তিন দশক আগে মুক্তি পাওয়া ‘চাঁদনী’ সিনেমা সে সময়ই ১৫ কোটি টাকার বেশি ব্যবসা করেছিল। অথচ ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি চলচ্চিত্রটি শুরুতে প্রেক্ষাগৃহমালিকেরা প্রদর্শন করতেও চাননি। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে আজ সোমবার বিকেলে এই তথ্য শেয়ার করেছেন অন্যতম অভিনয়শিল্পী নাঈম।
এহতেশাম পরিচালিত শাবনাজ ও নাঈম অভিনীত ‘চাঁদনী’ মুক্তি পায় ১৯৯১ সালের ৪ অক্টোবর। অজন্তা কথাচিত্রের ব্যানারে তৈরি এই চলচ্চিত্রের মহরত ও শুটিং শুরু হয়েছিল এফডিসির ২ নম্বর ফ্লোরে। নাঈম জানালেন, ঢাকা, গাজীপুরের আনসার একাডেমি ও সিলেটের গগন টিলা এলাকায় পুরো ছবিটির শুটিং শেষ হয়। তিনি বলেন, ‘সিলেটের শুটিংস্পটে আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানে ছিল না কোনো বিদ্যুৎ। হারিকেন জ্বালিয়ে আমরা দিন পার করেছি। দুটি রুমে কলাকুশলীসহ সবাই মিলে কষ্ট করে দুই সপ্তাহের মতো ছিলাম। তীব্র শীতের মধ্যে মেঝেতে ঘুমিয়ে থাকতে হয়েছে। আর কত ধরনের কষ্ট যে করতে হয়েছে, বলে বোঝানো যাবে না।’
‘চাঁদনী’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য নাঈম সম্মানী হিসেবে পেয়েছিলেন মাত্র ১০ হাজার টাকা এবং সিলেট থেকে ঢাকায় ফেরার একটি বিমান টিকিট। এই সিনেমার জন্য যত কস্টিউম—সবকিছু নাঈম নিজের টাকায় কিনেছেন। এহতেশাম পরিচালিত এই সিনেমার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে শুটিং ও প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পর্যন্ত দেড় বছরের বেশি সময় লেগে যায় বলে জানান নাঈম।
নাঈম বলেন, সবাই মিলেমিশে অনেক কষ্ট ও ভালোবাসা দিয়েই চলচ্চিত্রটির কাজ শেষ করেন তাঁরা। শুধু কী তাই, সিনেমা মুক্তির আগে নাঈম নিজে ঢাকার রাস্তায় পোস্টার লাগানোর কাজও করেছেন। কিন্তু সিনেমা মুক্তির সময় ভীষণ হতাশ হন। সে সময় সারা দেশে হাজারখানেক প্রেক্ষাগৃহ থাকলেও সে সময় সিনেমাটি মাত্র ২০টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়।
নাঈম বলেন, ‘আমরা দুজনই চলচ্চিত্রে নবাগত ছিলাম বলে “চাঁদনী” তখন কোনো হলমালিক চালাতে চাননি। তবে সাংবাদিকেরা তখন আমাদের নিয়ে এত লেখালেখি করেছিলেন যে সাধারণ মানুষের একটা আগ্রহ তৈরি হয়। ঢাকায় একমাত্র বলাকা ও মধুমিতা হলের মালিক সানন্দে আমাদের ছবিটি মুক্তি দেন। প্রথম দিনের প্রথম শোতে হাউসফুল। পুরো দিনটাই ওভাবেই কেটে যায়। পরদিন তো হলমালিকেরা বেঞ্চ ও আলাদা চেয়ার, এমনকি সিঁড়িতে বসিয়েও লোকজনকে ছবিটি দেখান। পরের সপ্তাহে সারা দেশে ছবিটি চালাতে বাধ্য হন সে সময়ের হলমালিকেরা। টানা পাঁচ মাস ছবিটি চলেছে, এমন কথাও শুনেছি।’
‘চাঁদনী’ বাম্পার হিট হলেও ব্যবসায়িকভাবে কত টাকা আয় করেছিল, তা জানতে পারেননি নাঈম ও শাবনাজ। পাঁচ বছর আগে ঢাকার গুলশানে ‘চাঁদনী’ সিনেমার রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠান করা হয়। সেদিন সেখানে দাওয়াত দেওয়া হয় অজন্তা কথাচিত্রের তৎকালীন ম্যানেজার ইসলামকেও। সেদিন চুপিচুপি নাঈম তাঁর কাছে জানতে চান, কত টাকা আয় করেছিল ‘চাঁদনী’। উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘১৫ কোটি টাকার হিসাব আমরা জানতে পেরেছি। এরপর আরও ব্যবসা করেছিল, যা আমার জানা ছিল না।’
‘চাঁদনী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ১৯৯১ সালে চলচ্চিত্রে শাবনাজের অভিষেক। তখন তিনি মিরপুর শাহ আলী স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছেন। শাবনাজকে নায়িকা হিসেবে পেতে সময় লাগলেও ‘চাঁদনী’ সিনেমার জন্য নাঈমকে আগেই চূড়ান্ত করে রেখেছিলেন এহতেশাম। শাবনাজ বললেন, ‘পুরান ঢাকায় আব্বার ফুফাতো বোনের গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আব্বার ফুফার খুব ভালো বন্ধু ছিলেন এহতেশাম সাহেব। বিয়ের চার মাস পর ওই অনুষ্ঠানেরই ভিডিওতে এহতেশাম সাহেব আমাকে দেখেন। পছন্দ করেন। তাঁর ছবির নায়িকা বানানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন। বাবাকে তিনি বললেন আমাকে “চাঁদনী” ছবির নায়িকা করতে চান। বাবা যেহেতু মঞ্চনাটকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তিনি না করলেন না।’
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েই জীবনের প্রথম সিনেমায় কাজ শুরু করেন শাবনাজ। প্রথম ছবি ‘চাঁদনী’ তাঁকে চলচ্চিত্রের ব্যস্ত তারকা বানিয়ে দেয়। প্রথম ছবিতে সম্মানী পেয়েছিলেন ৫০ হাজার টাকা। জনপ্রিয়তার কারণে দ্বিতীয় ছবিতেই সম্মানী বাড়িয়ে দেন ছয় গুণ। এদিকে প্রথম ছবির জনপ্রিয়তায় পরের বছরের পুরো সময়টা বুকিং করে নেন প্রযোজক-পরিচালকেরা।
২০টি ছবিতে জুটি হয়েছিলেন শাবনাজ-নাঈম। তার মধ্যে ‘জিদ’, ‘লাভ’, ‘চোখে চোখে’, ‘অনুতপ্ত’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সোনিয়া’, ‘টাকার অহংকার’, ‘সাক্ষাৎ’ ও ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’ ছবিগুলো এই প্রজন্মের কেউ কেউ হয়তো দেখে থাকবেন। নব্বই ও পরের দশকে এই ছবিগুলো ছিল ভীষণ জনপ্রিয়।