সান্ত্বনা দিয়ে বলতাম, ‘তোমার কিসের অপ্রাপ্তি’

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমায় কবরী

আমি ছোটবেলা থেকেই কবরীর ভীষণ ভক্ত। স্কুল পালিয়ে তাঁর সিনেমা দেখতে যেতাম। ১৯৯৬ সালে আমি প্রথম তাঁর বাসায় যাই। তাঁকে সামনে থেকে দেখি। সে কী রোমাঞ্চ, কী ভালো লাগা!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আবেদন’ কবিতায় তিনি রানি আর আমি ভৃত্যের নৃত্যাভিনয় করি। সেই থেকে তাঁর সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। তাঁর ছেলে অঞ্জন আমার বন্ধু ছিল। সেটাও তিনি জেনেছেন অনেক পরে। অঞ্জন তাঁর মাকে বলেছিল, ‘শিবলী ভাই কিন্তু আমার অত্যন্ত কাছের মানুষ। আর খুব ভালো মানুষ।’ সেই থেকে তাঁকে আমি মাসি ডাকতাম। তিনি একবার নাচের অনুশীলন করতে আমাদের বাড়িতে এলেন। আমি তাঁকে আম্মার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে আম্মার সংগ্রামের ঘটনাগুলো তাঁকেও স্পর্শ করেছিল। তিনি আমার আম্মাকে আপা ডাকলেন। আম্মার সঙ্গে তাঁর ভীষণ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তারপর থেকে তিনি আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গেলেন। যখনই আম্মাকে দেখতে ইচ্ছা হতো, তিনি ছুটে আসতেন। আসার সময়, সব সময় একটা কিছু নিয়ে আসতেন। সে যত রাতই হোক!

শিবলী মহম্মদ ও সারাহ বেগম কবরী। ছবি: সংগৃহীত

আমরা দুজন জীবনের এমন কোনো ঘটনা নেই, যা পরস্পরের সঙ্গে বিনিময় করিনি। কেন করতাম? তিনি বলতেন, ‘শিবলী, তোকে আমার এত আপন লাগে কেন, এত বিশ্বস্ত লাগে কেন? আমি মন খুলে সব কথা যে তোকে বলি, আমার একবারও মনে হয় না, কেন বলছি!’ গত বছর রোজার ভেতরেও আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতাম। তিনি আমার জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে যাওয়া একটা মানুষ। মাসি আর আসবে না, মাসি আর আমাকে আদর করবে না, আবদার করবে না, আমার বেডরুমে বসে গুড় দিয়ে চিতই পিঠা খাবে না, ভাবতেই পারছি না।

কৃষ্ণের ভূমিকায় শিবলী মহম্মদ। ছবি: আবদুস সালাম

তাঁর জীবনে অনেক কষ্ট, অনেক একাকিত্ব, অনেক অপ্রাপ্তি। আমি তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতাম, ‘তোমার কিসের অপ্রাপ্তি! তুমি পাওনি এমন কী আছে? দেশের সব বয়সের, সব শ্রেণির মানুষ তোমাকে ভালোবাসে। তোমার না পাওয়ার কী আছে? কবরীকে পছন্দ করে না, এমন কে আছে? তোমার জনপ্রিয়তার সীমা নেই।’

কিছুদিন আগেও তিনি একবার এসেছিলেন। আমার মায়ের জন্য নিয়ে এসেছিলেন একটা সুদৃশ্য মগ। বাসার ছাদে বসে কত গল্প করলেন! যাওয়ার সময়ও দরজা ধরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন, যেন কথাই ফুরোচ্ছিল না। তারপর চলে গেলেন। সেই যে গেলেন, এবার একেবারেই চলে গেলেন।