নাট্যকর্মীরা আগের মতো ঝুঁকি নিতে পারছেন না

সম্প্রতি বিস্তার আর্টস কমপ্লেক্সের আমন্ত্রণে চট্টগ্রামে এসেছিলেন নাট্যকার, নির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদ। চট্টগ্রামে তাঁর নির্দেশনায় ‘বিস্ময়কর সবকিছু’ নাটকের তিনটি প্রদর্শনী হয়েছে। নগরের শিল্পকলা একাডেমিতে প্রদর্শনীর শেষ দিন প্রথম আলোর মুখোমুখি হন তিনি। দেড় ঘণ্টার আলাপে উঠে আসে তাঁর নাটকের দর্শন, শিল্পভাবনা, সমকালের রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধের নানা প্রসঙ্গ। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আহমেদ মুনির

প্রশ্ন:

আপনার পিএইচডি গবেষণা ছিল এ দেশের লোকনাট্য ধারার ওপর। অথচ আপনার নাটকে আমরা পাশ্চাত্য ধারার প্রয়োগ অনেক বেশি দেখি। অনেকে বলেন, আপনি খুব ডেকোরেটিভ, এর কারণ কী?

আপনি এমন কথা বলার আগে গুনে গুনে দেখান, আমার কোন কোন নাটকে ইউরোপীয় প্রভাব আছে, আর কোন কোন নাটকে নেই। ‘বেহুলার ভাসান’–এর কথা ধরুন, সেখানে একেবার দেশীয় পালার রীতি ব্যবহার করা হয়েছে, ‘সংভংচং’, ‘সমাধান’, ‘চাকা’—এসব নাটকেও আমি প্রাচ্য নাট্যরীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছি। তবে দেশের প্রচলিত লোকনাট্যধারা থেকে তা আলাদা। কারণ, আমার বলার কথা অনেক জটিল। তাই আমি সেখানেই থেমে থাকতে চাইনি। আমার বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ, আমি ইউরোপীয় রীতি অনুসরণ করি। আসলে খেয়াল করলে দেখবেন, কেউই কিন্তু শতভাগ ওরিয়েন্টাল হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথও চল্লিশ ভাগ ইউরোপীয় ছিলেন। আসলে প্রাচ্য বা ওরিয়েন্টাল ধারণাটাই কলোনিয়াল প্রভুদের সৃষ্টি। এ কথা এডওয়ার্ড সাঈদ বলেছেন। এটা আমার কাছে খুব ঠিক মনে হয়। প্রাচ্য নাট্যরীতির কোনো একক ধারা নেই। বাংলাদেশেও সংস্কৃতি বিচিত্রধারায় প্রবাহিত হয়েছে। এই বৈচিত্র্য বিশ্বজুড়েই ছড়িয়ে আছে। তাকে বাদ দিতে হবে কেন?

সৈয়দ জামিল আহমেদ, চট্টগ্রামের শিল্পকলা একাডেমিতে।
জুয়েল শীল

প্রশ্ন :

ভারতের রতন থিয়াম মণিপুরের লোকনাট্যের আঙ্গিক বিশ্বপরিসরে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।

রতন থিয়াম একজন বড় নাট্যকার। তাঁর কাজ দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু আসলেই কি তিনি প্রাচ্যরীতির প্রয়োগ করেছেন? বহিরাঙ্গে তা মনে হতে পারে, কিন্তু তিনি ছিলেন সিম্বলিস্ট। তাঁর শিক্ষক ছিলেন ইব্রাহিম আল কাজি। ইব্রাহিমের সেট নির্মাণ, কম্পোজিশন—সবই পাশ্চাত্য রীতির। রতন থিয়াম তাঁর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। আর আমি গ্রামে গ্রামে গিয়ে লোকনাট্য দেখেছি। গবেষণা করেছি। তার প্রয়োগ ঘটাতে চেয়েছি নাটকে। সে কথা কেউ বলে না। গ্রামের মানুষও বদলাচ্ছে, আর আমি বদলাব না? বুদ্ধ বলেছেন এই পৃথিবী অনিত্য। অনিত্য এই পৃথিবীতে আমার সৃষ্টিকর্মও অনিত্য। পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে চলতে পারে না সে মৃত।

প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রচলিত পথ থেকে বেরিয়ে আসার একটা প্রবণতা ছিল এখানকার শিল্পী-নাট্যকর্মীদের মধ্যে। এদের ভেতরে বলিষ্ঠ একটা চেতনা ছিল—যা হলো, মানি না। সে জন্য এখানে ভিন্ন ভিন্ন বিচিত্র কিছু কাজ হয়েছে। তির্যক, অরিন্দমের মতো নাটকের দল নতুন নতুন কাজ করেছে। অনেক ঝুঁকি নিয়েছে তারা। এখন মনে হয়েছে, সবাই কেমন ক্লান্ত হয়ে গেছে।
সৈয়দ জামিল আহমেদ
জুয়েল শীল
প্রশ্ন:

দীর্ঘ অনেক বছর পর চট্টগ্রামে ‘বিস্ময়কর সবকিছু’ নাটক নিয়ে এলেন। এখানকার মঞ্চে ৮০ ও ৯০ দশকে কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতার আর এবারের অভিজ্ঞতা পাশাপাশি রাখলে কোনো পরিবর্তন চোখে পড়েছে?

‘বিস্ময়কর সবকিছু’ অন্তরঙ্গ পরিবেশের নাটক। সব মিলিয়ে প্রতি প্রদর্শনীতে ২০ থেকে ২৫ জন দর্শকের সঙ্গে বিনিময়ের সুযোগ হয়েছে। সেখান থেকে আমার মনে হয়েছে চট্টগ্রাম আগের মতো নেই। ৮০-৯০ দশকে আমার এক আমেরিকান বন্ধু এখানে এসেছিলেন নাটক নিয়ে কাজ করতে। তিনি বলেছিলেন, এই শহরটা একেবারে ফ্রন্টিয়ার বা প্রান্তের শহর। এখানকার সংস্কৃতি একেবারেই আলাদা মনে হচ্ছিল ওর কাছে। কারণ, চট্টগ্রামের সংস্কৃতি সারা দেশ থেকে এমনকি ঢাকা থেকেও একেবারেই আলাদা। এখানকার তরুণদের মধ্যে বুদ্ধি ও যুক্তির একটা ধার ছিল। জেদের ধার ছিল। সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে নতুন কিছু তৈরি করার সাহস ছিল। ওই ধারটা এখন ভোঁতা হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম একেবারে তারুণ্যের একটা শহর ছিল। বুদ্ধিদীপ্ত তরুণেরা কাজ করতেন এখানে। তাঁরা সব সময় ভিন্ন পথে হেঁটেছেন। এখন আর সেটা মনে হয় না।

প্রশ্ন:

এটা কেন মনে হয়েছে?

কারণ একসময় দেখেছি, প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রচলিত পথ থেকে বেরিয়ে আসার একটা প্রবণতা ছিল এখানকার শিল্পী-নাট্যকর্মীদের মধ্যে। এদের ভেতরে বলিষ্ঠ একটা চেতনা ছিল—যা হলো, মানি না। সে জন্য এখানে ভিন্ন ভিন্ন বিচিত্র কিছু কাজ হয়েছে। তির্যক, অরিন্দমের মতো নাটকের দল নতুন নতুন কাজ করেছে। অনেক ঝুঁকি নিয়েছে তারা। এখন মনে হয়েছে, সবাই কেমন ক্লান্ত হয়ে গেছে। অনেক হিসাব করে কথা বলে।

বিস্ময়কর সবকিছু’ নাটকের একটি দৃশ্যে প্রথম আলো।
প্রশ্ন:

কিন্তু নাটক তো হচ্ছে। আপনার সহযোগীদের অনেকে এখনো সক্রিয়।

তা হচ্ছে। তবে নতুন কিছু হচ্ছে না। কিন্তু প্রচলিত চিন্তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস কমে গেছে। এখন সবাই অনেক সেটেল। চিন্তাগুলো যেন সব শিকড় গেড়ে বসেছে।

সৈয়দ জামিল আহমেদ
জুয়েল শীল
প্রশ্ন:

একসময় বৈরী রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে, সে কারণেই সাহস দেখানোর প্রয়োজন ছিল?

এর উত্তর দিতে গেলে অনেক গবেষণা করতে হবে। অনেক বিশ্লেষণ করতে হবে। সারা দেশের ক্ষেত্রেই এ কথা বলা যায়। তবে এটা খুব সত্যি। আমরা জামাত ঠেকাতে গিয়ে, আমাদের পক্ষের যাঁরা আছেন, তাঁদের সমালোচনা বন্ধ করে দিয়েছি। সমালোচনা সব সময় গুরুত্বপূর্ণ। সমালোচনা মানেই বিরোধিতা নয়। আমরা যখন মনে করি যে আমরা আমাদের সমালোচনা করব না, তখন চিন্তাটাই মরে যায়।

প্রশ্ন:

সব ক্ষেত্রেই কি এমনটা হচ্ছে? সাহিত্যের ক্ষেত্রেও? নাটকও একভাবে সাহিত্যেরই অংশ।

দেখুন, সাহিত্যের কথা আমি জানি না। আর নাটক সাহিত্য নয়। নাটক পুরোপুরি পারফরম্যান্স–নির্ভর। আপনি যেটা পড়ছেন, সেটা কেবলই টেক্সট। সেটা স্থাপত্যের নকশার মতো। একটা কাঠামো। এটা পূর্ণাঙ্গ হবে তখনই, যখন অভিনয় তাকে ফুটিয়ে তুলবে। অভিনেতাই নাটককে জীবন দেয়। অভিনয় ছাড়া নাটক জীবন্ত হয় না।

সৈয়দ জামিল আহমেদ
জুয়েল শীল
সমালোচনা সব সময় গুরুত্বপূর্ণ। সমালোচনা মানেই বিরোধিতা নয়। আমরা যখন মনে করি যে আমরা আমাদের সমালোচনা করব না, তখন চিন্তাটাই মরে যায়।
প্রশ্ন:

শহীদুল জহিরের উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ নাট্যরূপ দিয়ে মঞ্চে এনেছেন আপনি। নাটক মঞ্চায়নের পর ঢাকার নাট্যজনদের অনেকে আপনার বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ এনেছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও আপনাকে বলতে হয়েছে, আপনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। কেন এমন প্রতিক্রিয়া?

এমন প্রতিক্রিয়ায় আমি খুশি হয়েছি। এরা নাটক দেখে ভালো হয়েছে বলে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে চলে যেতে পারেননি। এরা নাড়া খেয়েছেন। নাড়া খেয়েছেন বলেই এরা কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন। এটা বিরোধের জায়গায় চলে গেছে। তাদের কথা হচ্ছে, আমার বক্তব্য যাতে বিরোধীপক্ষ দখল করে না নেয়। আমার কাছে মনে হয়েছে, শহীদুল জহির এ বিষয়ে খুব পরিষ্কার। দর্শকদের কাছেও এটা খুব পরিষ্কার ছিল।

জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নাটকের দৃশ্য
নাড়া খেয়েছেন বলেই এরা কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন। এটা বিরোধের জায়গায় চলে গেছে। তাদের কথা হচ্ছে, আমার বক্তব্য যাতে বিরোধীপক্ষ দখল করে না নেয়।
প্রশ্ন:

একটা সময় দেশে গ্রুপ থিয়েটারে অনেক ভালো কাজ হয়েছে। ‘দেওয়ান গাজীর কিস্‌সা’, ‘কিত্তনখোলা’, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘কেরামতমঙ্গল’—এমন অনেক নাটকের নাম মনে পড়ছে। এখন সে তুলনায় থিয়েটারে নতুন কাজ অল্প কয়েকজন করছেন। এই বদল কি চোখে পড়েছে?

এটা বললে আমাকেও যুক্ত করে বলতে হয়। আসলে যদি আত্মসমালোচনা করি, তবে দেখব, ৭০ থেকে ৯০ দশক পর্যন্ত থিয়েটারের লোকজনের ব্যস্ততা কম ছিল। সন্ধ্যায় সবাই নাটকপাড়ায় আসার সময় পেতেন। জীবনে এটুকু উদ্বৃত্ত সময় ছিল। তখনো রামেন্দু মজুমদারের মতো অনেকে পরিবারের কথা না ভেবে আপসহীনভাবে কাজ করেছেন। কিন্তু ৯০ দশকের পর বিশ্বজুড়ে নিউ লিবারেল ইকোনমি চালু হলো। বিশ্বায়নের ধাক্কা লাগল এ দেশেও। রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি কমতে থাকল নানা খাতে। ফলে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য অনেকে নানা কিছু করলেন। ব্যবসায় যুক্ত হলেন। এসব কারণে নাট্যকর্মীরা আগে যেমন ঝুঁকি নিতে পারতেন, তেমন ঝুঁকি নিতে পারছেন না। সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক নানা ব্যবস্থা থেকে সুবিধা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ছাড়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে নিজেদের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে চান না অনেকে। এরা গুটিয়ে গেছেন। এর ফলে আগের মতো ভালো কাজ দেখা যাচ্ছে না।

স্পর্ধা মঞ্চে নিয়ে এসেছে নাটক ৪.৪৮ মন্ত্রাস
সাবিনা ইয়াসমিন
বস্তুগত পৃথিবীর বিশৃঙ্খলার মাঝে দাঁড়িয়ে নীল আকাশের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকানো সাহসের ব্যাপার। বিশৃঙ্খলা এড়িয়ে আপনি চাঁদের আলোয় চুপিচুপি সৌন্দর্য খুঁজতে পারেন। তাতে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হয়।
প্রশ্ন:

‘চাকা’ থেকে শুরু করে, ‘৪.৪৮ মন্ত্রাস’, ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ সাম্প্রতিক সব নাটকই ভীষণ রাজনৈতিক। সমকালের সমাজ-রাজনীতিকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়। এর কারণ কী?

আমি জানি নাটক দিয়ে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়। আমি যত দূর সম্ভব, প্রশ্ন তুলতে চাই। সমাজের সব স্তরে প্রতাপ ও ক্ষমতার লড়াই চলছে। পরিবার থেকে রাষ্ট্রের সব স্তরে এটা দেখবেন। এই ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোকে ধাক্কা দিতে হবে। তবেই বহু ধরনের চিন্তার রাস্তা তৈরি হবে। প্যারালজি তৈরি হবে। আমি দর্শককে আরাম দেওয়ার জন্য নাটক করি না। ধাক্কা দেওয়ার জন্য, নাড়া দেওয়ার জন্য নাটক করি। কেবল কারও ভালো লেগে গেল, এটা তো হতে পারে না। তবে কেন নাটক করলাম। আমি কাউকে তৃপ্ত হতে দেব না। আসলে এই সমাজে আপনাকে গেরিলা হতে হবে। গেরিলার মতো ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তবেই আমি সার্থক।

সৈয়দ জামিল আহমেদ
প্রশ্ন:

এই ধাক্কা দিতে গিয়ে খানিকটা কি হৃদয়বৃত্তি বাদ পড়ে যাচ্ছে না। যাকে আমরা স্পিরিচুয়াল বলি, গভীর জীবনবোধ বলি, তার কিছুটা কি ঘাটতি থেকে যায়?

বস্তুগত পৃথিবীর বিশৃঙ্খলার মাঝে দাঁড়িয়ে নীল আকাশের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকানো সাহসের ব্যাপার। বিশৃঙ্খলা এড়িয়ে আপনি চাঁদের আলোয় চুপিচুপি সৌন্দর্য খুঁজতে পারেন। তাতে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হয়।