন হুমায়ূন সাধু। ‘চোরাবালি’ সিনেমায় তাঁর অভিনয় এখনো চোখে লেগে আছে। চেয়েছিলেন বড় পর্দার নির্মাতা হবেন। কিন্তু ততটুকু অপেক্ষা করতে পারলেন না। রুপালি পর্দায় সাধু এলেন, তবে অভিনেতা হিসেবে। তাঁর অভিনীত শেষ ছবি ‘বিউটি সার্কাস’ মুক্তির অপেক্ষায়।
জীবনের নানা বাঁকে সাধুকে কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অসাধারণ প্রাণবন্ত একজন মানুষ। মুখে হাসি লেগেই থাকত।

হুমায়ূন সাধু
সংগৃহীত

নির্মাণপ্রিয় এই মানুষটা হঠাৎ একদিন নাটকের শুটিংয়েই অসুস্থ হয়ে পড়েন। গত বছরের ২ অক্টোবর পরিবারের লোকজন জানতে পারেন সাধু অসুস্থ। সাধুকে নিয়ে যাওয়ার হয় চট্টগ্রামে পরিবারের কাছে। ভর্তি করানো হয় হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা জানান, সাধুর রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। অবস্থা ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। সাধুকে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। রাজধানীর একটি হাসপাতালে তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি করানো হয়। ইতিমধ্যে জানা যায়, সাধুর স্ট্রোক হয়েছে। তাঁকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানেই মৃত্যু ঘটে একটি তরুণ স্বপ্নের। সাধুর ফেরা হয়নি। ফেরা হয়নি একজন স্বপ্নবান তরুণ নির্মাতা ও অভিনেতার।

প্রথম আলোর আমন্ত্রণে এসেছিলেন ছয় তরুণ নির্মাতা। বাঁ থেকে: জাহিন ফারুক আমিন, সৈয়দ আহমেদ শাওকী, তানভীর আহসান, হুমায়ূন সাধু, মিজানুর আরিয়ান ও কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়
খালেদ সরকার